সাক্ষাৎকার

ফ্রোজেন শোল্ডারের কারণে জীবনযাত্রার মান কমে যায়

ছবি: মাসফিকুর সোহান

অধ্যাপক ডা. মো. মনিরুজ্জামান খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (গবেষণা উন্নয়ন) ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের অধ্যাপক। ফ্রোজেন শোল্ডার বা কাঁধের জড়তার (অ্যাডেসিভ ক্যাপসুলাইটিস) বিষয়ে জনস্বাস্থ্যের উদ্বেগ, চিকিত্সা, প্রতিরোধের বিষয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

ফ্রোজেন শোল্ডার সমস্যা কি জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগের কারণ?

ফ্রোজেন শোল্ডার সাধারণত ডায়ারেটিস আক্রান্ত রোগীদের বেশি হয়ে থাকে। এর ফলে কাঁধ জ্যাম হয়ে থাকে, সেটা ওঠানো যায় না। হাতও ব্যথা করে, তোলা সম্ভব হয় না এবং কর্মক্ষমতা অনেক কমে যায়। একটা হাতে কর্মক্ষমতা কমে গেলে মানুষের কোয়ালিটি অব লাইফ (জীবনযাত্রার মান) কমে যায়। ২৪ ঘণ্টা ব্যথাটা এত বেশি করে যে মানুষ কষ্ট পায়। এতে মেজাজও খিটখিটে হয়ে যায়। কোনো কাজ ভালো লাগে না, সব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি কী কী সমস্যা দেখা যায়?

৯০ শতাংশ ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের সমস্যায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়, পুরোপুরি ভালো হতে সময় লাগতে পারে ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত। দীর্ঘমেয়াদি রোগ এটি। ব্যথাও থাকে প্রতিনিয়ত। একটা হাতের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় কাজের মান পরিমাণ দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দীর্ঘমেয়াদি কী কী রোগাক্রান্তদের মধ্যে ফ্রোজেন শোল্ডারের ঝুঁকি বেশি রয়েছে?

ডায়াবেটিস ছাড়াও কিছু রোগী পাওয়া যায় যাদের ফ্রোজেন শোল্ডারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ আমরা জানি না। তাদের বলা হয় ইডিওপ্যাথিক। কোনো কারণ জানা যাচ্ছে না কিন্তু ফ্রোজেন শোল্ডার হচ্ছে। আঘাত থেকেও রোগ হতে পারে। শোল্ডারে বা তার আশপাশের কোনো জায়গায় ব্যথা পেলে, কোনো লিগামেন্ট, টিস্যু বা মাসলে ইনজুরি হলেও ফ্রোজেন শোল্ডার হতে পারে। তাছাড়া ওই জায়গায় যদি কোনো সার্জারি হয়ে থাকে যেমন মাসেকটমি, স্তনের কোনো সার্জারি হলে ফ্রোজেন শোল্ডার খুব কমন হয়ে যায়। আবার ওপেন হার্ট সার্জারি বা বাইপাস সার্জারি হলেও ঝুঁকি বেড়ে যায়।

গবেষণায় দেখা যায়, চল্লিশোর্ধ্বদের মধ্যে ফ্রোজেন শোল্ডারের সমস্যা বেশি। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এর কারণ কী?

চল্লিশকে আমরা একটা পিক আওয়ার ধরি (ফ্রোজেন শোল্ডারে ঝুঁকি) তারপর অনেক শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়। এর পর থেকে শারীরিক অবস্থারও অবনতি হতে থাকে। ফ্রোজেন শোল্ডার শুধু মেয়েদের হয়, কারণ মেয়েদের সাংসারিক কাজগুলো বেশি করতে হয়। তাছাড়া মেয়েদের ডায়াবেটিস অনেক সময় আননোটিসড (অচিহ্নিত) থাকে। ফলে তাদের ফ্রোজেন শোল্ডার হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ফ্রোজেন শোল্ডার হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।

সমস্যা সমাধানে কী ধরনের চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে থাকেন?

সমস্যার লক্ষণ অনুযায়ী আমরা চিকিৎসা করি। ফ্রোজেন শোল্ডার যখন নতুন শুরু হয় তখন প্রচণ্ড ব্যথা হয়। তখন আমরা কিছু ব্যথানাশক ওষুধ দিই। সঙ্গে মাসল রিলাক্টেন্ট (পেশির জড়তা কাটাতে) দিই। সেটাও মাসল রিল্যাক্স করতে খুব কাজ করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অথবা অন্য কোনো অপারেশন বা সেকেন্ডারি কোনো কারণের জন্য যদি হয় তখন আমরা কিছু থার্মোথেরাপি দিই। শোল্ডার স্টিফ হয়ে থাকে। ফিজওথেরাপির কিছু ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করলে সেই স্টিফনেসটা কেটে যায়। ব্যথানাশক দিয়ে ব্যথা কমলে আমরা ব্যায়ামে যাই ধীরে ধীরে। হঠাৎ করে ব্যায়াম করলে কিন্তু ব্যথা বেড়ে যাবে। এই ব্যায়ামেই রোগী পুরোপুরি সেরে ওঠে।

দেশে চিকিৎসা ব্যয় সীমাবদ্ধতা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ বলুন।

ফ্রোজেন শোল্ডারের চিকিৎসা বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের এক্সপার্টরা (বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ) করে থাকেন। ফিজিক্যাল মেডিসিন, অর্থোপেডিশিয়ান, নিউরোলজিস্ট আর ইন্টার্নিরাও করেন। ফিজিওথেরাপি দেয়ার সময় আমরা ভুক্তভোগীকে বিভিন্ন ফিজিওথেরাপি ক্লিনিকে পাঠিয়ে দিই। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি সেন্টার আছে, বেসরকারিও আছে। আক্রান্তরা যেখানে তার চিকিৎসা করবেন ভাবেন আমরা সেভাবেই পরামর্শ দিই।

অনিয়মতান্ত্রিক বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনযাপন ফ্রোজেন শোল্ডারের জন্য কতটুকু প্রভাবক?

আমাদের কাঁধ অঞ্চলে অনেক টেন্ডন আছে। জয়েন্টটা টাইট করে ধরে রাখাই তাদের কাজ যেন তা সরে না যায় বা ডিসপ্লেস না হয়। যেকোনো একটা টেন্ডনে হঠাৎ করে ক্যালসিয়াম ডিপজিশন হতে পারে। সেটাকে আমরা ক্যালসিফিক টেন্ডোনিটিস বলি। প্রচণ্ড ব্যথা হয়। মনে হয় যেন ছুরি দিয়ে খোঁচানো হচ্ছে। যারা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে, যেমন যারা অ্যালকোহল পান করে বা অনেক বেশি ফাস্টফুড খায়, যারা প্রোটিন বেশি করে খায় তাদের সেরাম ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যেতে পারে। ফলে শোল্ডারের বিভিন্ন লিগামেন্টে ক্রিস্টাল ডিপজিশন হয়। তখনো প্রচণ্ড ব্যথা হয়।

বিভিন্ন পেশাজীবীর মধ্যে ফ্রোজেন শোল্ডারে আক্রান্তের হারে তারতম্য কেমন?

এমন কোনো তথ্য আমাদের নেই। তবে যারা হাতের কাজ বেশি করে তাদের ওখানকার লিগামেন্টে মাইকোটোমা হতে পারে। তাতে সেখানে ব্যথা হতে পারে। ফ্রোজেন শোল্ডার হলো পেইনফুল কন্ডিশনের জন্য হাত ঠিকমতো তুলতে না পারা ঠিকমতো কাজ করতে না পারা।  যেসব কারণে এসব সমস্যা হতে পারে তার সব কারণেই ফ্রোজেন শোল্ডার হতে পারে।

এই রোগ শতভাগ প্রতিরোধমূলক কিনা।

এটা সেলফ লিমিটিং একটা ডিজিজ। এটা নিজে নিজেই ভালো হবে কিন্তু সময় লাগে বেশি। ৯০ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগীদের ফ্রোজেন শোল্ডার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই ডায়াবেটিস হলে প্রথমেই তা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হবে। আঘাতের কারণেও হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের জন্যও সমস্যা হয়, সেসব নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকলে ফ্রোজেন শোল্ডারের ঝুঁকি থেকে অনেকটা মুক্তি পাওয়া যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন