আরো দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল চুক্তির পথে পেট্রোবাংলা

প্রয়োজন না থাকলেও তৎপর এক্সিলারেট-সামিট

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট সক্ষমতার দুটি ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) বা ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। আমদানি সংকটের কারণে এরই মধ্যে টার্মিনাল দুটির সরবরাহ সক্ষমতা নেমেছে ৫০ শতাংশের নিচে। পরিস্থিতির মধ্যে আরো দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তি করতে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা। গ্যাস সংকটে ধরনের অবকাঠামোর প্রয়োজন না থাকলেও টার্মিনাল নির্মাণে তৎপর হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জি এবং খাতের স্থানীয় কোম্পানি সামিট গ্রুপ।

জ্বালানি বিভাগের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, এক্সিলারেট এনার্জি পটুয়াখালীর পায়রায় এবং সামিট কক্সবাজারের মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে আগ্রহ দেখিয়েছে। এরই মধ্যে টার্মিনাল নির্মাণে আর্থিক বাণিজ্যিক বিষয়গুলো নিয়ে দরকষাকষি চলছে পেট্রোবাংলার সঙ্গে। টার্মিনাল নির্মাণে শর্ত, অর্থনৈতিক দিক এবং চুক্তির নানা বিষয় বিশ্লেষণ চলছে। এরপর একটা পর্যায়ে পৌঁছালে নির্মাণ চুক্তির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

পেট্রোবাংলার পরিচালক প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) বণিক বার্তাকে বলেন, পায়রায় এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়টি এখন নেগোসিয়েশন পর্যায়ে। টার্মিনাল নির্মাণে বিভিন্ন শর্তের বিষয় নিয়ে পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। বিশেষ করে আর্থিক বাণিজ্যিক বিষয়গুলো কী রকম হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এটি একটি লম্বা প্রক্রিয়া, কত দ্রুত এগোনো যায় সেটি নিয়েও কাজ চলছে।

বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি সরবরাহে এক্সিলারেট এনার্জি কাজ শুরু করেছে। পটুয়াখালীর পায়রায় টার্মিনাল নির্মাণের জন্য সরকারের সঙ্গে বাণিজ্যিক দরকষাকষি শুরু করেছে। এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে পায়রা থেকে খুলনা পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইনও নির্মাণ করতে চায় কোম্পানিটি।

এদিকে বিদ্যমান এলএনজি টার্মিনালে যখন গ্যাস সরবরাহ সংকট চলছে তখন বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ধরনের পদক্ষেপকে আর্থিক ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, গ্যাস সরবরাহ না থাকলেও চুক্তি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে টার্মিনাল ভাড়া, রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ সক্ষমতার অব্যবহূত চার্জ দিতে হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ না বাড়লে টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তি অনুযায়ী খরচ পেট্রোবাংলাকে ২০৩২-৩৩ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান দুটি কোম্পানিকে দিতে হবে।

এক্সিলারেট এনার্জি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের নিবন্ধিত একটি কোম্পানি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোম্পানিটির এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, ভাড়া, গ্যাস বিদ্যুতের ব্যবসা রয়েছে। বাংলাদেশে শুধু এলএনজি টার্মিনালের ব্যবসা রয়েছে মার্কিন কোম্পানির। নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য থেকে জানা গেছে, এলএনজি টার্মিনাল ব্যবসায় কোম্পানিটি বাংলাদেশ থেকে গত তিন বছরে ফিক্সড কস্ট (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) পেয়েছে ২৫ কোটি ৯৬ লাখ ৪৯ হাজার ডলার। এর মধ্যে ২০২২ সালে কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার আয় করেছে। অর্থ কোম্পানিটি এলএনজি টার্মিনাল ভাড়া, রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ, টিসিপি এবং অন্যান্য উৎস (ফিক্সড কস্ট) হিসেবে পেয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে একই সময়ে ফিক্সড কস্ট পেয়েছে কোটি ৫৭ লাখ ৮৯ হাজার ডলার। ২০২০ সালে পেয়েছে কোটি ৮১ লাখ ৯০ হাজার ডলার।

বছরের তিন প্রান্তিকের হিসাব পর্যবেক্ষণ করলে টার্মিনাল ভাড়া, রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ, টিসিপি অন্যান্য খরচ বাবদ বছরে অন্তত সাড়ে ১১ কোটি ডলার আয় করেছে কোম্পানি। এই অর্থ প্রতি বছর পরিশোধ করতে হয়েছে পেট্রোবাংলাকে।

মহেশখালীতে ৫০০ এমএমসিএফডি সরবরাহ সক্ষমতার এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। সামিট এলএনজি টার্মিনাল কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেড নামে টার্মিনালের মালিকানায় রয়েছে সামিট গ্রুপ। এক্সিলারেট এনার্জির মতোই টার্মিনালের নির্মাণ প্রযুক্তি, সক্ষমতা, ধারণক্ষমতা এবং চুক্তির ধরন। সেই হিসেবে সামিটের টার্মিনাল লিজ, রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ, টিসিপি অন্যান্য খরচও এক্সিলারেটের সমপরিমাণ বলে জানা গেছে।

পেট্রোবাংলা-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, টার্মিনাল ভাড়া, রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ, টিসিপি অন্যান্য খরচ বাবদ সামিটকেও তিন বছরে প্রায় ২৪ কোটি লাখ ৩০ হাজার ডলার দেয়া হয়েছে।

এলএনজি টার্মিনাল ব্যবহারে পুরো সক্ষমতা ব্যবহার হোক কিংবা বসে থাকদুটি কোম্পানিকে পরিমাণ খরচ দিতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে। ধরনের ফিক্সড কস্ট বাড়তি চাপ তৈরি করছে সংস্থাটির ওপর। পরিস্থিতির মধ্যে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ এবং গ্যাসের জোগান নিশ্চিত না হয়ে ধরনের চুক্তি জ্বালানি খাতে আর্থিক ঝুঁকি আরো বাড়াবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক . তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানি নিশ্চয়তা ছাড়া টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তি আর্থিক ক্ষতি বাড়াবে। আগামীতে গ্যাসের চাহিদা বাড়বে এবং সরবরাহ বাড়ানো হবে এমন পরিকল্পনা থেকে টার্মিনাল নির্মাণে এসব চুক্তি হচ্ছে। তবে বর্তমান গ্যাস সংকট পরিস্থিতির কথা চিন্তা করলে এটি বেশ চ্যালেঞ্জিং। যদিও স্থানীয় গ্যাসের পাশাপাশি আমদানি করতে হলে ধরনের অবকাঠামো দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ।

দেশে মুহূর্তে গ্যাসের সংকট প্রকট। চাহিদা সরবরাহে দৈনিক অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয় উৎস থেকে পর্যাপ্ত গ্যাসের জোগান বাড়ছে না, উচ্চমূল্যের কারণে আমদানি করা যাচ্ছে না স্পট এলএনজি। দীর্ঘমেয়াদি উৎস থেকেও বাড়তি এলএনজি পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ কতটুকু যৌক্তিক আর্থিক সুবিধা দেবে তা নিয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু জানাতে পারেননি পেট্রোবাংলা-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। যদিও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের দাবি, ২০২৫ সালের পর কাতার থেকে বাড়তি এলএনজি পাওয়া যাবে। ব্রুনাই থেকে এলএনজি আমদানির চেষ্টা চলছে। ফলে এসব উৎস থেকে এলএনজি পাওয়া গেলে অবকাঠামোর প্রয়োজন পড়বে। তার প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে।

এদিকে উচ্চমূল্যের কারণে বাংলাদেশসহ এশিয়ার বৃহৎ এলএনজি আমদানিকারক চীন, ভারতের মতো দেশেও এলএনজি অবকাঠামো বসে থাকছে। সেই পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে এশিয়ায় এলএনজি অবকাঠামো অব্যবহূত থাকার দিক থেকে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।

জ্বালানির আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) বলছে, উচ্চমূল্যের কারণে এলএনজি অবকাঠামো ব্যবহারে এশিয়ার সবচেয়ে নিম্ন স্থানে বাংলাদেশ। সংস্থাটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক তথ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আইএইচএস মার্কিটে ২০২২ সালের প্রকাশিত তৃতীয় প্রান্তিকে এলএনজি অবকাঠামো ব্যবহারের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে চীন, ভারত, পাকিস্তান বাংলাদেশের ২০২১ ২০২২ সালের এলএনজি টার্মিনাল ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরা হয়। তাতে দেখা গেছে, গত বছরের চেয়ে চলতি বছরে বাংলাদেশ এলএনজি টার্মিনাল সক্ষমতার ৫০ শতাংশই ব্যবহার করতে পারেনি।

প্রসঙ্গত, মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি করে এক্সিলারেট এনার্জি। নির্মাণ শেষে ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট গ্যাস সরবরাহ শুরু করে কোম্পানিটি। ১৫ বছর মেয়াদি টার্মিনাল দিয়ে গ্যাস সরবরাহের চুক্তি রয়েছে ২০৩২ সাল পর্যন্ত। তবে এক্সিলারেট এনার্জি সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে টার্মিনাল চুক্তির মেয়াদ ২০৩৮ সাল পর্যন্ত বাড়িয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এলএনজি টার্মিনালের মেয়াদ বাড়ানোর অনুমোদনও দেয়া হয়েছে।

একই প্রযুক্তি মেনে মহেশখালীতে ভাসমান স্থানীয় জ্বালানি খাতের কোম্পানি সামিট গ্রুপ এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল চুক্তি সই করে। এরপর ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল গ্যাস সরবরাহ শুরু করে কোম্পানিটি। টার্মিনালের মেয়াদ রয়েছে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত।

দুটি টার্মিনাল মেয়াদ শেষে কোনো ধরনের চার্জ গ্রহণ ব্যতীত পেট্রোবাংলার কাছে হস্তান্তর করবে বলে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস লিমিটেড (আরপিজিসিএল) সূত্রে জানা গেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন