উদ্বৃত্তের দাবি করলেও ভারত-মিয়ানমার থেকে চাল আনতে মরিয়া সরকার

সাইফ বাপ্পী ও শাহাদাত বিপ্লব

মিয়ানমার থেকে চাল আমদানিতে গত সেপ্টেম্বরে দেশটির সঙ্গে এক সমঝোতা সই করে বাংলাদেশ। সমঝোতা অনুযায়ী, ২০২৭ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে মোট আড়াই লাখ টন আতপ চাল ৫০ হাজার টন আধা সেদ্ধ চাল আমদানি করবে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালেও জিটুজি চুক্তির আওতায় মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি হয়েছে দেড় লাখ টন। চলতি জানুয়ারিতেই সরাসরি হাজার ৬৫০ টন আমদানি হওয়ার কথা রয়েছে।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের নেতৃত্বে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিনিধি দল গত মাসেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চাল উৎপাদনকারী তিন দেশ থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ভিয়েতনাম সফর করে ফিরেছে। সফর চলাকালে দেশগুলোর মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেয়ার পাশাপাশি চাল রফতানিকারক সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনায় বসেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। উদ্দেশ্য ছিল দেশগুলো থেকে চাল আমদানি নিশ্চিত করা।

ডিসেম্বরেই বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ে একটি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দেশটি থেকে পণ্য আমদানিতে বার্ষিক কোটা চেয়েছে বাংলাদেশ। সময় খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চালসহ বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ভারতের পক্ষ থেকে কোটা সুবিধা চাওয়া হয়। দেশটি এতে সম্মতিও দিয়েছে।

কিছুদিন আগেই ৫০ হাজার টন চাল আমদানির জন্য আন্তর্জাতিক এক দরপত্রের আহ্বান করে বাংলাদেশ। দরপত্রে সর্বনিম্ন মূল্যের প্রস্তাবদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছত্তিশগড়ভিত্তিক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান বাগাদিয়া ব্রাদার্সকে পণ্য সরবরাহের দায়িত্ব দিতে চায় সরকার। চলতি সপ্তাহে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে -সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবে অনুমোদনও দেয়া হয়। প্রতি টন ৩৯৩ ডলার ১৯ সেন্ট দরে (সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী ৪১ হাজার টাকার কিছু কম) প্রায় কোটি ৯৬ লাখ ৬০ ডলারের চাল সরবরাহ করবে প্রতিষ্ঠানটি। অনুযায়ী প্রতি কেজি চালের দাম পড়বে ৪২ টাকা পয়সা।

ভারতসহ দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চাল উৎপাদনকারী দেশগুলো থেকে খাদ্যশস্যটি আমদানিতে রীতিমতো মরিয়া ভাব দেখাচ্ছে সরকার। এমনকি রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি সত্ত্বেও দেশটি থেকে চাল আমদানি অব্যাহত রাখতে চায় বাংলাদেশ। বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য হলো, দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের তাগিদে চাল আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

যদিও সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বলছে, চালের জন্য বাংলাদেশের আমদানিনির্ভরতা এখন দিনে দিনে কমে আসছে। এমনকি কোনো কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দাবি করে প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) দাবি, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদন হয় কোটি ৯৭ লাখ টন। এর বিপরীতে চাহিদা ছিল কোটি ৫৭ লাখ টন। সে হিসেবে গত অর্থবছর শেষে দেশে চালের উদ্বৃত্ত ছিল ৪২ লাখ টন।

কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চাল আমদানি পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। এতে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে চাল আমদানি করতে হয়েছে লাখ ৮৭ হাজার টন। আর গত বুধবার পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের পর্যন্ত লাখ ৬৭ হাজার ১৬০ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে দেশে চালের মজুদ রয়েছে ১৪ লাখ ৬০ হাজার ৭২২ টন।

চাল আমদানি বাড়াতে সরকারের নানামুখী তত্পরতা সত্ত্বেও সরকারি সংস্থাগুলোর দাবি, বাংলাদেশে চালের আমদানিনির্ভরতা দিনে দিনে কমিয়ে আনা হচ্ছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ সালে দেশে চালের আমদানিনির্ভরতার হার ছিল দশমিক শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে দশমিক শতাংশে উঠে যায়। এরপর সেখান থেকে ক্রমে কমতে কমতে ২০২০-২১ অর্থবছরে নেমে আসে দশমিক ৩৫ শতাংশে, যা ক্রমান্বয়ে শূন্যে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে।

যদিও বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, পর্যাপ্ত মজুদ সংরক্ষণের পাশাপাশি বাজার স্থিতিশীল রাখতে চালের আমদানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প দেখতে পাচ্ছে না সরকার। এজন্য নীতিসহায়তাসহ আরো নানাভাবে সুবিধা দেয়া হচ্ছে বেসরকারি আমদানিকারকদের। তাদের চাল আমদানিতে আগ্রহী করতে কয়েক দফায় দেয়া হয়েছে শুল্কছাড়।

বেসরকারিভাবে চাল আমদানিতে গত জুনে প্রথম শুল্কছাড়ের ঘোষণা দেয় সরকার। সময় আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নিয়ে আসা হয়। তবু আমদানির পরিমাণ সন্তোষজনক না হওয়ায় আগস্টে চালের শুল্ক আরো কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বারবার শুল্ক কমানো হলেও বেসরকারি পর্যায়ে এখন লক্ষ্য অনুযায়ী চাল আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না ডলারের বিনিময় হারের ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে।

অবস্থায় সরকার নিজেই চাল আমদানিতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। এজন্য রফতানিকারক দেশের সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে জিটুজি ভিত্তিতে আমদানি বাড়াতে বিভিন্ন স্থানে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠানো হচ্ছে। সেখানে গিয়ে নানা কূটনৈতিক বাণিজ্যিক তত্পরতা চালাচ্ছেন তারা। যদিও এখন পর্যন্ত তাতে খুব সামান্যই সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এবং গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) চাল আমদানি হয়েছে কোটি ডলারের কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মোট চাল আমদানি হয়েছিল কোটি ৫১ লাখ ডলারের। ২০২১-২২- এর পরিমাণ ছিল কোটি ২৭ লাখ ডলার।

চলতি বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) প্রজেকশন অব সাপ্লাই অ্যান্ড ডিমান্ড ফর সিলেক্টেড ফুড ক্রপস ইন বাংলাদেশ বাই ২০৩০ অ্যান্ড ২০৫০ গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২১ সালে দেশে চালের চাহিদা ছিল কোটি ৫২ লাখ টন। স্বাভাবিক পরিস্থিতি অনুযায়ী জোগান ধরা হয় কোটি ৭৫ লাখ টন। ফসল কাটায় ফলনের পার্থক্য বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত পরিস্থিতিতে সেই জোগান নেমে আসে কোটি ৫৬ লাখ টনে। যদিও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে সে বছর চালের জোগান আসে কোটি ৪৬ লাখ টন। অর্থাৎ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ওই বছর ২৩ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা থাকলেও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে উল্টো ছয় লাখ টন ঘাটতি হয়।

প্রসঙ্গে কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের সরকারি সংস্থাগুলোর চালের মজুদ বা চাহিদা সম্পর্কে তথ্য বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা রয়েছে। আবার মাথাপিছু চাহিদার যে হিসাব করা হয়, সেটিও হালনাগাদ নয়। কারণে সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানে অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। যদিও প্রকৃত চিত্র সামনে না থাকলে তা সরকারের জন্যই বড় ধরনের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠতে পারে।

বিএআরসির ওই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক . এসএম ফকরুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বছর বন্যা হয়েছে। সিত্রাং হয়েছে। আমাদের গবেষণায় দেখেছিলাম, প্রতিকূল আবহাওয়ায় এক-দেড় মিলিয়ন টন পর্যন্ত ঘাটতি থাকতে পারে। সাধারণত বিবিএস কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপপ্তর (ডিএই) থেকে পাওয়া তথ্যে -১০ শতাংশ বেশি উৎপাদন দেখানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যেটি আমরা মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছি। তথ্য ঠিক না থাকলে সরকারকে বেকায়দায় পড়তে হয়। কারণে তথ্য ঠিক রাখতে হবে। আবার মাথাপিছু চাহিদার যে হিসাব করা হয়, তা মূলত ২০১৬ সালের। সে হিসেবে এখানেও তথ্য কিছুটা এদিক-সেদিক হবে। তবে বাজার ঠিক রাখার জন্য আমদানি করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন