২০২৩ সালে বিদ্যুতের ব্যয়ের বোঝা বইতে পারবে কি বিপিডিবি

মেহেদী হাসান রাহাত ও আবু তাহের

বিদ্যুৎ উৎপাদন বাবদ গত অর্থবছরে (২০২১-২২) বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ব্যয় বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। বর্ধিত ব্যয়ের ৯৬ শতাংশই হয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র (আইপিপি) থেকে বিদ্যুৎ কেনায়। সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ স্ফীত হচ্ছে প্রতি বছরই। এরই মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে বিপিডিবির বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

বিপিডিবির পুঞ্জীভূত লোকসান বেড়ে চলার পেছনে প্রধানত সংস্থাটির আইপিপি-নির্ভরতাকেই দায়ী করা হচ্ছে বেশি। এর মধ্যেই আবার আগামী বছর নতুন ২৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসতে যাচ্ছে, যার ১৩টিই আইপিপি বলে জানিয়েছে বিপিডিবি। আগামী মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে যাওয়া এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে বিপিডিবির ব্যয় বহুলাংশে বাড়বে। টানা লোকসানে থাকা সংস্থাটির পক্ষে আগামী বছর বাড়তি ব্যয়ের বোঝা বিপিডিবির বহন করা সম্ভব হবে কিনা, সে বিষয় নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।

তারা বলছেন, টানা লোকসানের বোঝা বইতে বইতে বিপিডিবির আর্থিক সক্ষমতা দিনে দিনে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে উঠেছে। সরকারের কাছ থেকে বড় অংকের ভর্তুকি নিয়ে চলতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। গত অর্থবছরেও সরকারের কাছ থেকে ২৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকার ভর্তুকি নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গোটা বিশ্বই এখন আর্থিক দিক থেকে দুর্যোগময় পরিস্থিতি পার করছে। অবস্থায় বিপিডিবির পক্ষে বাড়তি ব্যয়ের বোঝা আদতে কতটা টানা সম্ভব, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

বিপিডিবির তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ সংস্থাটির ব্যয় হয়েছে ৭৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছিল ৫১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির বিদু্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বেড়েছে ২২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় আগের অর্থবছরের হাজার ৭৪৩ কোটি ৮৮ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে হাজার ১৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ব্যয় হয়েছে ৪৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকা, যেখানে আগের অর্থবছরে বাবদ ব্যয় হয়েছিল ২৭ হাজার ৭৩৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। সে হিসেবে গত অর্থবছরে আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কেনায় বিপিডিবির ব্যয় বেড়েছে ৭৭ শতাংশ বা ২১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা।

রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গত অর্থবছরে হাজার ৭৮৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে বিপিডিবি। আগের অর্থবছরে বাবদ ব্যয় হয়েছিল হাজার ৩২৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা। বিপিডিবির সাবসিডিয়ারি নয়, এমন সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার ব্যয় আগের অর্থবছরের হাজার ৯১৭ কোটি লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে হাজার ১৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যয় হাজার ৭১২ কোটি ৯১ লাখ থেকে কমে হয়েছে হাজার ৬৭৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেট সহায়তার সুদ বাবদ হাজার ২৯৪ কোটি ৮০ লাখ বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিলের সঞ্চিতি বাবদ হাজার ২২৪ কোটি লাখ টাকা ব্যয় করেছে বিপিডিবি, যেখানে আগের অর্থবছরে দুই খাতে ব্যয় হয়েছিল যথাক্রমে হাজার ২৯৪ কোটি ৮০ লাখ হাজার ১৪৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

প্রতি বছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয়কৃত অর্থের অর্ধেকই চলে যাচ্ছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধে। বিশেষ করে বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া, সক্ষমতার অব্যবহূত চার্জ পরিশোধ করতে গিয়ে বিপিডিবির আর্থিক ঘাটতি বছরের পর বছর বেড়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চুক্তির নানাবিধ শর্ত থাকায় বিপিডিবি এখন পথ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাবদ সংস্থাটির ব্যয় হচ্ছে বিদ্যুৎ বিক্রির আয় থেকে বেশি। ফলে সংস্থাটির ক্রমপুঞ্জীভূত লোকসান বাড়ার পাশাপাশি আর্থিক সক্ষমতা কমছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত অর্থবছরে সংস্থাটির বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ব্যয় ৭৪ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ালেও বিক্রি থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা।

তবে সামনের দিনগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাবদ ব্যয় কমতে যাচ্ছে বলে জানালেন বিদ্যুতের নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ব্যয় কমাতে মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে নতুন করে ক্রয় চুক্তিতে না যাওয়ার কথা ভাবছে সরকার। আবার বিদ্যুৎ ক্রয়ের নতুন চুক্তিগুলো করা হচ্ছে নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট ভিত্তিতে। ফলে এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ আর থাকছে না। এখানে খরচ কমে আসছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের সিস্টেম লস, কার্যকারিতা কম এমন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়াসহ নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো হচ্ছে।

একই কথা বলছেন বিপিডিবির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (প্রাইভেট জেনারেশন, আইপিপি/পিপিপি) এবিএম জিয়াউল হকও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে অতিরিক্ত ব্যয় কমাতে বিপিডিবি মেয়াদোত্তীর্ণ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে গিয়েছে সরকার, যেখানে সক্ষমতার চার্জ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো থাকবে না। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে অতিরিক্ত ব্যয় কমাতে আগামী বছরের জুনের মধ্যে ডিজেলভিত্তিক আটটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এভাবেই মূলত বিপিডিবির ব্যয় কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ে বিপুল অংকের আর্থিক ঘাটতির মধ্যে আগামী বছর উৎপাদনে যুক্ত হচ্ছে আরো হাজার ১০১ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে সরকারি খাতে হাজার ৩৮২ মেগাওয়াট, বেসরকারি খাতে হাজার ৯৬৯ যৌথ উদ্যোগে ৭৫০ মেগাওয়াট। এর বাইরে ভারত থেকে আদানি পাওয়ারের দ্বিতীয় ইউনিট অর্থাৎ ৭৪৮ মেগাওয়াট গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে আগামী বছরের মার্চে। সব মিলিয়ে আগামী বছর হাজার ৮৪৮ মেগাওয়াট চলতি বছর উৎপাদনে আসতে না পারা আরো প্রায় হাজার মেগাওয়াট অর্থাৎ মোট হাজার ৮৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। চাহিদা না থাকলে এসব কেন্দ্র বসিয়ে রাখলেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সরকারকে বিপুল অংকের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এতে সামনের বছর সরকারের বিদ্যুৎ খাতের বড় অংকের আর্থিক বোঝা আরো ভারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, এরই মধ্যে বিপিডিবির কাছে তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ পাওনা হিসেবে আটকে রয়েছে। সংস্থাটির লোকসানের বোঝা কমাতে বিপিডিবিকে এখন জ্বালানিসহ সংশ্লিষ্ট খাতগুলোয় সাশ্রয়ের কথা ভাবতে হবে।

বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমানে বিপিডিবির কাছে আইপিপিগুলোর ২০ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। পুরোটা পরিশোধ করা সম্ভব না হলেও এটিকে একটি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা প্রয়োজন। স্পট মার্কেট থেকে কেনা এলএনজি ডিজেল ব্যবহার করে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ অনেক বেশি পড়ে। তার চেয়ে এইচএফও, দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ অর্ধেক। বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোন ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করলে ব্যয় সাশ্রয় হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতে সরকারের ১৬ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় সাশ্রয় হবে।

বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন পরিকল্পনা বিদ্যুৎ ব্যবহারের খাত তৈরি করতে না পারাকে খাতটির বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নানা সুবিধা দিয়ে বিদ্যুৎ খাতের ব্যয় অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সরকারের সব সংস্থা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের মধ্যেও ঘাটতি রয়েছে। এতে সংকটকালে সঠিক নীতি কৌশল বেছে নেয়ার ক্ষেত্রেও দুর্বলতা রয়ে গিয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক . শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে যে ধরনের উন্নয়ন নীতির প্রয়োজন ছিল, তা করা যায়নি। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের স্বার্থকে অন্তর্ভুক্ত করে বিদ্যুৎ খাতের নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণে খাতে কোনো প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি। ফলে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছ থেকে বিপিডিবি প্রতিযোগিতামূলক দামে বিদ্যুৎ কিনতে পারেনি। বিদ্যুৎ ক্রয়ে বৈশ্বিক মান অনুসরণ না করে অবিবেচনাপ্রসূত ব্যয় বাড়িয়ে খাতকে এমন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যার শেষ কোথায় আমরা কেউ জানি না।

বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে উৎপাদনে আসতে যাওয়া ১৩টি আইপিপির মধ্যে ৪১২ মেগাওয়াট সক্ষমতার তিনটি বৃহৎ এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এগুলো হলো সামিট পাওয়ারের মেঘনাঘাটে ৫৮৩ মেগাওয়াট, ইউনিক গ্রুপের মেঘনাঘাটে ৬০০ একই এলাকায় রিলায়েন্স পাওয়ারের ৭৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র। এছাড়া ৪১২ মেগাওয়াট সক্ষমতার আটটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রামে এস আলম গ্রুপের এসএস পাওয়ার প্লান্টের দ্বিতীয় ইউনিটের ৬১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র কক্সবাজারে ৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বায়ুভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন