সংস্থান হচ্ছে না গ্যাসের

পরিকল্পনায় আরো সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

আবু তাহের

চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৪৭৬ মেগাওয়াট। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে প্রায় সাড়ে হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। পরিস্থিতির মধ্যে গ্যাস এবং আমদানি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর ভর করে আরো প্রায় সাড়ে হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনা করেছে সরকার। এরই মধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ হয়েছে সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের। বাকি তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সমীক্ষার কাজ চলমান।

বিদ্যুতের নীতি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেলের ২০২১-২০২২ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যে জানা গিয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো এসব গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে। এছাড়া বিদেশী দাতা সংস্থার সহায়তায় যৌথ বিনিয়োগেও নির্মাণ পরিকল্পনা করা হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্ধেকের বেশি সক্ষমতার জ্বালানি সংস্থান করা যাচ্ছে না। তার মধ্যে গ্যাসকে কেন্দ্র করে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনা অযৌক্তিক। জ্বালানির বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এখনই এসব পরিকল্পনা থেকে সরে আসা জরুরি। ধরনের পরিকল্পনা বিদ্যুৎ খাতকে খাদের কিনারে টেনে নিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বৈশ্বিক জ্বালানির বাজার প্রেক্ষাপট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে সরকারকে এগোনো উচিত। স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানে গতি যৎসামান্য, বিশ্ববাজারেও গ্যাসের উচ্চমূল্য। আগামীতে বাজার কোনদিকে যাবে সেটিও বলা মুশকিল। এছাড়া গ্যাস কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। ফলে সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনা করা উচিত। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে বাণিজ্যিক সুফল পাওয়া না গেলে খাতে ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) মালিকানায় হাজার ৫৭৫ মেগাওয়াট এবং বিপিডিবি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি জিইর (জেনারেল ইলেকট্রিক) সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০২৫ সাল থেকে শুরু করে ২০২৮ সাল নাগাদ উৎপাদনে আসবে।

বিপিডিবির গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনার মধ্যে হরিপুরে ২৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট, নরসিংদীর ঘোড়াশালে একই প্রযুক্তির ২২৫ মেগাওয়াট, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ৫৫০ মেগাওয়াট, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ৫৫০ মেগাওয়াট। বিপিডিবির উদ্যোগে পরিকল্পনাধীন এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে চূড়ান্ত প্রস্তাব তৈরি করে বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো হবে বলে বিপিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

বিপিডিবির গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সবচেয়ে বৃহৎ সক্ষমতা বাস্তবায়ন পরিকল্পনা করা হয়েছে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে। হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এলএনজিভিত্তিক দুটি বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এরই মধ্যে মার্কিন কোম্পানি জিইর সঙ্গে সমঝোতা সই করেছে সংস্থাটি। আগামী ২০২৭ ২০২৮ সালকে সম্ভাব্য উৎপাদন বছর ধরে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনায় স্বাক্ষর করেছে বিপিডিবি।

গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বিপিডিবির পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সংস্থাটি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ৫৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে। নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (নওপাজেকো) হাজার ২০০ মেগাওয়াট করে দুটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। এছাড়া বি-আর পাওয়ার জেন ময়মনসিংহে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।

এর বাইরে যৌথ উদ্যোগে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (সিপিজিসিএল) সঙ্গে জাপানের মিত্সুই অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড ৫৮৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জায়গা নির্ধারণের বিষয়টি জানা না গেলেও এরই মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে জানা গিয়েছে।

বিপিডিবি সূত্রে জানা গিয়েছে, দেশে গ্যাসভিত্তিক প্রায় সাড়ে ১১ হাজার বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে বর্তমানে প্রায় সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো যাচ্ছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৮৫ কোটি ঘনফুটের মতো। সাত হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে। গ্যাসের কারণে বন্ধ থাকা এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জায়গায় চালানো হচ্ছে উচ্চ উৎপাদন খরচের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

বিপিডিবি পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে গ্যাসভিত্তিক প্রায় হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শেষ পর্যায়ে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সংস্থান করা যাচ্ছে না। গ্যাস লাইন নির্মাণ করা হলেও কীভাবে গ্যাস দেয়া যায় তার হিসাবনিকাশ চলছে।

দেশে বর্তমানে গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ২২ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৫১ শতাংশ। গত ১০ বছরে দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ক্রমবর্ধমান হারে গ্যাসের সংকট তৈরি হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে এসব জায়গায় ফার্নেস অয়েল, ডিজেল কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। আগামীতে নির্মাণ পরিকল্পনায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কীভাবে জ্বালানির সংস্থান হবে সে প্রশ্নের উত্তরও নেই বিদ্যুৎ জ্বালানি বিভাগের কাছে।

বিদ্যুতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে অন্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো চ্যালেঞ্জিং। অন্য জ্বালানির তুলনায় গ্যাসই সহজলভ্য এবং তুলনামূলক সাশ্রয়ী। গ্যাসের সংকট রয়েছে, এটা আমরা জানি। তবে বিদ্যুৎ চাহিদা বিবেচনায় জ্বালানি আমদানি করেই আমাদের এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর পরিকল্পনা। এছাড়া যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেগুলোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা হিসাব করলে অনেকগুলো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ওই সময়ে অবসরে যাবে। একই সঙ্গে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এরই মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে। ফলে এগুলো এখন আর বাদ দেয়ার পর্যায়ে নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন