দেশে পোশাক খাতের পর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্প। দ্বিতীয় বৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রার উৎসও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এ খাতের একটি বিশেষ ইতিবাচক দিক হলো এর প্রায় শতভাগ কাঁচামালই দেশীয়। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে জোগান দিতে দেশে ক্রমেই চামড়া খাতকেন্দ্রিক শিল্প-কারখানা বাড়ছে। সম্ভাবনাময় এ খাত ঘিরে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থানও। যদিও প্রসারমাণ খাতটির জন্য দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয়নি পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
দেশে মাত্র দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট)। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বাইরে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে কোনো ধরনের কলেজ কিংবা ইনস্টিটিউটও গড়ে তোলা হয়নি। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) সহকারী অধ্যাপক ওধীর চন্দ্র পালের ভাষ্যে, দেশের অর্থনীতিতে একটি উদীয়মান খাত চামড়া শিল্প। নতুন নতুন কারখানা চালু হচ্ছে। বিনিয়োগ হচ্ছে। আমাদের ফুটওয়্যার ও লেদার প্রডাক্ট বিদেশে রফতানি হচ্ছে। দুটি প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ থাকায় বাজারে চাহিদার তুলনায় এ বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট খুবই কম। বিপরীতে কর্মসংস্থানের বিশাল একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে টিম্বারল্যান্ড, ডিক্যাপলোন, টুপসুড, ইন্টারটেকে চাকরি করছেন। ভবিষ্যতে দেশীয় অর্থনীতির কাঠামো শক্তিশালী করতে এ খাত বড় ভূমিকা রাখবে।
চামড়া শিল্পে রয়েছে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনা। দেশে প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত হয়। বৈশ্বিক চামড়াজাত পণ্যের ১০ শতাংশ চাহিদার জোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম ফুটওয়্যার উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ। খাতটিতে প্রায় নয় লাখ লোকের কর্মসংস্থান। দেশে বর্তমানে ট্যানারির সংখ্যা ২০০। এছাড়া রয়েছে ২ হাজার ৫০০টি ফুটওয়্যার তৈরির কারখানা, যার মধ্যে ৯০টি বড় আকারের প্রতিষ্ঠান। ইপিজেডসহ রফতানিমুখী লেদারগুডস ও ফুটওয়্যার শিল্প-কারখানা রয়েছে ২০০টি। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন দক্ষ লেদার ইঞ্জিনিয়ার।
গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের সমীক্ষা অনুসারে, ২০২০ সালে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজারের আকার ছিল ৩০৪ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৮ সালের মধ্যে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৩২৩ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ২০২১-২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে দেশের আয় ১ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। জার্মানি, পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি, জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে যাচ্ছে দেশীয় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। চামড়া শিল্পে শতভাগ কাঁচামাল দেশীয় হওয়া সত্ত্বেও সুন্দর ব্যবস্থাপনা, ট্যানারিগুলোর পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সার্টিফিকেট অর্জনে ব্যর্থতা ও প্রয়োজনীয়সংখ্যক দক্ষ লেদার ইঞ্জিনিয়ারের অভাবে বিলিয়ন ডলারের বাজার ধরতে পারছে না বাংলাদেশ। ফলে এ খাতে দেশীয় কর্মক্ষেত্রেই বিদেশীদের নিয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদেশী ক্রেতারা বিশেষ করে বড় ব্র্যান্ডগুলো আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য আমদানির সময় লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সার্টিফিকেশন দেখতে চায়। কারখানাগুলো পণ্য তৈরির সময় পরিবেশের ক্ষতি করছে না—এটা নিশ্চিত না করলে মেলে না এই সার্টিফিকেট। দেশে নিবন্ধিত ২০০ ট্যানারির মধ্যে এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড, এবিসি লেদার ও রিফ লেদার লিমিটেড—এ তিন কারখানা সার্টিফিকেট পেয়েছে। ফলে বৃহৎ এ খাতের পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স অর্জনের নেপথ্যে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন একজন লেদার ইঞ্জিনিয়ার।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী দেশীয় কোম্পানি বাটা, এপেক্স, বে, জেনিস, স্টেপ, লোটো, ওয়াকার, ফরচুন, আকিজ, এবিসি, এফবি, পিকার্ড বাংলাদেশসহ বিভিন্ন লেদার, ফুটওয়্যার ও লেদার প্রডাক্টস প্রতিষ্ঠানে লেদার ইঞ্জিনিয়ারের চাহিদা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। একজন লেদার ইঞ্জিনিয়ার কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার (কিউসি), ম্যাটেরিয়াল
প্রকিউরমেন্ট, প্রডাক্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসার, প্রডাক্ট ডিজাইনিং, প্ল্যানিং, মার্চেন্ডাইজিং, প্রডাক্ট ম্যানেজার, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার ইত্যাদি পদে চাকরি করার সুযোগ রয়েছে।
লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি, লেদারেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নাজমুল হোসেন বলেন, দেশের গ্র্যাজুয়েটরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। তাদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, বেশ ভালো দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছেন তারা। পর্যাপ্ত লোক না পাওয়ায় একাডেমিক ছাড়াও আমরা নিজেদের মতো করে জনবল তৈরি করে নিয়েছি। বিদেশীদের সমন্বয়ে এখানে কাজ চলছে। দেশীয় গ্র্যাজুয়েটরা অধিকাংশই ইন্ডাস্ট্রির প্রতি আগ্রহ কম। এ বিষয়ে যে ধরনের চাহিদা সে অনুযায়ী আমরা গ্র্যাজুয়েট পাচ্ছি না। ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা দরকার। তাহলে হয়তো চাহিদা অনুযায়ী জনশক্তি পাওয়া যাবে। এডিডাস, নাইকি, গুচি, পোমা, এবিসি মার্ট, অ্যালডো, ইস্প্রিট, হুগো বস, এইচঅ্যান্ডএম, কেইট স্পেড, কে-মার্ট, মাইকেল কোর, মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার, স্টিভ ম্যাডেন, টিম্বারল্যান্ডের মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোতেও লেদার টেকনোলজিস্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ালেখা
একজন লেদার ইঞ্জিনিয়ার কাঁচা চামড়া থেকে লেদার তৈরির কলাকৌশল, ব্যবহারোপযোগী বিভিন্ন চামড়াজাত পণ্যের ডিজাইন ও নির্মাণশৈলী নিয়ে কাজ করেন। যেগুলো থেকে পরবর্তী সময়ে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য বিভিন্ন চামড়াজাত পণ্য, গৃহস্থালি পণ্য, ক্রীড়াসামগ্রী, প্রতিরক্ষা, পরিবহন, সংগীতসহ নানা অঙ্গনের চামড়াজাত পণ্য তৈরি করা হয়।
দেশে মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা পড়তে পারবেন এ বিষয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে বিএসসি ইন লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং, বিএসসি ইন ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিএসসি ইন লেদার প্রডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং—এ তিনটি বিষয়ে ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এখানে এমএসসি, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণের সুযোগও রয়েছে। তিন বিভাগে মোট আসন সংখ্যা ১৫০টি।
এছাড়া খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি ও এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি দেয়া হয়। কুয়েটে ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ও লেদার প্রডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং নামে স্বতন্ত্র বিভাগ না থাকলেও লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে এ দুই বিষয়েও পড়ানো হয়। আসন সংখ্যা ৬০।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি ডিগ্রি গ্রহণের পর দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান, তুরস্ক, চেক রিপাবলিক, ভারতসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয় ছাড়াও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, পলিমার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট অব টেকনোলজি, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োলজিক্যাল সায়েন্স, রসায়ন, ন্যানো টেকনোলজি এবং ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া যায়। গবেষণার সুযোগ রয়েছে অবারিত।