কলমানি বাজার থেকে ধার করতে হচ্ছে প্রতিদিন

নগদ অর্থের সংকটে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক?

হাছান আদনান

মুদ্রাবাজারে তারল্যের জন্য প্রধান নির্ভরতা ছিল সোনালী, জনতা, অগ্রণী রূপালী ব্যাংক। চার ব্যাংককে ধরা হতো কলমানি বাজারে অর্থ ধারের ভরসাস্থল। সংকটে পড়লে নগদ অর্থের জন্য দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারাও দ্বারস্থ হতেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে। পরিস্থিতি এখন একেবারেই ভিন্ন। কলমানি বাজারের দাতা থেকে তারা হয়ে উঠেছে প্রধান ঋণগ্রহীতা। যদিও ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় হাজার কোটি টাকা ধার করেছে অগ্রণী জনতা ব্যাংক। আর প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার বেশি ধার করতে হয়েছে রূপালী ব্যাংককে। সরকারি আমানত বাড়ায় সোনালী ব্যাংকের পরিস্থিতি এখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে অগ্রণী ব্যাংকের দৈনিক ধারের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। কলমানি বাজারের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও রেপো অ্যাসিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) হিসেবে ধার নেয়া হচ্ছে।

দেশের কলমানি বাজারের মোট লেনদেনের অর্ধেক অর্থই বর্তমানে ধার করছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। গত মঙ্গলবার মোট লেনদেন হয়েছিল হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা, তার হাজার ৯৩ কোটি টাকাই নিয়েছে জনতা, অগ্রণী রূপালী ব্যাংক। একই দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চার ব্যাংক রেপো এএলএস হিসেবে ধার করেছে দ্বিগুণেরও বেশি অর্থ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নিজেদের সক্ষমতার চেয়েও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো আমদানির ঋণপত্র (এলসি) বেশি খুলে ফেলেছে। এখন এলসি দায় সমন্বয়ের জন্য প্রতিনিয়ত তাদের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। তাতে আমানতে টান পড়ছে। আবার বিতরণকৃত ঋণ থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থ আদায় হচ্ছে না। কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংকেরই ট্রেজারি ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুযায়ী ধার না পেলে ব্যাংকগুলো সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) এসএলআর (স্ট্যাটিউটরি লিকুইডিটি রেশিও) সংরক্ষণেও ব্যর্থ হতো।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আফজাল করিম যদিও বণিক বার্তাকে বলেন, মুহূর্তে সোনালী ব্যাংক তারল্য সংকটে নেই। মাঝেমধ্যে বড় পেমেন্টের প্রয়োজনে অর্থের দরকার পড়ছে। কারণে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এএলএস সুবিধা নিচ্ছি। ২০২২ সালে সোনালী ব্যাংকের এডিআর শতাংশ বেড়েছে। ডিসেম্বর শেষে আমাদের এডি রেশিও ৬০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরকারি বিল-বন্ড কেনা এলসি দায় সমন্বয়ের জন্য কেবল সোনালী ব্যাংকের বাড়তি তারল্যের দরকার হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট তরল সম্পদের পরিমাণ ছিল লাখ ৮৬ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে লাখ ৪৯ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা সংরক্ষণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সিআরআর এসএলআর হিসেবে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে জমা রাখা হয়। সে হিসেবে জানুয়ারি শেষে ব্যাংক খাতে বিনিয়োগযোগ্য তারল্যের পরিমাণ ছিল লাখ ৩৬ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। তবে বিনিয়োগযোগ্য তারল্যের মধ্যে মাত্র ১০-১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলোর কাছে নগদে রয়েছে। গত বছরের জুনে ব্যাংক খাতে মোট তরল সম্পদ ছিল লাখ ৪১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তারল্যের সংকটের কারণে দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে (কলমানি) দৈনন্দিন লেনদেন - হাজার কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। একদিন মেয়াদি ধারের সুদহারও উঠে গেছে সাড়ে শতাংশে। তার পরও কলমানি বাজারে চাহিদা অনুযায়ী তারল্যের সংস্থান হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাচ্ছে, একদিন মেয়াদি ঋণের সুদহার শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকুক। কারণে ধারদাতা ব্যাংকগুলো এখন আর কলমানিতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তাই ব্যাংকগুলো এখন শর্ট নোটিসে দুই থেকে ১৪ দিন মেয়াদি ধার দিচ্ছে। এক্ষেত্রে সাতদিন মেয়াদি কলমানির সুদহার উঠে গেছে শতাংশে। যদিও দেশের ব্যাংক খাতে এখন ঋণের সুদহারই সর্বোচ্চ শতাংশ নির্ধারিত রয়েছে।

দেশের কলমানি বাজারে গত মঙ্গলবার মোট হাজার ৭৬৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়। এর মধ্যে হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা ধার করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। আর অগ্রণী ব্যাংক ধার নিয়েছে হাজার ১০০ কোটি টাকা। ওইদিন রূপালী ব্যাংকও ৫৭০ কোটি টাকা কলমানি বাজার থেকে ধার করে।

রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের মোট ধারের পরিমাণ ছিল হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রায় একই পরিস্থিতি ছিল গত সোমবারও। ওইদিন কলমানি বাজারে মোট হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা লেনদেন হয়। এর মধ্যে হাজার ৩৮৮ কোটি টাকাই ধার করেছিল অগ্রণী, জনতা রূপালী ব্যাংক। তবে দুদিনই সোনালী ব্যাংক কলমানি বাজারে কিছু অর্থ বিনিয়োগ করেছে।

কলমানি বাজার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রতিদিন অর্থ ধার করা কোনো ব্যাংকের জন্যই শোভনীয় নয় বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সবসময়ই কলমানি বাজারে ঋণদাতার ভূমিকায় থাকে। কিন্তু এখন কেন তাদের উল্টো প্রতিদিন ধার করতে হচ্ছে, সেটি বোধগম্য নয়। সুশাসনের ঘাটতি অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। আবার যেসব ঋণ খেলাপি হয়নি, সেগুলো থেকেও আদায় পরিস্থিতি ভালো নয়। তারল্যের সংকট তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে ঋণ আদায় না হওয়ার ভূমিকা আছে। আবার ট্রেজারি ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতাও এক্ষেত্রে দায়ী।

আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, কোনো ব্যাংক প্রতিদিন অন্যের কাছ থেকে ধার করে চলার মানে হচ্ছে, সে ব্যাংকে এখন অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কলমানি বাজার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার না পেলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোই সিআরআর এসএলআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে। এটি দেশের ব্যাংক খাতের জন্য ভালো সংবাদ নয়।

মুদ্রাবাজারের সংকট কমাতে প্রতিদিনই রেপো এএলএসে অর্থ ধার দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি সপ্তাহে ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন - হাজার কোটি টাকা ধার দেয়া হয়েছে। আর গত ৩০ মার্চ ধার দিয়েছে হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। ২৮ মার্চও ব্যাংকগুলোকে হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা ধার দিতে হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ . মো. হাবিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকগুলোর হাতে আগের মতো উদ্বৃত্ত তারল্য নেই। চলতি অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে তাদের কাছে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। কারণে বাজার থেকে সমপরিমাণ অর্থ উঠে এসেছে। আবার ব্যয় বাড়ায় সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ বাড়াচ্ছে। এসব কারণে মুদ্রাবাজারে তারল্যের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি বিল-বন্ড কিনছে। আবার এলসি দায় মেটানোর জন্যও ব্যাংকগুলোকে ডলার কিনতে হচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে তারল্যের জোগান দিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মতোই দেশের কিছু বেসরকারি ব্যাংক প্রায় প্রতিদিন কলমানি বাজার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করে চলছে। মঙ্গলবার কলমানি বাজার থেকে অর্থ ধার করার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে ছিল ইস্টার্ন ব্যাংক। এদিন ৮৬৪ কোটি টাকা ধার করে কলমানি বাজার থেকে। গত সোমবারও ৫৬৭ কোটি টাকা ধার করেছিল বেসরকারি ব্যাংকটি।

এছাড়া মঙ্গলবার কলমানি বাজার থেকে প্রাইম ব্যাংক ১৫১ কোটি, দ্য সিটি ব্যাংক ২২৫ কোটি, এবি ব্যাংক ৮০ কোটি, মিডল্যান্ড ব্যাংক ২১৭ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ১৮০ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংক ১২১ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৫০ কোটি, এনসিসি ব্যাংক ৬৭ কোটি, এনআরবি ব্যাংক ১০০ কোটি, ঢাকা ব্যাংক ২০৫ কোটি, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ১৮৬ কোটি, মধুমতি ব্যাংক ২১৫ কোটি, ওয়ান ব্যাংক ১৪০ কোটি, যমুনা ব্যাংক ৩৪৯ কোটি পদ্মা ব্যাংক ৫০ কোটি টাকা ধার করেছে। সোমবারও ব্যাংকগুলোকে অর্থ ধার করতে হয়েছিল কলমানি বাজার থেকে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন