স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ অবারিত

মো. ইসরাফিল প্রাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের চেয়ারম্যান। গ্রাফিক ডিজাইনে পড়াশোনা ক্যারিয়ার নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে।

গ্রাফিক ডিজাইন কী?

মানুষের সৃষ্টিশীল কর্মের সবই শিল্প। শিল্পকে দুই ভাগ করা হলে তার একটা ফাইন আর্টস বা নান্দনিক শিল্প। আর অন্যটা হলো অ্যাপ্লাইড আর্ট বা ব্যবহারিক শিল্প। নন্দন শিল্প শুধু মনের ক্ষুধা মেটায়, এটা ব্যবহারিক কোনো কাজেই আসে না। মনকে প্রশান্তি দেয়া, মনের খোরাক জোগানো গান, নাচ, চিত্রকর্মএর সবই ফাইন আর্ট। পৃথিবীর আর সবকিছু ব্যবহারিক আর্টের অন্তর্গত, যেমন মৃিশল্প, কারু শিল্প, পোশাক শিল্প, সিরামিক শিল্প, দারু শিল্প। গ্রাফিক ডিজাইন হলো একটা মৌলিক অংশ। সমাজে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় যে নকশা ব্যবহার হয় সেটাই মূলত গ্রাফিক ডিজাইন। আভিধানিক অর্থ চিত্র সম্পর্কিত নকশা। মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য চিহ্ন আবিষ্কার হয়েছে। যে ছবি বা যে চিহ্ন অথবা যা কিছুই যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত হয়েছে মূলত সেটাই আধুনিক গ্রাফিক ডিজাইন। এটিকে আমরা বলছি ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশনস বা দৃশ্যমান যোগাযোগ। এখানে দুটি বিষয় শেখানো হয়। একটি যোগাযোগ ভাবনা, আরেকটি হলো সেটা সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য নান্দনিকতা।

শিক্ষার্থীদের কী কী বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ রয়েছে?

বেসিক ড্রয়িং, বেসিক ডিজাইন, স্টাডি অ্যান্ড কম্পোজিশন। এর মধ্যে রয়েছে ডিজাইন কম্পোজিশন, অবজেক্ট কম্পোজিশন, অ্যাকশন ড্রয়িং কম্পোজিশন ইত্যাদি। ইলাস্ট্রেশন, ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটি ডিজাইন, ব্র্যান্ড ডিজাইন, টুডি থ্রিডি ডিজাইন, ওয়েব অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশনস, ইউজার ইন্টারফেস, ইউজার এক্সপেরিয়েন্স (ইউএক্স) ডিজাইন, অ্যানিমেশন, প্রিন্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন ডিজাইন যেমন বই, কভার, ম্যাগাজিন, পত্রিকাসহ সব ধরনের প্রকাশনার ডিজাইন। টেক্সটাইল ডিজাইনও রয়েছে, যা একদমই আলাদা। কীভাবে এটা ছাপা হয়, এটা যখন মেশিনে যাবে কী ধরনের রঙ হবে, কেমন সুতা হবে রকম অনেক বিষয় চিন্তা করে ডিজাইন করতে হয়। গার্মেন্টস শিল্পের যত ডিজাইন সব গ্রাফিক ডিজাইনাররা করেন। মার্কেটিং, ক্যালিগ্রাফি, টাইপোগ্রাফি, ইন্টেরিয়র অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল ডিজাইন এগুলো শেখানো হয়।

বাংলাদেশে শিল্পের সম্ভাবনা কেমন?

সরকারি-বেসরকারি চাকরির ওপর নির্ভরতা ছাড়াই স্বাবলম্বী হওয়া যায়। দক্ষতাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েটের চাহিদা সব জায়গায়। আমাদের শিক্ষাথীরা প্রথম বর্ষ থেকেই আয় করে। তারা বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই। চাকরির শুরুতেই তারা প্রথম শ্রেণীর সম্মানী পায়। এমন কোনো খাত নেই যেখানে ডিজাইন নেই। এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় দেশে। কিন্তু গ্রাফিক ডিজাইন আছে মাত্র কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চারুকলা বিভাগগুলোয় গ্রাফিক ডিজাইন চালু করা গেলে কর্মসংস্থান নিয়ে রাষ্ট্রের যে দায়-বোঝা তা অনেকটা মুক্ত হবে। বেকারত্ব লাঘব হবে।

গ্রাফিক ডিজাইন হলো একমাত্র পড়াশোনার বিষয় যেখানে সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যায়। প্রিন্ট অ্যান্ড পাবলিকেশনের সব ধরনের ডিজাইন, প্যাকেজিং, সিকিউরিটি প্রেস, স্ক্রিন প্রিন্টিং, ব্লক প্রিন্টিংয়ের প্রাথমিক ডিজাইন তৈরি করেন একজন ডিজাইনার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা পাস করছে তারা সব ধরনের ডিজাইন করতে পারে। কাজের সুযোগ রয়েছে সব খাতে। বিমান বাংলাদেশ, বিটিভি, পর্যটন, দুদকসহ দেশের প্রাতিষ্ঠানিক যত লোগো তার ৯০ ভাগ গ্রাফিক ডিজাইনারের তৈরি। কম্পিউটারের কি-বোর্ড বাংলা ফন্ট বিজয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফন্ট তৈরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের বেশি ভূমিকা ছিল। বাজারে বর্তমানে আলোচিত ফন্ট রাজনশৈলী, কাজীটাইপো আমাদের শিক্ষার্থীদেরই তৈরি।

ফ্রিল্যান্স গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজের সুযোগ সম্পর্কে বলুন?

শিল্পটা এখন বৈশ্বিক। দেশে বসেই বিদেশের চাকরি করছেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিযোগিতার যুগ চলছে। আপনি যদি একটা সুন্দর চোখ আঁকতে পারেন সেটাও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আমরা যে ওয়েব টেমপ্লেট ব্যবহার করি এগুলো কিনতে পাওয়া যায়। কারা বানায় এগুলো? এর সব  মেকআপ। গ্রাফিকের দুনিয়ায় এমন কোনো কাজ নেই, যা বিক্রি হচ্ছে না।

কর্মক্ষেত্রে চাহিদা কেমন?

চাহিদার তুলনায় সেই অর্থে দেশে গ্র্যাজুয়েট তৈরিই হচ্ছে না। প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৫ জন গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে। আগে ছিল মাত্র ১৫টি আসন। দেশে মোট তিন-চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাফিক ডিজাইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান করেছে। ২০০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেয়া তাদের ডিগ্রির সংখ্যা ৫০০-এর মতো। অনেক বড় একটি কাজের ক্ষেত্র গ্রাফিক ডিজাইন, কিন্তু সে তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানে দক্ষ ডিজাইনার তেমন নেই। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটের প্রচুর চাহিদা আছে। আগামীতে চাহিদা আরো বাড়বে।

অন্যান্য শিক্ষাক্রমের চেয়ে ব্যতিক্রমী, সৃষ্টিশীল ব্যবহারিক কাজনির্ভর হওয়ায় কোন ধরনের শিক্ষার্থীদের গ্রাফিক ডিজাইনে পড়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?           

শিশুকাল থেকেই যাদের ক্রিয়েটিভ মনমানসিকতা আছে, তারা এখানে ভালো করতে পারবে। এখানে তাদেরই আসা উচিত যারা নতুন কিছু তৈরিতে আগ্রহী। শিল্পবোধ থাকতে হবে। যদিও শিল্পীসত্তা কিছুটা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। একটা হলো প্রচণ্ড আগ্রহের বিষয়, আরেকটা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ক্রিয়েটিভিটি। দুটির মেলবন্ধন প্রয়োজন। গ্রাফিক ডিজাইনার হতে হলে প্রথমে ড্রইং জানতে হবে। চাইলেই সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষায় নিজেদের শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব। একটা বস্তু দেখার পর সেটাকে চিত্র চিন্তায় নিয়ে আসার সক্ষমতা থাকতে হবে। যে ছবি আঁকতে পারে, যার ভাবনার মধ্যে ছবি আঁকার বিষয়টা আছে পরবর্তী সময়ে তারা চাইলে গ্রাফিকে তার পছন্দের তালিকায় প্রথম রাখতে পারে।

গ্রাফিক ডিজাইন খুবই সুপরিচিত একটি বিষয়। বাজারে অনেকেই বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি কোর্স করে নিজেদের গ্রাফিক ডিজাইনার দাবি করছেন। প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাফিক ডিজাইন শিল্পে এর প্রভাব কেমন?

গ্রাফিক ডিজাইনে প্রযুক্তিগত যে সাপোর্ট দরকার তার পুরোটা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমরা চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে পারছি না বলেই বাজারে ৩৬ ঘণ্টা কোর্স, ৭২ ঘণ্টা কোর্স, তিনদিনের কোর্স, সাতদিনের কোর্স, তিন মাসের কোর্স করে গ্রাফিক ডিজাইনার হচ্ছে। তবে মানহীন কাজ করছে। একটা ব্র্যান্ড লোগো তৈরিতে কোটি টাকাও খরচ হতে পারে, আবার হাজার টাকা ব্যয় করে একদিনে পাঁচটিও লোগো বানিয়ে নিতে পারেন। কারণে অপেশাদার সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিল্পবোধহীন ডিজাইনারদের সহজলভ্যতা বাড়ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন