একাডেমিক বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বহুমাত্রিক

উদার ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি নানা চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হয় আইআর শিক্ষার্থীরা ছবি: মাশফিকুর সোহান

বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান আর জীবনযাপনের নানা ধরন মানুষকে করেছে বহুধাবিভক্ত। আবার রাজনৈতিক পরিচয় মানুষের জাতিসত্তাকে দিয়েছে এক ভিন্নমাত্রা। নাগরিক হিসেবেই মানুষের পরিচিতি এখন বেশি। আর নাগরিকরা বসবাস করে পৃথিবীর প্রায় ২০০টি সার্বভৌম রাষ্ট্রে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (আইআর) মূলত সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার সম্পর্কেরই অধ্যয়ন। তবে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসে অরাষ্ট্রীয় নানা ব্যক্তি, সংগঠন, গোষ্ঠী আর জাতিসত্তার কথা। রাজনৈতিক, সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিকসহ নানা আঙ্গিকের আলোচনায় জাতিতে জাতিতে সম্পর্কের উন্মোচন হয় আইআরে।

একাডেমিক বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যাত্রা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরই। বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা ভাবিয়েছিল রাজনীতিবিদ, পণ্ডিত আর সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে সবাইকে। যুদ্ধ-সংঘাত এড়িয়ে একটি শান্তির পৃথিবী গড়ার আদর্শবাদী চিন্তা থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির গভীর অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন অনেকেই। আটলান্টিকের দুই পারে ইউরোপ আমেরিকায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চর্চা এগিয়ে চলে সমানতালে। সে হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জ্ঞানতাত্ত্বিকতায় পশ্চিমের প্রভাব স্পষ্ট। পশ্চিমা জ্ঞানের বিশ্বায়নের একটা পর্যায়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কও পৌঁছে যায় প্রাচ্যের নানা দেশে। 

একাডেমিক বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বৈশ্বিক চাহিদা গ্রহণযোগ্যতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের প্রভাবে দেশে দেশে, মানুষে মানুষে যোগাযোগ অনেক বেড়েছে। এর মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পেরেছে যে জাতিগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ছাড়া বিশ্বায়নের সুফলকে কাজে লাগানো কুফলকে এড়িয়ে চলাএর কোনোটিই সম্ভব নয়। প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বলে অনুধাবন করা যায়। জ্ঞানের শাখায় যেমন আলোচনা চলে কূটনীতির নানা দিক নিয়ে, তেমনি সামরিক কৌশলগত বিদ্যাও পায় সমান গুরুত্ব। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের রাজনৈতিক দিকটি ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে। আবার আন্তঃরাষ্ট্রীয় আলোচনায় মানবাধিকারসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক; বিশেষত বৈশ্বিক অভিবাসন শরণার্থী পরিস্থিতি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রায়ই। তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একাডেমিক আলোচনায় বিষয়গুলো উঠে আসে প্রতিনিয়ত। নানা তত্ত্ব আর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সহায়তায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রছাত্রীরা সমসাময়িক বিষয়াবলিকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বোঝার ব্যাখ্যার চেষ্টা করে। প্রচলিত উদার বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি তারা মার্ক্সবাদী, ক্রিটিক্যাল, উত্তর-আধুনিকতাবাদী নারীবাদী চিন্তাধারার সঙ্গেও পরিচিত হয় গভীরভাবে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রছাত্রীদের কাজের ক্ষেত্র অনেক। কূটনৈতিক মিশন, সামরিক বাহিনী, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বহুজাতিক করপোরেট, আন্তর্জাতিক মিডিয়াসহ সরকারি-বেসরকারি নানা চাকরিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে উন্নত উন্নয়নশীল বিশ্বের বাস্তবতার পার্থক্যের নিরিখে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কাজের ক্ষেত্র খুঁজে নেয়ার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় কূটনৈতিক জ্ঞানে সমৃদ্ধতর ছাত্র বা ছাত্রী কূটনীতিক হওয়ার প্রতিযোগিতায় সর্বাধিকার নাও পেতে পারে নিয়োগ পদ্ধতির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে। আবার সেই একই কারণে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) অনেক ক্যাডারে চাকরি পাওয়ার সমান সুযোগ রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থীদের। তবে এক্ষেত্রে বিসিএস পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের জন্য কিছুটা বাড়তি স্বস্তিদায়ক বলে বিবেচিত হতে পারে।

বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী হাইকমিশন দূতাবাসগুলোয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিশেষ চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে বিভাগের স্নাতকদের। এছাড়া বাংলাদেশে কর্মরত বৈদেশিক অনেক সংস্থা তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছে তারা।

একুশ শতকের বিশ্ব-নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একাডেমিক বিষয় হিসেবে বেছে নেয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে বিষয় পাঠের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো, একজন ছাত্র বা ছাত্রী কতটা বিষয়বস্তুকে আত্মস্থ করতে পারছে, বিষয়ের জ্ঞান তাকে কতটা চিন্তার খোরাক জোগাচ্ছে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।

 

মো. রাশেদুল ইসলাম রাসেল

সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন