পাম অয়েলের বাজার

বেঁধে দেয়া দামই নতুন সংকট তৈরি করছে

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

বছর খানেক ধরে দেশে ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা চলছে। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে দেশের বাজারেও অস্বাভাবিক বেড়ে যায় পাম অয়েলের দাম। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পণ্যটির মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। তবে সম্প্রতি বিশ্ববাজারে দাম কমে এলেও সে তুলনায় দেশের বাজারে কমানো হয়নি। কম দামে আমদানি করলেও বেঁধে দেয়া মূল্যসীমার নিচে পণ্যটি বিক্রি করতে পারছেন না আমদানিকারকরা। ফলে বেশি দামে পাম অয়েল কিনে লোকসান গুনতে হচ্ছে পাইকারি বাজারের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের। পাশাপাশি খুচরা পর্যায়ের ক্রেতাদেরও পণ্যটি কিনতে হচ্ছে উচ্চমূল্যেই।

ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারিত রয়েছে লিটারপ্রতি ১৯২ টাকা। বছরের ২৩ আগস্ট লিটারপ্রতি টাকা বাড়িয়ে দাম নির্ধারণ করে সরকার। অন্যদিকে প্রতি লিটার পাম অয়েলের নির্ধারিত দাম ১৩৩ টাকা। দাম বেঁধে দেয়া হয় ২২ সেপ্টেম্বর। এর আগে পাম অয়েলের সরকার নির্ধারিত দাম ছিল লিটারপ্রতি ১৫৫ টাকা। আগস্টে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হলেও সে সময় পাম অয়েলের দাম বাড়ানো হয়নি। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে দেশেও পাম অয়েলের দাম কমানোর সুপারিশ করেছিল ট্যারিফ কমিশন। আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েলের বুকিং দর এরই মধ্যে আরো কমেছে।

শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে অপরিশোধিত পাম অয়েলের টনপ্রতি দাম ইতিহাসে সর্বোচ্চ হাজার ৭৭৭ টাকায় উঠে যায়। তবে জুলাইয়ে পণ্যটির দাম কমে হাজার ৫৬ ডলারে নেমে আসে। পাম অয়েলের দাম এখন কমে ৮০০ ডলারে নামলেও দেশের বাজারে তা কমানো হয়নি। পরিস্থিতিতে লোকসান এড়াতে ক্রয় কমিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে দীর্ঘদিনের মজুদ সরবরাহ আদেশ (এসও) বিক্রি করে দেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও কম দামে পাইকারি বাজারে পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো পাম অয়েল আমদানির পর তা ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করে। ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলো তেল বিক্রি করে ব্রোকারদের কাছে। ব্রোকাররা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে পাইকারি বিক্রেতারা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে তা বিক্রি করে। আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েলের দাম কমে যাওয়ার কারণে এখন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান, এসও ব্রোকার পাইকারি ক্রেতারা মিল মালিকদের বিক্রি করা দামে পাম অয়েল সংগ্রহ করতে চাইছে না। কারণে দেশে মিল মালিকদের কাছে পর্যাপ্ত পাম অয়েলের মজুদ থাকলেও ক্রেতা সংকটে আশানুরূপ বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। এরই মধ্যে বিভিন্ন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভোজ্যতেল সংগ্রহ করে অনেক ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ব্রোকার লোকসান গুনেছেন। শুধু প্রয়োজন দেখা দিলেই পাইকারি খুচরা ব্যবসায়ীরা এসওতে লিখিত মূল্যে পাম অয়েল সংগ্রহ করছেন।

আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারিভাবে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়ার গতি অত্যন্ত শ্লথ। বিশ্ববাজারে প্রায় প্রতিদিনই পণ্যের দাম ওঠানামা করলেও দেশে এক থেকে দেড় মাস পর পণ্যের দাম পুনর্নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কারণে পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে কমে গেলে দেশের বাজারে পণ্যটির ক্রেতা কমে যায় আশঙ্কাজনক হারে। আমদানিকারক থেকে শুরু করে ব্রোকাররাও পণ্য বিক্রি করতে পারেন না। এতে পাম অয়েলের বাজার সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় সংকট দেখা দেয়।

ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ব্রোকাররা দাবি করছেন, বর্তমানে আমদানিকারকরা সরকার নির্ধারিত দামেই পাম অয়েল, সয়াবিন এসও আকারে বিক্রি করছে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে গেলে লাভের আশায় এসও বিক্রিতে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে বাংলাদেশে আগের বাড়তি মূল্যে পণ্যটির ক্রয়ে অনীহা দেখা যায়।

দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে মণপ্রতি পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে হাজার ৩০০ (এসও পর্যায়ে) টাকায়, যা খুচরায় বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ হাজার টাকায়। অন্যদিকে পাইকারি বাজারে মণপ্রতি সুপার পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে হাজার ৫০০ টাকায় এবং খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে হাজার ৪০০ টাকায়। এসও পর্যায়ে মাত্র হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হলেও সরকার নির্ধারিত দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের। এতে করে মিলগেট থেকে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা এসওতে পাম অয়েলের দাম সরকার নির্ধারিত থাকলেও এসব এসও কিনে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ব্রোকার প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসান দিয়ে কম দামে বিক্রি করছে। বিশ্ববাজারে ক্রমাগত দাম আরো কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি দামে কমে যাওয়ার ভয়ে লোকসান দিয়ে হলেও পণ্যটি বিক্রি করে দিতে চাইছেন ব্যবসায়ীরা।

জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, সরকার প্রতি এক মাস, দেড় মাস পরপর ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করায় বিশ্ববাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যবসায়ীরা লেনদেন করায় নিম্নমুখী বাজারে পাম অয়েলের ক্রেতা সংকট দেখা দিয়েছে। সরকার নিয়মিতভাবে ভোজ্যতেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলে ভোজ্যতেল বিপণনে ব্যবসায়ীরা লোকসান এড়ানোর পাশাপাশি ভোক্তারা স্বল্প মূল্যে পণ্য কিনতে পারত বলে মনে করছেন তিনি।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাইকারি বাজারে পণ্যটির লেনদেনে ব্যবসায়ীরা লোকসানে থাকলেও পাইকারি খুচরা বাজারে সরকার নির্ধারিত দামেই পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারিভাবে ঘোষিত দামে পাম অয়েল বিক্রি করলেও বাজার মনিটরিং কমিটি কিংবা কোনো সরকারি তদারককারী সংস্থার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে না। ট্যারিফ কমিশনের মূল্য নির্ধারণে দীর্ঘসূত্রতা ছাড়াও নিম্নমুখী বিশ্ববাজারের পরিপ্রেক্ষিতে মিল মালিকদের দাম পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে ধীরগতি অপরাপর ব্যবসায়ী ভোক্তা শ্রেণী লোকসানে পড়ছে বলে মনে করছেন তারা।

জানা গিয়েছে, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম উপর্যুপরি বৃদ্ধির সময় সরকার নিয়মিত বিরতিতে দাম পুনর্নির্ধারণ করলেও সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত এক মাস পর দাম নির্ধারণের সুপারিশ পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকেও ১৫ দিন অন্তর ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণের সুপারিশ করা হলেও সেটি কার্যকর করা হয়নি। মূলত বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্যারিফ কমিশন থেকে পর্যালোচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়। এরপর সংগঠনটির সঙ্গে বৈঠক করে মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু আমদানিকারকরা বিশ্ববাজারে দাম কমতে থাকলেও ভোজ্যতেলের দাম পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনীহা দেখায়। আমদানিকারকদের বিপরীতমুখী আচরণের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় দাম কমানোর ক্ষেত্রে সাধারণ ব্যবসায়ী ভোক্তা ঠকছেন বলে মনে করছেন কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছে, চলতি বছরের ২২ মার্চ, মে, জুন, ২৬ জুন, ১৭ জুলাই, ২৩ আগস্ট ২২ সেপ্টেম্বর ভোজ্যতেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যদিও সরকারিভাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাম কমানো পণ্যটি বাজারে খুঁজে পায়নি খুচরা বিক্রেতা সাধারণ ভোক্তারা। বাড়তি দামের মজুদ পণ্য বিক্রির শেষেই কোম্পানিগুলো কম দামের পণ্য সরবরাহ করেছে। অথচ দাম বাড়ানো হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে পাইকারি বাজারে মোড়কজাত ভোজ্যতেল ছেড়ে দেয়া হয় কিংবা ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে খোলা সয়াবিন, পাম অয়েলের এসও সরবরাহ করা হয়।

বিষয়ে জানতে চাইলে সিটিগ্রুপের পরিচালক (করপোরেট রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমেছে। কিন্তু বর্তমানে বিক্রি করা ভোজ্যতেল অনেক আগেই ক্রয় করা। তাছাড়া বর্তমানে ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় দাম কমলেও আমদানির পর কস্টিং অনুযায়ী বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম নির্ধারণ করে। এতে আমদানিকারকদের কোনো দায় থাকে না। সময় হলেই আমদানিকারক বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন