জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণে গতকাল দুপুর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় অংশ ছিল বিদ্যুত্হীন। মূলত যমুনা নদীর এপারের অর্থাৎ পূর্বাঞ্চলের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগ ২টা ৪ মিনিটে একযোগে বিদ্যুত্হীন হয়ে পড়ে। বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হয়। উত্তরা, গুলশান, বারিধারা, মিরপুরসহ কয়েকটি এলাকায় আসে সন্ধ্যা ৬টার দিকে। ৯টার পর থেকে ধীরে ধীরে আলো ফিরতে থাকে রাতের ঢাকায়। পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সময় লেগে যায় দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা। বিদ্যুৎ বিভাগ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ উদঘাটনে এরই মধ্যে একটি কমিটি গঠন করেছে বিদ্যুৎ সঞ্চালনকারী সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে গত ১৯ জুলাই থেকে সময়সূচি মেনে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং হচ্ছে দেশে। তার মাঝেই গতকাল বেলা ২টার দিকে হঠাৎ বিদ্যুত্হীন হয়ে পড়ে দেশের ৬০ শতাংশেরও বেশি এলাকা। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু এলাকা বাদে পুরো দেশেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর জেরে চরম ভোগান্তির মুখে পড়তে হয় কয়েক কোটি মানুষকে। দেশে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৩ মে আকস্মিক গ্রিড বিপর্যয়ের পর উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩২টি জেলা কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুিবচ্ছিন্ন ছিল। তারও আগে ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল। তখন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, ভেড়ামারায় জাতীয় গ্রিডে বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে সংযোগস্থলের ত্রুটি থেকে বিভ্রাটের শুরু। তবে এবার কী কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট, তা এখনো স্পষ্ট নয়। পিজিসিবির কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, নানা কারণেই বিদ্যুতের গ্রিড বসে যেতে পারে। আর সেটি একবার বসে গেলে পুনরায় চালু করার প্রক্রিয়াও বেশ জটিল এবং দীর্ঘ সময় লেগে যায়। তবে এ সময় উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল।
এদিকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে ভোগান্তিতে পড়ে দেশের কয়েক কোটি মানুষ। বিঘ্নিত হয় হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম। সংকটে পড়ে মোবাইল-ইন্টারনেট গ্রাহকরাও। দুর্ভোগ দেখা দেয় জ্বালানি তেল ও সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোয়ও। জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় দেখা যাওয়ায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও আধা ঘণ্টার মতো ইমিগ্রেশনে ধীরগতি ছিল। কোনো কোনো এসি বন্ধ কিংবা সীমিত করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়। এ বিষয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. কামরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে জানান, বিপর্যয়কালীন বিমানবন্দরের প্রতিটি বিভাগই সচল রাখা হয়েছিল। জেনারেটরের মাধ্যমে লাগেজ বেল্ট, চেকইন কাউন্টার ও বোর্ডিং ব্রিজ স্বাভাবিক রাখা হয়।
এদিকে বিদ্যুৎ না থাকায় গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি নানামুখী ভোগান্তিতে পড়ে ভর্তি থাকা রোগীরা। বিঘ্ন ঘটে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও। বিশেষ ব্যবস্থায় চালু রাখা হয় সিসিইউ, আইসিইউ, অপারেশন থিয়েটার (ওটি)। ঢামেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (অর্থ ও স্টোর) ডা. আশরাফুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, যেখানে যেখানে জরুরি দরকার সেখানেই জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছি। জরুরি ভিত্তিতে ওটি ও আইসিইউতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রত্যেক ভবনের জন্যই আলাদা জেনারেটরের ব্যবস্থা আছে হাসপাতালে।
টেলিযোগাযোগ সেবায় বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের প্রভাব পড়ে বেশ। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কে সমস্যা দেখা দেয়। এতে কলড্রপ বেড়ে যায়, কমে যায় ইন্টারনেটের গতি। কোনো কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে জেনারেটর দিয়ে বিটিএস বা মোবাইল টাওয়ার ২ থেকে ৫ ঘণ্টা চালু রাখা যায়। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের বিভ্রাট দেখা দিলে জেনারেটর দিয়েও বিটিএসের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয় না। মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব) গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছে, বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে মোবাইল ইন্টারনেট, খুদে বার্তা পাঠানো ও ফোনকলে সমস্যা হচ্ছে। ব্যবহারকারী পর্যায়ে বিদ্যুৎ না থাকায় ৮০ শতাংশ ব্যান্ডউইডথ ব্যবহার কমেছে। সাময়িক এ অসুবিধার জন্য গ্রাহকদের প্রতি দুঃখও প্রকাশ করেছে সংগঠনটি।
বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের প্রভাব পড়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টেও। তবে বিদ্যুৎ না থাকলেও থেমে ছিল না উচ্চ আদালতের বিচারকাজ। দুপুরের দিকে যখন বিপর্যয় শুরু হয় সে সময় অ্যানেক্স ভবনের জেনারেটরও বন্ধ ছিল। এমন পরিস্থিতিতে বিচারকাজ বন্ধ না করে মোমবাতি জ্বালিয়ে এবং এজলাস কক্ষে থাকা আইনজীবীদের মোবাইলের লাইটের আলোতে বিচারকাজ চলে। প্রায় সোয়া ঘণ্টা বিদ্যুত্হীন অবস্থায়ই অনেক মামলা নিষ্পত্তি করেন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান বণিক বার্তাকে জানান, দ্রুতই স্বাভাবিক হবে পরিস্থিতি। একই কথা জানান ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) এমডি কাওসার আমির আলী। পিজিসিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ ও সূত্রপাত কোথায় হয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি। আপাতত দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা চলছে। তবে ঘটনা উদঘাটনে পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক (পিঅ্যান্ডডি) ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকেও আরো দুটি কমিটি করা হবে।
এদিকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে সবাইকে ধৈর্য ধারণের অনুরোধ জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। সেই সঙ্গে জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিদ্যুৎ বিভাগকে তিনি দুটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। গতকাল বিকালে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জানান, বিদ্যুৎ বিভাগের একটি এবং তৃতীয় পক্ষের একটি কমিটি বিভ্রাটের কারণ খুঁজে বের করতে কাজ করবে।
জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলে অনাকাঙ্ক্ষিত এ বিভ্রাটে দুঃখ প্রকাশ করে গতকাল রাতে বিবৃতি দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। তাতে বলা হয়, গতকাল বেলা ২টা ৪ মিনিটে জাতীয় গ্রিডের ইস্টার্ন অঞ্চলে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ) অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়েছে। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বিদ্যুৎ বিভাগ ও সংশ্লিষ্টরা কাজ করছে। এর মধ্যে বেলা ২টা ৩৬ মিনিটে আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন চালুর মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলের বৃহৎ জেনারেশন কেন্দ্রগুলো (ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জ, মেঘনাঘাট, হরিপুর, সিদ্ধিরগঞ্জ ইত্যাদি) চালু করে ধীরে ধীরে সিস্টেম স্বাভাবিক করা হচ্ছে। তবে ঢাকায় বিদ্যুৎ ফেরা শুরু হয় বিকাল ৫টা ১৫ মিনিট থেকে। এর মধ্যে ২৩০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে রাজধানীতে রাত ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে ১৭৫০ মেগাওয়াট স্বাভাবিক সরবরাহ শুরু হয়।
সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে রাত সাড়ে ১০টার দিকে পিজিসিবির অপারেশন ও মেইনটেন্যান্সের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী পরিচালক মো. মাসুম আলী বকসীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এখনো কাজ চলছে। এরই মধ্যে জাতীয় গ্রিডের সব কাজ শেষ হয়েছে। ডিস্ট্রিবিউশনের কাজ চলছে। তবে ডেসকো ও ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও গ্রামাঞ্চলে কাজ চলমান। রাত ১২টার মধ্যে সারা দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে তিনি তখন আশা প্রকাশ করেন।