ডায়ালাইসিস

সেন্টার ও মেশিনের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে ডায়ালাইসিস

রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবা নিচ্ছে রোগীরা ছবি: কাজী সালাহউদ্দীন রাজু

বাংলাদেশে কোনো না কোনো কিডনি রোগে ভুগছে প্রায় দুই কোটি মানুষ, তার মধ্যে প্রায় ৪০ হাজারের কিডনি পুরোপুরি বিকল। বর্তমানে কিডনি বিকল হওয়া রোগীদের প্রায় ২০-২৫ শতাংশ চিকিৎসা, যেমন ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি প্রতিস্থাপন করে থাকে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও যেখানে সংখ্যাটা ছিল মাত্র ১০-১৫ শতাংশ। বাংলাদেশে কিডনি চিকিৎসক আছেন ২৬২ জন, এর মধ্যে শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ৫৭ জন। দেশে মোট ডায়ালাইসিস সেন্টার রয়েছে ১৪০টি, ডায়ালাইসিস টেকনিশিয়ান রয়েছে ১৫০০-২০০০ জন, রয়েছে ২৮ জন প্রশিক্ষিত ডিপ্লোমা রেনাল নার্স। এর পাশাপাশি ৩৭ জন রয়েছে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে।

কিডনি বিকল হওয়ার যে কয়েকটি কারণ রয়েছে বিশেষ করে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস আর কিডনির ছাঁকনির প্রদাহজনিত সমস্যা, এগুলোর চিকিৎসা মূলত মেডিসিন বিশেষজ্ঞরাই দিয়ে থাকেন। তবে আকস্মিক কিডনি বিকল, ইজিএফআর টেস্টের ফলাফল যদি ৩০-এর কম হয় অথবা ইজিএফআর যদি বছরে -এর বেশি কমে যায় অথবা বছরে ১০-এর বেশি কমে তাহলে কিডনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করা হয়। তাছাড়া কিডনি রোগের কারণে যদি ইলেকট্রোলাইট, ক্যালসিয়াম, ফসফেট, ইউরিক অ্যাসিডের অসামঞ্জস্য দেখা দেয় তাহলেও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে সে রোগীকে পাঠাতে হবে।

কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ যাবতীয় চিকিৎসা দেয়ার পরও যদি কারো তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয় সেসব রোগীর ক্ষেত্রে মৃত্যুহার বেশি দেখা যায়। তবে বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশের মতো রোগীর ছয় মাসের মধ্যে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়ে থাকে।

কখন ডায়ালাইসিস শুরু করতে হয়

দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন এমন রোগীর যদি হঠাৎ করে অস্বাভাবিক বমি হয়, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, যদি রোগী উলটপালট কথা বলা শুরু করে অথবা আকস্মিক অজ্ঞান হয়ে পড়ে তাহলে তার ডায়ালাইসিস শুরু করতে হতে পারে।

১৮ বছরের বেশি বয়সীদের ইজিএফআর যদি ১৫-এর কম থাকে এবং ১৮ বছরের কম বয়সীদের ইজিএফআর যদি ২০-এর কম থাকে তাহলে ডায়ালাইসিস শুরু করতে হতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক রোগী যার ডায়াবেটিস নেই তার ক্রিয়েটিনিন মিলিগ্রামের বেশি হলে অথবা যার ডায়াবেটিস আছে তার যদি ক্রিয়েটিনিন মিলিগ্রামের বেশি হয় তাহলে ডায়ালাইসিস শুরু করতে হতে পারে।

ডায়ালাইসিসের প্রকারভেদ

চিকিৎসার ক্ষেত্রে কয়েক ধরনের ডায়ালাইসিস সেবা চালু রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হেমো ডায়ালাইসিস, পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস বিশেষ ধরনের হেমো ডায়ালাইসিস। পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিসে আবার রয়েছে তিনটি ভাগ। সিএপিডি, অটোমেটেড ডায়ালাইসিস এবং অ্যাসিস্ট্যাট ডায়ালাইসিস। বিশেষ ধরনের হেমো ডায়ালাইসিসে রয়েছে দুটি ভাগস্লেড ডায়ালাইসিস সিআরআরটি।

ডায়ালাইসিসের জন্য ভাস্কুলার অ্যাকসেস তৈরি

জরুরি ক্ষেত্রে ক্যাথেটার করে ডায়ালাইসিস শুরু করতে হয়। ক্যাথেটার তিন ধরনের হয়। ফিমোরাল ক্যাথেটার, জুগুলার ক্যাথেটার সাব ক্ল্যাভিয়ান ক্যাথেটার। তাছাড়া দীর্ঘদিন যথাযথভাবে ডায়ালাইসিস করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফিস্টুলা। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ যখন চতুর্থ ধাপে পৌঁছায় কিংবা ইজিএফআর যখন ২৫-এর কম হয় তখনই ফিস্টুলা করে ফেলা দরকার।

ফিস্টুলার যত্ন

সাধারণত ফিস্টুলা চালু হতে ছয় সপ্তাহ সময় লাগে। যারা ডান হাতে কাজ করেন তাদের বাম হাতে এবং যারা বাম হাতে কাজ করেন তাদের ডান হাতে ফিস্টুলা তৈরি করতে হয়। ফিস্টুলা হাতে প্রেশার মাপা যায় না। ফিস্টুলা হাতে স্যালাইন কিংবা ইনজেকশন দেয়া যায় না। ফিস্টুলা হাতে ভারী কাজ করা যায় না। ফিস্টুলা হাতে ভারী জিনিস বহন করতে হয় না।

ফিস্টুলা করা না গেলে অনেক সময় গ্রাফট করতে হয়। গ্রাফট অনেক সময় দুই বছরের বেশি সময় কাজ করে না। গ্রাফট করলে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ডায়ালাইসিস রোগীদের কম কম পানি, বেশি প্রোটিন এবং কম ফসফেট, কম ইউরিক অ্যাসিড কম পটাশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার খেতে হয়।

তবে সার্বিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় দেশে কিডনি চিকিৎসার সহজলভ্যতা বেড়েছে। এর পেছনে বেশকিছু কারণও রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে সরকারি উদ্যোগে বিভাগীয় শহর এবং সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিডনি বিভাগ ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন করা। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন করা। ডিপ্লোমা ইন রেনাল নার্স চালু করার কারণেও বেশ সুবিধা হচ্ছে।

এর পাশাপাশি কিছু কারণে কিডনি রোগের চিকিৎসা ব্যাহতও হচ্ছে। অপ্রতুল ডায়ালাইসিস সেন্টারসহ কমসংখ্যক মেশিন থাকা এর একটি কারণ। রয়েছে দক্ষ জনবলের অভাব। কমসংখ্যক কিডনি চিকিৎসক থাকার কারণেও বেশ ভুগতে হয়। তাছাড়া সরকারের দেয়া ভর্তুকি ডায়ালাইসিস সেশন কোনো কোনো সুবিধাভোগী রোগী পেয়ে থাকে।

কিডনি চিকিৎসাকে যদি আমরা ফলপ্রসূ করতে চাই তাহলে আমাদের কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের সব রোগীর জন্য বিনামূল্যে কিডনি ডায়ালাইসিস কিংবা প্রতিস্থাপনের মতো চিকিৎসা নিশ্চিত করা সরকারের একার পক্ষে অসম্ভব। ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবীমা চালু করলে আর্থিক বিষয়গুলো সমাধান হওয়া সম্ভব। তাছাড়া বাসায় ডায়ালাইসিস বা সিএপিডি ফ্লুইড সহজলভ্য করলেও কিছুটা সমাধান আসবে। আর মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন অর্থাৎ ব্রেন ডেড ব্যক্তির কিডনি সংগ্রহ করে সেটি কিডনি বিকল রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করার ব্যবস্থা করতে হবে, যা উন্নত বিশ্বে কিডনি বিকল রোগীদের প্রথম চিকিৎসা।

 

ডা. শেখ মইনুল খোকন

প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, হিউম্যান এইড বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন