গ্যাসের স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহ সংকট ও বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে গুরুত্ব দেয় জ্বালানি বিভাগ। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্সকে গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। এতে সফলতাও মিলেছে এরই মধ্যে। গত এক বছরে অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে নয়টি কূপের উত্তোলন শুরু ও বাড়িয়েছে বাপেক্স। এসব কূপে ৮১২ কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে ৭২৩ বিসিএফ (বিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার করেছে সংস্থাটি।
প্রতি ঘনফুটে ৩ টাকা ৪ পয়সার সামান্য বেশি মূল্যের বাপেক্স মার্জিন ধরে এ গ্যাসের দাম দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩৩০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আবার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় তুলনামূলক সুলভে (প্রতি এমএমবিটিইউ ১৪ ডলার হিসাবে) এলএনজি আমদানি মূল্য হিসাব করলে এ পরিমাণ গ্যাসের দাম পড়ে ৯৬ হাজার ৩৬৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আবার স্পট এলএনজির গত বছরের গড় দাম ২৪ দশমিক ৭৫ পয়সা হিসাবে এ পরিমাণ গ্যাসের দাম পড়ে ১ লাখ ৭০ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। বর্তমানে স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ২৯ ডলার ৩৪ সেন্টে ওঠানামা করছে। এ দর অনুযায়ী বাপেক্স আবিষ্কৃত গ্যাসের দাম হিসাব করলে ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
বাপেক্স জানিয়েছে, গত এক বছরে গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে সংস্থাটি মোট নয়টি কূপে কাজ করেছে। এর মধ্যে চারটিতে ওয়ার্কওভার (সংস্কার) এবং চারটি অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়েছে বাপেক্স। এর বাইরেও আরেকটি কূপের উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়েছে সংস্থাটি, বর্তমানে যেটিতে খনন কার্যক্রম পরিচালনা করছে রুশ কোম্পানি গ্যাজপ্রম। এসব কূপে বাপেক্স নতুন করে মোট ৭২৩ দশমিক ৬৫ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার করেছে। এসব কূপের অনেকগুলো দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল।
কূপ খনন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাপেক্সের মালিকানাধীন রিগের সংখ্যা চারটি। খনন ও অনুসন্ধান কার্যক্রমের জন্য রীতিমতো শিডিউল করে রিগগুলো ব্যবহার করতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাপেক্স-সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, এসব রিগের দক্ষ ব্যবহারের পাশাপাশি স্থানীয় গ্যাসের সংকটকে প্রাধান্য দিয়ে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া, ওয়ার্কওভার ও উন্নয়ন কূপগুলোয় দ্রুততম সময়ের মধ্যে খনন এবং উন্নয়ন কার্যক্রম চালানোর কারণেই দ্রুত সফলতা পেয়েছে বাপেক্স।
সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যে পেট্রোবাংলার লক্ষ্য জাতীয় গ্রিডে ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করা। আমরা সে লক্ষ্য নিয়ে এসব কূপ খনন করছি। এরই মধ্যে এসব কূপ ১২০-১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনক্ষম হয়ে উঠেছে। উচ্চমূল্যের কারণে এলএনজি আমদানির পরিবর্তে জ্বালানি বিভাগ বাপেক্সকে যেভাবে কাজে লাগিয়েছে, তাতে আমরা সাফল্য দেখাতে পেরেছি।’
বাপেক্সের গত বছর সংস্কার করা কূপগুলোর একটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সালদা-২। পরিত্যক্ত কূপটি সংস্কারে ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি টাকা। ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে কূপটিতে নতুন করে গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার হয়েছে ৫ দশমিক ২৫ বিসিএফ। দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানির অর্থ হিসাব করলে এ পরিমাণ গ্যাসের দাম দাঁড়ায় ৬৯৮ কোটি টাকা। এছাড়া সিলেট-৮ কূপে ৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগে ওয়ার্কওভার করে ৩২ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার হয়েছে, যার দাম ৪ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা।
কৈলাসটিলা-৭ কূপে ৬০ কোটি টাকার ওয়ার্কওভার করে ৪০ বিসিএফ গ্যাস পেয়েছে বাপেক্স, যার আনুমানিক দাম ৫ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। বিয়ানীবাজার-১ কূপে ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কারের মাধ্যমে মিলেছে ৮ হাজার ১১৩ কোটি টাকার গ্যাস।
মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে ওঠায় গত বছর স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয় জ্বালানি বিভাগ। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানির পাশাপাশি স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিতেও জোর দেয়া হয়। বাপেক্সকে কাজে লাগিয়ে আরো আগে থেকেই অনুসন্ধান, খনন ও সংস্কার কার্যক্রম চালানো হলে দেশে চলমান জ্বালানি সংকটের তীব্রতা অনেক কম হতো বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, বাপেক্সকে এতদিন বসিয়ে রেখে সংস্থাটির ওপর সাংঘাতিকভাবে অবহেলা করা হয়েছে। বাপেক্স এখন স্থলভাগে কাজ করবে। সংস্থাটিকে এ অনুযায়ী আর্থিক সহায়তা দেয়া গেলে আরো ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। ব্যবসায়ীরা এখন যে পরিমাণ গ্যাস আমদানি বাড়ানোর দাবি তুলেছেন, পেট্রোবাংলার আমদানি ছাড়া বাপেক্সের মাধ্যমে যদি স্থানীয়ভাবেই সেই পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যায়, তাহলে এ খাতে সরকারের আর্থিক চাপও অনেকটাই কমে যাবে।
শাহজাদপুর ইস্ট-১ অনুসন্ধান কূপ খননে ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৬ দশমিক ৮৯ বিসিএফ গ্যাস আবিষ্কার করেছে বাপেক্স, যার দাম ৪ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে টবগী-১ অনুসন্ধান কূপে মিলেছে ২৩৯ বিসিএফ গ্যাস, যার দাম ৩১ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ভোলা নর্থ-২ কূপে ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে মিলেছে ১৯১ বিসিএফ গ্যাস। এ গ্যাসের আনুমানিক দাম ২৫ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা।
কুমিল্লার শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্রের শ্রীকাইল নর্থ-১-এ মিলেছে ৪৫ দশমিক ৫ বিসিএফ গ্যাস, যার দাম ৬ হাজার ৫২ কোটি টাকা। এছাড়া শরীয়তপুরে বাপেক্স এখন একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করছে। ১০২ কোটি টাকা ব্যয়ে খননকাজ চলা এ কূপে ৭৩ বিসিএফ গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ আবিষ্কার করেছে বাপেক্স, যার আনুমানিক দাম ৯ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা।
স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমায় পেট্রোবাংলা ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি করছে। স্থানীয় সরবরাহের সঙ্গে দৈনিক ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি যুক্ত হলেও গত বছরের মাঝামাঝি থেকে সরবরাহ কমে গিয়েছে। উচ্চমূল্যের কারণে জ্বালানি বিভাগের স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি সংগ্রহ বন্ধ রয়েছে জুলাই থেকে। জাতীয় গ্রিডে গত বছর এলএনজির দৈনিক গড় সরবরাহ ছিল ৪০০-৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট।
পেট্রোবাংলার সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন ও অন্যান্য সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, গত চার অর্থবছর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। জাতীয় গ্রিডে সরবরাহকৃত মোট গ্যাসের ২৫ শতাংশ সরবরাহ হয় আমদানীকৃত এলএনজির মাধ্যমে।
অন্যদিকে, একই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি-তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে একই সময়ে কূপ খনন ও জরিপে দেয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ১ হাজার কোটি টাকার মতো। গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম স্থবির রেখে এলএনজি আমদানি বাবদ বিপুল অর্থসংস্থান করতে গিয়ে অর্থ সংকটে পড়েছে পেট্রোবাংলা। বিশ্ববাজার থেকে এলএনজি আমদানির কোনো উৎস না পেয়ে স্থানীয় কোম্পানি বাপেক্সকে কাজে লাগানোর এ পরিকল্পনা ইতিবাচক ছিল বলে মনে করেন জ্বালানি-সংশ্লিষ্টরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগেই বলেছি, দেশে গ্যাস সরবরাহে স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানের কোনো বিকল্প নেই। স্থানীয় কোম্পানি বাপেক্সকে কাজে লাগাতে পারলে তার ফলাফলও মিলবে। বাপেক্সকে বসিয়ে রেখে বিদেশী কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয়েছে। সক্ষমতা নেই এমন কথা বলে বারবার সংস্থাটিকে অকেজো করা হয়েছে। অথচ বাপেক্স এক বছরে যে সাফল্য দেখিয়েছে তা বিরাট। কম অর্থ ব্যয় করে এ গ্যাস আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। পার্বত্য অঞ্চলসহ দক্ষিণ অঞ্চলে আরো ব্যাপক আকারে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।’
পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের গ্যাসকূপ খননে গত পাঁচ বছরে বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগ হয়নি। এ পাঁচ বছরে বাপেক্সের মাধ্যমে কূপ খননে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়নি।
বাপেক্সের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, দেশের গ্যাসকূপ অনুসন্ধানে ২০১৭ সালে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বাপেক্স। রূপকল্প-৫ প্রকল্পের আওতায় দুটি অনুসন্ধান কূপ খননের উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। শ্রীকাইল নর্থ-১ ও মোবারকপুর সাউথইস্ট-১ দুটি কূপ খননে সংস্থাটি ১৬৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। একই বছর রূপকল্প-৯ টুডি সিসমিক প্রকল্প গ্রহণ করে। এটিও মূলত গ্যাস অনুসন্ধানের প্রাথমিক জরিপ। এ প্রকল্পে সংস্থাটি ১০৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে।
এর বাইরে গত বছরের ৯ আগস্ট সিলেটের জকিগঞ্জে একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে বাপেক্স। এ প্রকল্পে বাপেক্সের খরচ হয় ৭৮ কোটি টাকা। ২০১৭ সাল থেকে নেয়া বাপেক্সে বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোয় মোট ব্যয় ধরা হয় ৩৪৬ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পসহ গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের (জিডিএফ) অর্থ ব্যবহার করে বাপেক্স ২০১২ সাল থেকে ২০টি প্রকল্পের কাজ করেছে। এসব প্রকল্পে বাপেক্স ৩ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি বিনিয়োগ করেছে। মূলত নতুন কূপ খনন, সিসমিক সার্ভে, কূপ সংস্কারের মতো প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের অনেকটাই এরই মধ্যে শেষ হয়েছে, আবার অনেক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এসব প্রকল্প বিশ্লেষণ করে বাপেক্সের সফলতাই বেশি দেখা গেছে। তবে সংস্থাটির কর্মদক্ষতা অনুযায়ী সে হারে বিনিয়োগ করা যায়নি।