কভিড-পরবর্তী জটিলতা

পোস্টকভিড জটিলতায় মৃত্যুও হতে পারে

অধ্যাপক ডা. শিশির রঞ্জন চক্রবর্তী। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ। করোনা মহামারীতে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন এ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা এবং অধ্যাপনা করছেন। কভিড-১৯-পরবর্তী জটিলতা, চিকিৎসা ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

কভিড-পরবর্তী জটিলতা আসলে কী? 

কভিড-১৯-পরবর্তী অনেক জটিলতা আছে। মানুষের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক জটিলতা হতে দেখা যায়। শারীরিক জটিলতার ক্ষেত্রে ফুসফুসের সমস্যাগুলোই প্রধান। পাশাপাশি আমাদের মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র, কিডনি সবকিছুতেই কিছু না কিছু সমস্যা দেখা দেয়। এসব সমস্যা সবার হয় না। করোনায় আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই ভালো হয়ে যায়। চিকিৎসাও লাগে না। যাদের চিকিৎসা লাগে তারাও সামান্য কভিড-পরবর্তী জটিলতায় ভোগেন। যাদের আগে থেকেই ফুসফুসের সমস্যা, অ্যাজমা, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগ থাকে, তারা বেশি জটিলতায় ভোগেন। বয়স্ক মানুষ বা গর্ভবতী রোগীরা বেশি জটিলতায় ভোগেন। অন্যরা মোটামুটি স্বাভাবিকই আছেন।

জটিলতায় ভোগা ব্যক্তিদের অবস্থা কি মারাত্মক হয়? 

এটি অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। করোনা-পরবর্তী জটিলতায় কেউ কেউ মারা যান। আবার অনেকে অসুস্থতা নিয়ে জীবন কাটান। অনেকেই দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয়। যাদের পুরনো কোনো অসুখ নেই, তারা স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসেন। কিন্তু যাদের আগের কোনো অসুখ থাকে, তারা দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় ভোগেন। শারীরিক সমস্যার সঙ্গে মানসিক চাপ যুক্ত হয়ে ব্যক্তি আরো দুর্বল হয়ে যান।

করোনায় আক্রান্ত হওয়া কত সংখ্যক মানুষ করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভুগেছেন বা এখনো ভুগছেন, এ নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান আছে?

এটি নিয়ে আমাদের কেন্দ্রীয়ভাবে গবেষণা হচ্ছে। এর ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি। করোনা তো এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এটি নিয়ে করোনা পর্যবেক্ষণের কেন্দ্রীয় কমিটি কাজ করছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) কাজ করছে। এছাড়া নিজ উদ্যোগে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এ গবেষণা চলমান। প্রকাশের পর সঠিক পরিসংখ্যান জানা যাবে।

করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভোগা রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?

চিকিৎসার আগে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। জীবনযাপনে সচেতন হতে হবে। করোনা প্রতিরোধী সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিরোধ টিকা নিতে হবে।

করোনা-পরবর্তী জটিলতার জন্য টারশিয়ারি ও মাধ্যমিক পর্যায়ের হাসপাতালে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা আছে কি? নাকি জটিলতা অনুযায়ী রোগীরা চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন?

করোনার চিকিৎসা সব পর্যায়েই আছে। সব হাসপাতালে করোনার জন্য আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে রোগীরা যাবেন। মাল্টিডিসিপ্লিনারি ইনভলভমেন্ট (বিশেষায়িত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা) যদি লাগে, তাহলে তাকে সবগুলো বিভাগের সঙ্গে যুক্ত করে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তার চিকিৎসা করা হয়ে থাকে।

করোনা-পরবর্তী কী ধরনের মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে রোগীরা যাচ্ছেন, সে সম্পর্কে বলুন।

করোনা সারা বিশ্বে একটি পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক পরিবর্তনটাই বড়। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। নতুন কোনো কাজ পাচ্ছেন না। সেই সঙ্গে রোগের একটি প্রভাব তো আছেই। অধিকাংশ লোক করোনা-পরবর্তী বিষণ্নতায় ভুগছেন। অনেকেই উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। আবার অনেকেই বিষণ্নতা ও উদ্বেগে ভুগছেন। এর জন্য করোনা একাই দায়ী নয়। এর সঙ্গে আমাদের সমাজ ও অর্থনীতির নানা বিষয় জড়িত আছে।

করোনা-পরবর্তী এ ধরনের জটিলতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি কী?

আমরা মনে করি, বাংলাদেশের তুলনায় উন্নত দেশগুলোতে জটিলতা বেশি। আমাদের দেশেও আছে। তবে আমাদের দেশের মানুষের মনোবল অনেক শক্ত। আমরা তো সমাজসম্পৃক্ত থাকি, তাই শেয়ারিংয়ের (আলোচনা) মাধ্যমে অনেক সমস্যাই সমাধান হয়ে যায়। পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের কারণে আমাদের দেশে মানসিক জটিলতা কম।

করোনা-পরবর্তী রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে কী ধরনের জটিলতা আপনারা দেখতে পেয়েছেন?

করোনা প্রধানত আক্রমণ করে ফুসফুসকে। অনেক সময় ফুসফুস সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাদের আগের কোনো রোগ থাকে, অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট থাকে, তারা আরো বেশি দুর্বল হয়ে যান। তাদের সুস্থ হওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে যায়। তবে এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভোগা রোগীদের জন্য উচ্চ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা আছে? নাকি গড়পড়তা চিকিৎসা চলছে?

উচ্চ পর্যায় থেকে অবশ্যই নজর রাখা হচ্ছে। হয়তোবা আমাদের রোগীরা ঠিকমতো যোগাযোগ করে না বা আসে না, কিন্তু বিশেষায়িত হাসপাতাল থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পর্যন্ত আমাদের প্রতিটি হাসপাতালেই করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভোগা রোগীদের চিকিৎসার জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে যথাযথ চিকিৎসা না হলে জেলায় পাঠানো হয়। জেলায় না হলে বিভাগীয় পর্যায়ের মেডিকেল কলেজগুলোতে পাঠানো হয়। এভাবে একটি শক্তিশালী রেফারেল উইংয়ের মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা আছে। করোনা-পরবর্তী জটিলতাগুলো ছোঁয়াচে না। তাই করোনা ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এর জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

মহামারী ব্যবস্থাপনায় দেশের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।

এ ধরনের মহামারী আমাদের জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। এ মহামারী সামলাতে গিয়ে আমাদের স্বাস্থ্য কাঠামোতে যে উন্নতি সাধিত হয়েছে, এতে এর চেয়েও বড় মহামারী সামাল দেয়ার প্রস্তুতি কিন্তু আমাদের অর্জিত হয়েছে। আমাদের দেশে আবার যদি করোনা শুরু হয়, তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। যথেষ্ট অক্সিজেন আছে। পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা ও লোকবল আছে। যেকোনো মহামারীকে মোকাবেলা করতে আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত। আমরা আশা করি যে আর কোনো মহামারী হবে না। কিন্তু মহামারীকে সামাল দিতে আমরা সবদিক দিয়েই প্রস্তুত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন