পাঠাভ্যাস

বই, সে তো অনন্ত যৌবনা...

আহমেদ দীন রুমি

বই পড়ায় মনোযোগ দেয়া মানে নিরবচ্ছিন্নভাবে এক জগতে ডুবে থাকা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

শেখার অভ্যাস থামিয়ে দেয়ার মানে বৃদ্ধ হতে শুরু করা। প্রতিটি বই আমাকে নতুন কিছু অবহিত করে। আশপাশের ঘটনাগুলো দেখতে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। আমি ভাগ্যবান, আমার বাবা-মা সব সময় বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। পড়ার অভ্যাস জগৎ সম্পর্কে কৌতূহল বৃদ্ধি করে। সেই কৌতূহলটাই আমার ক্যারিয়ারে এতদূর আসতে সাহায্য করেছে। সাহায্য করেছে আমি এখন যা করি, তাতে।

মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলেছিলেন কথাটি। প্রযুক্তি আর ব্যবসায়িক দুনিয়ার বাইরে পড়ুয়া হিসেবে খ্যাতি রয়েছে তার। ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে বইয়ের সংগ্রহ বিপুল। নিয়মিত রিভিউ লেখেন গেটস নোটস ব্লগে। বস্তুত কেবল তিনিই নন, সফল মানুষের অভ্যাসে বই পড়া যেন মৌলিক শর্ত। দিনে - ঘণ্টা পড়াশোনায় ব্যয় করেন ওয়ারেন বাফেট। বিলিয়নেয়ার মার্ক কিউবান পড়ার জন্য প্রতিদিন আলাদা করে রাখেন ঘণ্টা। ২০১৫ সালে সপ্তাহে একটি বই পড়ার কথা জানিয়েছিলেন মার্ক জাকারবার্গ। স্পেসএক্স দিয়ে মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন দেখানোর আগে ইলোন মাস্ক প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা পার করতেন সায়েন্স ফিকশন পড়ে। চলচ্চিত্র জগতে ওয়াল্ট ডিজনি থেকে বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচের মতো অনেকেই বইপোকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত মানুষের উদাহরণ আরো বেশি। সে প্রাচীন গ্রিসের জেনোফোনের প্রসঙ্গ আসুক কিংবা বিশ শতকের বোর্হেস। কাফকার গল্প পড়েই লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন মার্কেস। জে কে রাউলিং তার হ্যারি পটার সৃষ্টির অনুপ্রেরণা পেয়েছেন জে আর আর টোলকিনের পৌরাণিক জগতে। হাল আমলের জনপ্রিয় লেখক স্টিফেন কিং সোজাসুজিই বলেছেন, যে পড়ার সময় পায় না, সে লেখার সময়ও পাবে না ভালো লেখক হওয়ার সহজ রাস্তা বাতলে দিয়েছেন চতুর্দশ শতকের পণ্ডিত ইবনে খালদুন। পরামর্শ একটাই, ভালো বই পড়া

জীবন বাস্তবিক অর্থেই রণক্ষেত্র। আর কোনো রণাঙ্গনই পরাজিতদের মেনে নেয় না। জয়কে অপরিহার্য করে তুলতে মানুষের জীবনযুদ্ধে যেসব গুণের প্রয়োজন, সেগুলো অর্জনের শ্রেষ্ঠ মৌসুম ছাত্রজীবন। প্রস্তুতি কেবল ক্লাস আর একাডেমিক পুস্তকে সীমাবদ্ধ নয়। বিস্তীর্ণ এক জগৎ পড়ে থাকে সিলেবাসের বাইরে। সেই দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত করে দিতে পাঞ্জেরি হয়ে এগিয়ে আসে বই। অবশ্যই বই পাঠের অভ্যাস একাডেমিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বিশেষজ্ঞদের রচনাবলি পাঠে অভ্যস্ত ছাত্রের শব্দভাণ্ডার অন্যদের চেয়ে সমৃদ্ধ। তার বাক্য গঠন পরিণত, আকর্ষণীয় প্রাঞ্জল। পার্থক্য যেকোনো শিক্ষকের সামনে খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। তবে বই পাঠের চাইতেও বড় অবদান ব্যক্তির মনোযোগ বৃদ্ধিতে। বইতে মনোযোগ দেয়ার মানে নিরবচ্ছিন্নভাবে একটা জগতে ডুবে থাকা। মস্তিষ্ককে নির্দিষ্ট বিষয়ে নিবদ্ধ রাখার চর্চা ধ্যানের চাইতে কোনো অংশে কম নয়। অভ্যাস পরবর্তী সময়ে প্রয়োগ করা যায় একাডেমিক ক্ষেত্রে। পড়া তখন হয়ে ওঠে উদযাপনের মতো। আবার যেহেতু প্রতিটি বইই বিপুলসংখ্যক তথ্য চরিত্র নিয়ে সৃষ্ট, পাঠকের ওপর তাদের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব রয়েছে। ফলে প্রায়ই অনুপ্রাণিত করে কোনো বই বা বইয়ের কোনো অংশ। বইয়ের প্রিয় উক্তি, চরিত্র আচরণ মনে রাখতে চায় পাঠক। এতে করে একদিকে যেমন স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে উন্নত হয় প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে প্রয়োগের মাত্রা। সফল ব্যক্তিদের আত্মজীবনী জীবনী কাজ করে অনুপ্রেরণা হিসেবে। বাড়িয়ে দেয় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তৃষ্ণা। সেই তৃষ্ণা কাজ করে প্রাতিষ্ঠানিক সফলতার পেছনে অনুঘটক হিসেবে।

কার্লোস রুইস সাফোনের বিখ্যাত উপন্যাস দ্য শ্যাডো অব দ্য উইন্ড সেখানে মা হারা দানিয়েলের শোক ভোলাতেই বাবা তাকে পরিচয় করিয়ে দেন পাঠাগারের সঙ্গে। যে সে পাঠাগার নয়, প্রাচীন আর দুষ্প্রাপ্য সব বইয়ের সংগ্রহশালা। সেদিকে ইঙ্গিত করে তার পিতা মন্তব্য করেন, প্রতিটি বইয়েরই আত্মা আছে। যে লিখেছে, যে পড়েছে এবং যে বইটি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, সবার আত্মা। আক্ষরিক অর্থেই কথাটা সত্য। কোনো লেখকের সর্বোত্কৃষ্ট চিন্তাটিই বই হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর পাঠকের সঙ্গে তৈরি করে স্মৃতির সম্পর্ক। তার মাধ্যমে নিজের স্বপ্ন বুনতে শেখে পাঠক। আস্বাদন করতে পারে নানামুখী জ্ঞানের স্বাদ। বইয়ের পাতায় জীবন জগতের অবিরাম নৃত্য তার রুচিবোধকে উন্নত করে। মানুষের প্রতি উদার হতে শেখায়। শেখায় অন্যের কষ্টে ব্যথিত সুখে তৃপ্ত থাকতে। যেন এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা। ব্যক্তি উত্তীর্ণ হয় সব সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে। বই কখনো নিয়ে যায় সদূর অতীতে আবার কখনো ভবিষ্যতে। পাঠকের সামনে বসে কথা বলে মহাকালের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা। স্থানিক কালিক বাধা অতিক্রম করে পাঠক লাভ করে অজস্র জীবনের ঘ্রাণ। যেখানে বই না পড়া ব্যক্তির জীবন শুধু একটাই। বইয়ের প্রভাব বিবেচনা করেই সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা হিসেবে রিডিং ওয়েল নামে বই পাঠের প্রোগ্রাম চালু করেছে। সেখানে রোগীদের চিকিৎসায় আত্মোন্নয়নমূলক বই পড়াকে রাখা হয় প্রেসক্রিপশনে। থেরাপি হিসেবে বইয়ের ব্যবহার পরিচিত বিবলিওথেরাপি নামে। তবে বই পাঠের সবচেয়ে দৃশ্যমান উপকারিতা দীর্ঘায়ু অর্জন। ইনোভেশন ইন এইজিং জার্নালে ২০১৭ সালে দ্য সারভাইভাল অ্যাডভান্টেজ অব রিডিং বুকস শিরোনামে গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে চালানো গবেষণায় দেখানো হয়, বই পড়া ব্যক্তি বই না পড়া ব্যক্তির চেয়ে গড়ে দুই বছর বেশি বাঁচে। প্রতিদিন ৩০ মিনিট বই পাঠে অভ্যস্ত ব্যক্তি অন্য মানুষের চেয়ে দীর্ঘজীবী। শেষ বয়সে মস্তিষ্কের সক্ষমতা হ্রাস পাওয়া বা স্মৃতিভ্রংশের মতো রোগের আশঙ্কা থেকে বের হওয়ার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ একটা পথ বই পাঠ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা লুফে নিতে পারে বই পাঠের সুযোগ। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাগারগুলোয় বইয়ের সংগ্রহ নেহাত কম নয়। তার বাইরে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের অধীনে প্রতিটি জেলায় রয়েছে গ্রন্থাগার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেসরকারি ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে লাইব্রেরি। তৈরি হয়েছে নিজেকে সমৃদ্ধ করে নেয়ার সুযোগ। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা চাইলে আগ্রহী বন্ধুদের নিয়ে পাঠচক্র গড়ে তুলতে পারেন। যুক্ত হতে পারেন পড়ালেখাভিত্তিক সংগঠনে। এতে একদিকে ইতিহাস, দর্শন, সমাজনীতি, রাজনীতি অর্থনীতি সম্পর্কে শক্ত অবস্থান তৈরি হবে। অন্যদিকে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে বাড়বে বিশ্লেষণী ক্ষমতা। যা পরবর্তী সময়ে সফল ক্যারিয়ার তৈরিতে প্রভাব রাখবে। বই পড়ার সবচেয়ে ভালো ফলাফল পেতে হলে সবার আগে উচিত প্রিয় বইগুলোকে নিয়ে তালিকা তৈরি করা। তারপর প্রতিদিন অল্প সময় হলেও পাঠের জন্য বরাদ্দ রাখা। পড়ার পর তা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা প্রতিক্রিয়া লিখে রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে দুর্দান্ত। বিল গেটস এটাই করেন। মনে রাখা দরকার, একটা বই ঠিক তখনই পড়া হয়েছে বলে দাবি করা যাবে, যখন পাঠক বইটির মূল বক্তব্যকে বিভিন্ন দিক থেকে নিজের মতো করে উপস্থাপন করতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন