বলিউডের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অ্যাকশন সিনেমা

আসরার আবেদিন

পাঠান সিনেমার দৃশ্যে জন আব্রাহাম ও শাহরুখ খান ছবি: আইএমডিবি

পাঠান মুক্তির এক সপ্তাহের বেশি পেরিয়েছে। সিনেমার বিশ্লেষণ বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে বলিউড, ভারতীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বহু কথা হয়েছে। সেখানে নেতিবাচক কথা তুলনামূলক কম। কারণ নানা বাধা পার করে সিনেমাটি মুক্তি তো পেয়েছেই, ভেঙেছে একের পর এক রেকর্ড। ‘‌সিনেমার গুণ’ পাঠানে আছে কিনা বা পাঠান কতটা ‘‌ভালো সিনেমা’, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু তাত্ত্বিক সে আলাপের বাইরে সিনেমাটি দর্শকের জন্য অন্যতম ‘‌সেরা সিনেমা’-য় পরিণত হয়েছে, তা পাঠান মুক্তি-পরবর্তী দর্শক প্রতিক্রিয়া থেকেই দেখা যাচ্ছে।

সিনেমাটিকে শাহরুখের ‘‌কামব্যাক ফিল্ম’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। পাঠানের শুরুও মূলত পাঠানের ফিরে আসা নিয়ে। ভারতের সিক্রেট সার্ভিসের একজন এজেন্ট, যিনি বহুদিন তার এজেন্সি থেকে দূরে ছিলেন, এটি তার গল্প। সিনেমা শুরুও হয় একটি জটিল পরিস্থিতিতে, এজেন্সিতে পাঠানের প্রয়োজনের কথা প্রকাশ করে। আর তারপর পাঠান প্রথমে গড়ে তোলে একটি বিশেষ দল এবং সে দল নিয়ে তার একটি অপারেশনই এ সিনেমার গল্প।

যেকোনো স্পাই-থ্রিলারের পরিচিত গল্প—দেশ যখন বিপদের মুখে, তখন একজন এজেন্ট ওয়ান ম্যান আর্মি হয়ে সংকট থেকে দেশ বা শহরকে উদ্ধার করে। কেবল স্পাই-থ্রিলার নয়, এ যেন নায়কের ক্ল্যাসিক ধারায় পরিণত হয়েছে। সেখানে পাঠান ব্যতিক্রম নয়। গল্পও নতুন নয়। কিন্তু নানা কারণে ভারতীয় সিনেমার প্রেক্ষাপটে পাঠান নতুন, ‌পাঠান ভিন্ন। সত্যি বলতে বলিউডে ‘‌অ্যাকশন সিনেমা’ ছিল না। আশি-নব্বইয়ের দশকে যে সিনেমাগুলো হতো, তা বলিউডের নিজস্ব অ্যাকশন সিনেমা। এরপর ‘‌ধুম’ ঘরানার সিনেমা এনেছিল যশরাজ ফিল্মস কিন্তু ধুম ফ্র্যাঞ্চাইজির বাইরে অ্যাকশন সিনেমা বলিউডে বেড়ে ওঠেনি। পাঠান ঠিক এ জায়গায় সফল। সিদ্ধার্থ আনন্দ ও যশরাজ ফিল্মস এমন একটি সিনেমা নির্মাণ করেছে, যা হলিউডের অ্যাকশন সিনেমার সফল অনুকরণ। এর আগে অনুকরণটা ঠিকভাবে হয়নি। নায়ক-খলনায়ক দ্বৈরথ, চেজ করার দৃশ্য, অ্যাকশন কোরিওগ্রাফি মিলে পাঠান হয়ে উঠেছে বলিউডের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অ্যাকশন সিনেমা।

বলিউডের সিনেমাগুলোয় কোনো না কোনোভাবে নায়ককে একজন ‘উপমহাদেশীয় আদর্শ মানুষ’ দেখানোর চেষ্টা করা হয়। পাঠান সে ধারারই মানুষ, তবে ওই ভালো মানুষের বিষয়টা যতটা সম্ভব এড়ানো হয়েছে। পাঠান ভালো মানুষ, কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা সে ‘‌ফোকাসড সোলজার’। তবে এ সিনেমার খলনায়ক, নায়ককে ছাপিয়ে যায়। পাঠানের সবচেয়ে বড় সাফল্য এর খল চরিত্রটি। বলিউডের সিনেমায় নায়ক ও ভিলেন সমানে সমানে টক্কর তেমন হতো না। পাঠানের খলনায়ক জিম কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঠানের তুলনায় এগিয়ে। আবার জিমের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা দর্শককে জিমের প্রতি সহানুভূতিশীল করবে। কিন্তু জিম যখন তার নিজের অবতারে, তখন তাকে পুরোদস্তুর একটা শয়তান বলেই মনে হয়। অনুপমা চোপড়া তার রিভিউতে বলেছেন, ‘একজন সত্যিকার অ্যাকশন হিরো হতে শাহরুখ খানের ৩২ বছর লাগল’। এ কথা যেমন ঠিক, তেমন করে এটাও ঠিক যে অ্যাকশন সিনেমায় একজন (প্রায়) পারফেক্ট ভিলেন তৈরিতে বলিউডের আরো বেশি সময় লাগল।

দারুণভাবে হিসাব করে ‘‌পাঠান’ নির্মাণ করেছে যশরাজ ফিল্মস। শাহরুখ খানের ইন্ট্রো সিন থেকে শুরু করে, বেশরম রঙ, জিমের ব্যাক স্টোরি, পাঠান-রুবাই রোমান্স—প্রতিটি বিষয়ই এসেছে একদম ঠিক সময়ে। এর বাইরে পাঠানে ছিল দর্শককে ধরে রাখার বহু উপাদান। হয় অ্যাকশন, নয় সংলাপ, নয় রোমান্স, কিছু না কিছু থাকছেই প্রতিটা মুহূর্তে। সালমান খানের ক্যামিও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। বোঝাই যাচ্ছে, যশরাজের স্পাই ইউনিভার্সে টাইগার ও পাঠানকে একসঙ্গে আবার দেখা যাবে। পাঠানে বলিউডের দুই খানকে একসঙ্গে দেখার পাশাপাশি অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভুলে গেলে চলবে না। আশুতোষ রানা যেন এ ইউনিভার্সের নিক ফিউরি হয়ে এসেছেন। ডিম্পল কাপাডিয়াকে আমরা বহু সিনেমায় বিচিত্র চরিত্রে দেখেছি, কিন্তু পাঠানে নন্দিনী চরিত্রে তার অভিনয় ছিল ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স। দীপিকা পাড়ুকোন যথারীতি গ্ল্যামারাস এবং এ সিনেমায় তিনিও এজেন্ট হয়ে উঠেছেন। জন আব্রাহামকে এতই পছন্দ করেছে দর্শক যে তাকে ফিরিয়ে আনার দাবি উঠছে।

শাহরুখ খানের কথা বলাই বাহুল্য। চার বছর পর নিজেকে প্রমাণ করলেন তিনি। ইন্ট্রো দৃশ্যে তার বলা ‘‌জিন্দা হ্যায়’ থেকেই যেন জানান দিলেন, তিনি ফিরে এসেছেন। এখনো ফুরিয়ে যাননি। ব্যবসায়িক সিনেমা হিসেবে পাঠানের নায়কের যা যা করা দরকার, শাহরুখ তেমনই অভিনয় করেছেন। নিজেকে নতুন করে তৈরি করেছিলেন তিনি পাঠানের জন্য। সিনেমার কিছু জায়গায় অকারণ অভিব্যক্তি, অতি অভিনয় মনে হতে পারে, কিন্তু আম-দর্শকের জন্য নির্মিত এ সিনেমায় শাহরুখের সংলাপে যে দর্শকরা চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করেছেন, তা এখন সবারই জানা। সময়টা ‘‌বাজার’-এর। আর বাজার বুঝেই নির্মিত হয়েছে পাঠান। পাশাপাশি বাজার ও দর্শক চাহিদাকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে পাঠান গুরুত্বপূর্ণ একটি সিনেমা। কেননা পাঠান দেখিয়েছে দর্শক কী চায়। পাঠান বুঝিয়েছে নির্মাতাদের কী করতে হবে। তাই পাঠান থেকে শুরু হতে পারে বলিউডের নতুন অধ্যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন