গবেষক ও বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনে মনোযোগ দেয়া উচিত

. লাফিফা জামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডের সভাপতি। রোবটিকস বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গবেষণার নানা দিক নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম

রোবটিকস নিয়ে দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্পর্কে বলুন

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার প্রেক্ষাপটে রোবটিকস একেবারেই নতুন একটি বিষয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই রোবটিকস বিষয়ে স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত বিভাগ না থাকলেও সেখানকার কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই), ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই), মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা রোবটিকস নিয়ে নানা ধরনের কাজ করছে। আসলে রোবটিকসের সঙ্গে অনেক বিষয়ের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক রয়েছে। রোবটিকস শিখতে হলে প্রোগ্রামিং জানতে হয়, এটা সিএসইর সঙ্গে সম্পর্কিত। একইভাবে রোবটের মেকানিক্যাল বডি তৈরির ক্ষেত্রে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জ্ঞানও দরকার হয়। প্রোগ্রামিং বডি তৈরির পর প্রয়োজন বৈদ্যুতিক সার্কিট সংযোগের। এক্ষেত্রে থাকতে হয় ইইইর জ্ঞান। আমরা রোবটিকস বিভাগে মূলত তিন বিষয়ের সমন্বিত সিলেবাসের ওপর পাঠদান দিয়ে থাকি।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে রোবটিকসের মতো প্রায়োগিক বিষয়গুলো বৈশ্বিক উচ্চশিক্ষায় বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান প্রস্তুতি বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

যন্ত্রের ব্যবহার যত বাড়বে, শ্রম খাতে মানবসম্পদের চাহিদা তত কমতে থাকবে। আবার একই সঙ্গে যন্ত্র পরিচালনা নিয়ন্ত্রণের জন্য দক্ষ প্রশিক্ষিত মানুষের চাহিদাও বাড়বে। এক্ষেত্রে শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে চাকরি বা কর্মসংস্থান হারানোর ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে কারিগরি প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে। এজন্য আমাদের এখনই কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে এর পরিধি বাড়াতে হবে। যদি সেটা সম্ভব না হয় তাহলে সামনে বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানেরও দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমাদের দুটি দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমত, প্রযুক্তির ব্যবহার তথা উন্নত বিশ্বের উদ্ভাবিত সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নিজেদের নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন। কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা এখনো ভোক্তা পর্যায়ে রয়ে গেছি। বিদেশে একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে আমরা সেটা ব্যবহার করছি। আমি মনে করি, আমাদের দেশের গবেষক বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনে মনোযোগ দেয়া উচিত। আবার দেশে একেবারেই গবেষণা বা উদ্ভাবন হয় নাএমন ধারণাও সঠিক নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, দেশীয় উদ্ভাবিত পণ্য বাজারজাতে আমরা ব্যর্থ হই।

রোবটিকস বিষয়ে আপনাদের বিভাগে কী ধরনের গবেষণা হয়েছে বা হচ্ছে? উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সম্পর্কে বলুন।

দেশের স্বাস্থ্য খাতের বেশকিছু সমস্যা নিয়ে আমরা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। সেগুলো সফলও হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মেডিসিন ডিসপেনসিভ ডিভাইস, অটোমেটেড স্যালাইন ইনফিউশন সিস্টেমস, এলডার কেয়ার রোবট, আই ট্র্যাকিং সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ডিটেকশন সিস্টেম। এছাড়া শিশুদের হাতের লেখা শেখানোর জন্য চিলড্রেন রোবট তৈরির একটি কাজ চলমান রয়েছে।

উদ্ভাবিত যন্ত্রগুলোর মধ্যে মেডিসিন ডিসপেনসিভ ডিভাইস মূলত একটি ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ডিভাইস, যার কাজ হলো রোগীকে সঠিক সময়ে ওষুধ খেতে সাহায্য করা। কাজ নিয়ে আন্তর্জাতিক জার্নালে একটি গবেষণাপত্রও প্রকাশ হয়েছে। এটি একটি স্বয়ংক্রিয় ডিভাইস যাতে ক্যামেরা বিভিন্ন ড্রয়ার যুক্ত রয়েছে। কোনো ড্রয়ারের ওষুধ কখন খেতে হবে সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঠিক সময় খুলে যাবে। যখন ওষুধ নেয়া সম্পন্ন হবে তখন ক্যামেরা শনাক্ত করবে রোগী ঠিক কোন সময়ে কোন ওষুধটি খাচ্ছে। ভুল ওষুধ থাকলেও শনাক্ত করবে। আর এই রোবটের পাশাপাশি রোগীর স্মার্টফোনেও একটি অ্যাপ থাকবে, যেটি রোগী ওষুধ খাওয়া মাত্রই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে তথ্য হালনাগাদ করে দেবে। ওষুধ সঠিক সময়ে না খেলে নির্দিষ্ট একটি ফোন নম্বরে এসএমএস চলে যাবে, যাতে রোগীর সেবাদাতা জানতে পারে কোন ওষুধটি খাওয়া হয়নি। ঠিক সময়ে সঠিক ওষুধ খাচ্ছে কিনা সেটা শনাক্ত করবে এই রোবট। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হাতের নাগালে রাখার জন্য এর সঙ্গে আছে অটোমেটেড টেবিল যেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষটি যেখানে যাবে তাকে অনুসরণ করে পিছু ছুটবে। আবার থামলে টেবিলটিও থেমে যাবে।

হাসপাতালে রোগীর স্যালাইন দেয়ার সময় নানা জটিলতায় পড়তে হয়। সঠিক সময়ে স্যালাইন দেয়া, কী পরিমাণ স্যালাইন পুশ করা হবে, কত মাত্রায় স্যালাইন চলবে, কখন স্যালাইন দেয়া বন্ধ করতে হবেএসব সমস্যা সমাধান করবে অটোমেটেড স্যালাইন ইনফিউশন সিস্টেমস। কারো সাহায্য ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করবে ডিভাইসটি।

প্যারালাইজড রোগীর জন্য আই ট্র্যাকিং সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ডিটেকশন সিস্টেম। চোখের মুভমেন্ট বা নড়াচড়া শনাক্ত করে রোগী কী বলতে চাচ্ছে তা শনাক্ত সেই অনুযায়ী বার্তা দেবে রোবটটি। রোবটিকস বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে কাজ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে। বৃদ্ধ মানুষের সুস্থ থাকার জন্য চিকিৎসকরা বিভিন্ন শারীরিক অনুশীলনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অনেক সময় ফিজিওথেরাপির প্রয়োজন হয়, যা সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই এর সমাধান করেছি আমরা। সে যখন ব্যায়াম করবে তখন রোবটের ক্যামেরা তার ব্যায়াম শনাক্ত করে ফিডব্যাক দেবে কোন জায়গায় সঠিকভাবে হচ্ছে না। এই রোবটের নাম এলডার কেয়ার রোবট। -সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র এখন আন্তর্জাতিক জার্নালে রিভিউ পর্যায়ে রয়েছে।

দেশের উচ্চশিক্ষায় একাডেমিয়া-ইন্ডাস্ট্রি কোলাবরেশনের কথা বলা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের খুব ভালো যোগাযোগ এখনো গড়ে ওঠেনি। আপনাদের অভিজ্ঞতা কেমন?

গবেষণা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে একাডেমিয়া ইন্ডাস্ট্রিদুইয়ের সমন্বয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত বিশ্বে সরকার বা ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী তাদের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা প্রকল্প নেয়া হয়। এসব প্রকল্প পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো অর্থায়ন করে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা সেলের মতো কাজ করে। যদিও আমাদের দেশে সংস্কৃতি এখনো শুরু হয়নি। একটি রোবট তৈরিতে যে প্রযুক্তি দরকার আমরা সেটা দিতে পারি, কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যবহার কিংবা বাজারজাতে এগিয়ে আসতে হবে শিল্প খাতকে। রোবটিকস বিষয়ে গবেষণার জন্য যে ধরনের সরঞ্জাম দরকার হয় সেগুলো অনেক দামি। ইউজিসি আইসিটি ডিভিশন আমাদের কিছু সহযোগিতা করেছে। তবে ল্যাব সুবিধা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখন সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে প্রযুক্তির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তার জন্য অনেক বড় প্রস্তুতি দরকার। একাডেমিয়া, ইন্ডাস্ট্রি সরকারের মধ্যে যত বেশি সমন্বয় হবে, কোলাবোরেশন বাড়বেআমরা তত বেশি ভালো কাজ করতে পারব।

প্রযুক্তি প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে। রোবটিকসের ক্ষেত্রে সামনের দিনগুলোয় কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে?

আমরা যা কল্পনা করতে পারি, তার সবই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে। রোবট সংবাদ পড়ছে। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে না এটা মানুষ নয়। আমেরিকায় হোটেল বুকড করতে গিয়ে আমি নিজেই এটার সম্মুখীন হয়েছি। ফোনে অনেকক্ষণ কথা বলেছি, কিন্তু বুঝতেই পারিনি সেটা রোবট। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর যখন অন্য বিষয়ে জানতে চাচ্ছিলাম তখন বলল, ফোনটি আমাদের একজন অ্যাসিস্ট্যান্টের কাছে হস্তান্তর করছি। এটি বলার পর বুঝতে পারলাম আমি এতক্ষণ রোবটিকস ভয়েজের সঙ্গে কথা বলেছি। কোনো মানুষ কথা বলেনি। খুব ক্রিয়েটিভ জায়গাগুলো মানুষের দখলেই থাকবে। রোবট তৈরির ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে রোবট মানুষের কাজে সহায়তার জন্য, তবে মানুষের বিকল্প হিসেবে নয়। রোবট মানুষের কাজ সহজে করে দেবে, কষ্ট কমাবে, সাশ্রয়ী হবে কিন্তু মানুষের বিকল্প হবে না।

দেশে প্রকৌশল শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বেশ কম। রোবটিকসের ক্ষেত্রে চিত্র কেমন?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রকৌশল বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৩০ শতাংশের নিচে। কর্মক্ষেত্রে গিয়ে হার দাঁড়ায় ১০-১২ শতাংশে। জাপান কোরিয়ার মতো উন্নত দেশেও শতাংশের বেশি নারী প্রকৌশলী পাওয়া যায় না। সারা বিশ্বের মতো উপমহাদেশেও ইঞ্জিনিয়ারিং তথা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল গণিতে (এসটিইএম) নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। ভারতের একই চিত্র দেখেছি। তবে নারীর অংশগ্রহণ যাতে বাড়ে সেজন্য প্রচুর কাজ হচ্ছে। আমি নিজেও বাংলাদেশে প্রযুক্তিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য কাজ করার চেষ্টা করছি।

কৃষি শিল্প খাতে উৎপাদন বাড়াতে যান্ত্রিক ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে?

বাংলাদেশে শিল্প-কারখানায় রোবটের ব্যবহার শুরু হয়েছে। তারা বিদেশ থেকে রোবট নিয়ে এসেছেন তাদের ব্যয় কমাতে। পোশাক কারখানায় আগে ম্যানুয়াল মেশিনে সেলাই কাজ করা হতো, এখন রোবট সেই কাজটা করে দেবে। শিল্প-কারখানায় যে রোবট ব্যবহার হয় সেটাকে বলা হয় কোবট অর্থাৎ কোলাবোরেটিভ রোবট। রোবট এবং মানুষ একসঙ্গে মিলে কাজ করবে। সম্পূর্ণ আধিপত্য রোবটের কাছে যাবে না। আর কৃষি খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বা স্মার্ট এগ্রিকালচার বাস্তবায়নের জন্য সরকারি পর্যায়ে বেশকিছু প্রকল্প নেয়া হয়েছে। মাঠের মাটি ফসলের জন্য উপযুক্ত কিনা সেন্সরই বলে দেবে। রোবটিকস ডিভাইস বীজ রোপণ করে দিতে পারে। কখন পানি দিতে হবে, সার দিতে হবে, মেসেজ চলে যাবে কৃষকের কাছে। ফসলের পাতায় কোনো রোগ হলে কোন রোগ সেটা শনাক্ত করা যাবে ডিভাইসে। এবং তার জন্য যা দরকার সেসব নিয়ে অনেকেই কাজ শুরু করেছে। আমাদের বাচ্চারাও অনেক ভালো এগ্রিকালচার রোবট তৈরি করে আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে নিয়ে গিয়েছে। এসব সেবা চালু করতে যে ধরনের রোবট প্রয়োজন, সেগুলো দেশেই তৈরি করা সম্ভব।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সেক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে হবে। তবে এক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণা বরাদ্দ আরো অনেক বাড়াতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাবসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন