তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি

উন্নয়নশীল অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়

দেশের উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হলো সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ। আর সঠিক পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী সঠিক তথ্য পরিসংখ্যান। তথ্য যত নির্ভুল হবে নীতিনির্ধারকদের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ তত সহজতর হবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর এগিয়ে থাকার পেছনে শক্তিশালী তথ্য উপস্থাপন পরিসংখ্যান ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে সঠিক পরিসংখ্যানের চর্চা বলতে গেলে অনেকটাই উপেক্ষিত। বিভিন্ন সময়ে সরকারের তথ্য পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কৃষি শিল্পের উৎপাদন থেকে শুরু করে আমদানি-রফতানি এবং সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলসংক্রান্ত তথ্য নিয়েও কম-বেশি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। একেক সংস্থা বা ব্যক্তি একেক সময়ে ভিন্ন তথ্য-পরিসংখ্যান উপস্থাপন করায় বিভ্রান্তি আরো বাড়ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করা যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষির উৎপাদন ভোগ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, জ্বালানি তেলের রিজার্ভ মূল্যবৃদ্ধি, বিপিসির মুনাফা-লোকসান ইত্যাদির তথ্য-পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অধিকাংশ পরিসংখ্যান স্পষ্ট নয়, স্বচ্ছতারও অভাব রয়েছে। উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছে। সময়ে এসে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি প্রশ্নবিদ্ধ পরিসংখ্যান টেকসই উন্নয়নের সহায়ক নয়।

সরকার ঘোষিত অনেক তথ্যই স্পষ্ট নয়। সম্প্রতি বিপিসির লোকসানের বোঝা হ্রাস করার কথা বলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, বিপিসি গত পাঁচ বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি মুনাফা করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অকটেন পেট্রলের চাহিদার প্রায় পুরোটা দেশেই উৎপাদিত হয়। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ানোর কথা বলে দেশেও দাম বাড়ানো হয়েছে। এক সপ্তাহ আগেই বলা হয়েছে, দেশে কয়েক মাসের জ্বালানি তেলের মজুদ রয়েছে; কিন্তু এখন বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে মুহূর্তে তেলের দাম কমতির দিকে। আসলে প্রকৃত চিত্র কী, তা কারো কাছেই স্পষ্ট নয়। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের কথা বলছেন নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ। পরক্ষণেই অন্য পক্ষ বলছে, আইএমএফের সঙ্গে এমন কোনো ইস্যু নিয়ে আলোচনাই হয়নি। শুধু তা- নয়, বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে নিত্য প্রচারণা চললেও প্রতি বছর খাদ্যশস্য আমদানিতে রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। চাহিদার চেয়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কয়েক গুণ বেশি। কিন্তু লোডশেডিং চলছে। উপস্থাপিত তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া ক্রমে কঠিন হয়ে পড়ছে। মাঝেমধ্যেই একই বিষয়ের বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে দ্বিধান্বিত করে তোলার প্রয়াসও লক্ষণীয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাসহ নানা চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়। অথচ এর প্রত্যেকটির সঙ্গে বাস্তবতার যথেষ্ট ব্যবধান রয়েছে। মূলত মাঠ পর্যায়ে গিয়ে পরিসংখ্যানের সামঞ্জস্যতা পাওয়া যায় না। জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকার যে পরিসংখ্যান তুলে ধরে তার সঙ্গে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ দেশের অর্থনীতিবিদদের হিসাবে বিস্তর ব্যবধান থাকে। বিপিসির লোকসানের বোঝা কমানোর কথা বলে এখন জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো হলো। কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম ছিল তখন দেশে কমানো হয়নি, যুক্তি ছিল এখন লাভ করছে পরে দাম বাড়লে জনগণের চাপ কমাতে মুনাফা থেকে ব্যয় করা হবে। সময়ে এসে সে প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করা হয়নি। গ্যাস খাত উন্নয়নের কথা বলে বিপুল অর্থ জমা করা হলেও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে তা ব্যয় করা হয়নি, বরং উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানির ব্যয় নির্বাহে সেটি ব্যয় করা হচ্ছে। দেশে এখন বিদ্যুৎ চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদিত হচ্ছে। অথচ বিদ্যুৎ সরবরাহের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। সরবরাহের সুব্যবস্থা না করে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করায় অতিরিক্ত বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে। খরচও বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে পরিকল্পনার সুস্পষ্ট অভাব রয়েছে। দেশে পরিসংখ্যান অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। এতে সমন্বয়ের যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি প্রকৃত তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। দেখা গিয়েছে, এক খাতের পরিসংখ্যান, সূচক তথ্য নিয়ে একেক মন্ত্রীরা একেক ধরনের তথ্য উপস্থাপন করছেন। দেশে অর্থের ঘাটতি নেই বলে এক মন্ত্রী বললেও আরেক মন্ত্রী বলেছেন, আমাদের আরো অর্থের প্রয়োজন। এমন বিপরীতমুখী তথ্যের জন্য দেশের প্রকৃত উন্নয়নের সঠিক চিত্র পাওয়া দুষ্কর। এক্ষেত্রে কাগজে-কলমে পরিসংখ্যানগত চিত্র না তুলে ধরে তথ্যনির্ভর চিত্র তুলে ধরা উচিত। এতে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বাংলাদেশের জন্য নানা তথ্য সংগ্রহ উপস্থাপন করে থাকে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেমন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং আরো অনেকেই বিবিএস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু অনেকেই বাংলাদেশের তথ্য বিশেষ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্বের হার নির্ণয়ের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তো গেল তথ্যের অনির্ভরযোগ্যতার কথা। অন্যদিকে বিবিএস দেশের অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, সংকলন এবং সংরক্ষণও করে না। অনেক ক্ষেত্রে বিবিএসের কাছে দায়সারা গোছের কিছু তথ্য থাকলেও তথ্য সংগ্রহে এবং সংকলনে পেশাদারত্বের অভাবে সেই তথ্য ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। বিবিএস ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিপিসিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। এক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে পেশাদারত্ব আনতে এগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে হবে। এর জন্য দরকার সরকারের বিশেষ উদ্যোগ। তথ্য গোপন করে রাখা, ভুল তথ্য উপস্থাপন, সময়ে সময়ে একেক তথ্য একেকভাবে উপস্থাপন ইত্যাদির কারণে এর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। গত কয়েক বছরে দেশের পরিসংখ্যানের মান নিয়ে বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রশ্ন উঠছে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ২০১৪-১৯ সাল পাঁচ বছরে বাংলাদেশে পরিসংখ্যানগত দুর্বলতা আরো তীব্র হয়েছে। দেশের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল ২০১৪ সালে। সে বছর ১০০ পয়েন্টের মধ্যে প্রায় ৮০ পয়েন্ট পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ২০১৯ সালে বাংলাদেশের স্কোর পয়েন্ট কমে ৬২ দশমিক - দাঁড়ায়। মূলত তথ্যের উৎস দুর্বলতা, মেথডোলজিক্যাল দুর্বলতা বা মান নির্ধারণে দুর্বলতা, নির্ভুলতা নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশ করতে না পারার কারণেই ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের তথ্যের মান দুর্বল হচ্ছে। আর দুর্বল পরিসংখ্যানের কারণে পরিকল্পনা প্রণয়ন কঠিন হয়ে পড়ছে, যা কাম্য নয়।

ভারতের তথ্য পরিসংখ্যান নিয়ে এমন নানা অভিযোগ রয়েছে। যদিও ভারতের পরিসংখ্যান ব্যবস্থা নতুন করে সাজানো হয়েছে। শুরুতেই প্রতিষ্ঠানটি এমন ছিল না। ভারত সরকার ১৯৯৯ সালে পরিসংখ্যান বিভাগ কর্মসূচি রূপায়ণ বিভাগ একত্রপূর্বক পরিসংখ্যান কর্মসূচি রূপায়ণ মন্ত্রণালয় গঠন করে। মন্ত্রণালয়ের দুটি শাখা তৈরি করা হয়একটি পরিসংখ্যানসংক্রান্ত অন্যটি কর্মসূচি রূপায়ণ দেখভাল করে। পরিসংখ্যানসংক্রান্ত কার্যক্রম অফিসকে বলা হয় জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস। ভারতের জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস আইএমএফের স্পেশাল ডাটা ডিসিমিনেশন স্ট্যান্ডার্ডস (এসডিডিএস) অনুসরণ করছে। এতে ভারতের পরিসংখ্যানের মান উন্নত হয়েছে। তারা শুধু ডাটা সংগ্রহই করে না, সেগুলো যাচাই পুনর্যাচাই করে তৃতীয় পক্ষের মতামতও গ্রহণ করে। প্রয়োজন হলে সংশোধন ক্রস চেক করে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে। মাঠ পর্যায়ে তাদের রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশাল কর্মী বাহিনী। বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে শক্তিশালী উপদেষ্টা কমিটিসহ প্রতিটি শাখার জন্য ভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটি রয়েছে। তার পরও ভারতের জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারত সরকারের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা দেশটির জিডিপি গণনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, দেশটির জিডিপি প্রায় শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থাকেও শক্তিশালী করতে এক দশকব্যাপী উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, তাতে অবকাঠামোগত উন্নয়নই গুরুত্ব পেয়েছে। কারিগরি, সময়, পরিসংখ্যানের মান, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রভৃতি বিবেচনায়ই আসেনি তেমন। পরিসংখ্যানের মান উন্নত করতে হলে প্রথমেই আন্তর্জাতিক কিছু বিধিবিধান ফর্মুলা অনুসরণ করা আবশ্যক। তাছাড়া তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে তা প্রকাশ প্রতিটি পর্যায়ে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একই কথা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে যাত্রা করছে, সময়ে নির্ভুল তথ্য পরিসংখ্যান জরুরি। পরিকল্পনা গ্রহণ বাস্তবায়নের জন্য নতুন নতুন অনেক বিষয়ের হালনাগাদ তথ্যের চাহিদা বাড়বে। এটি নিশ্চিত করার মতো সক্ষম আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে পরিসংখ্যানের মান উন্নত না হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের চ্যালেঞ্জ আরো বেড়ে যাবে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে তথ্যে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার আরো স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি কাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন। উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য সঠিক তথ্য পরিসংখ্যানের চর্চা গুরুত্বপূর্ণ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন