জ্বালানি তেলের অতিমাত্রায় মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ

জনজীবন, কৃষি ও শিল্প খাতের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে

শুক্রবার রাতে হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। নতুন মূল্যহার অনুযায়ী লিটারপ্রতি ডিজেল কেরোসিনের দাম এখন ১১৪, অকটেনের দাম ১৩৫ আর পেট্রলের দাম ১৩০ টাকা। আগের চেয়ে ভোক্তা পর্যায়ে উল্লেখিত চার জ্বালানি পণ্যের দাম বেড়েছে সাড়ে ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত। করোনার অভিঘাত মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ বেশ কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দুঃসময়ে অতিমাত্রায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি জনজীবন, কৃষি শিল্প খাতের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

গত বছরের নভেম্বরে ডিজেল কেরোসিনের দাম এক দফা বাড়ানো হয়। ওই সময় দুই জ্বালানির দাম লিটারপ্রতি ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৮০ টাকা। আট মাসের ব্যবধানে আবার বাড়ানো হলো জ্বালানি তেলের দাম। তবে তখন পেট্রল আর অকটেনের দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল। এবার সব ধরনের জ্বালানি তেলেরই দাম বাড়ল। সবচেয়ে উদ্বেগের হলো, এবারের মূল্যবৃদ্ধির হারটা অনেক বেশি; প্রায় ৫০ ভাগ। এর প্রভাব হবে সর্বব্যাপ্ত। দেশের মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে। পরিবহন ব্যয় আরেক দফা বাড়বে। এরই মধ্যে পরিবহন মালিকরা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বৈঠকে বসেছে। সিটি বাসের ভাড়া ১৩ শতাংশ আর দূরপাল্লায় ১৬ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া লঞ্চ, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপসহ সব ধরনের পরিবহনের ভাড়াও বাড়বে। স্বভাবত নিত্যপণ্যের দামও আরো বাড়বে। শিল্প খাতের কর্মকাণ্ডেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে বেড়ে যাবে সেচ খরচও। এতে কৃষক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এখন চলছে আমন মৌসুম। ফলে আমন উৎপাদনেও বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে। সব মিলিয়ে জ্বালানি তেলের প্রভাব হবে বহুমুখী।   

রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে উদ্বায়িতা সৃষ্টি করেছে। তৈরি হয়েছে জ্বালানি অনিশ্চয়তা। প্রেক্ষাপটে অনেকেই জ্বালানির ব্যবহার সীমিত করেছে। অনেকে আবার খাতওয়ারি জ্বালানি বণ্টন যৌক্তিকীকরণের চেষ্টা করছে। কেউ কেউ কৌশলগত মজুদ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নিয়েছে। যেমন চীন ভারত রাশিয়ার সস্তা জ্বালানি তেল কিনে বিপুল মজুদ গড়ে তুলছে। বলা চলে, জ্বালানি সংকট মোকাবেলা এবং দামজনিত অভিঘাত থেকে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে দেশগুলো। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।   

গতবারের মতো এবারো সময় না দিয়েই কার্যকর হয়েছে বর্ধিত দাম। আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধির ব্যাখ্যা হিসেবে জ্বালানি মন্ত্রণালয় কিছু কারণ তুলে ধরেছে। প্রথমত বলা হচ্ছে, গত ফেব্রুয়ারি-জুলাই পর্যন্ত জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসি প্রায় হাজার ১৪ টাকা কোটি টাকার ওপরে লোকসান দিয়েছে। ধারা বজায় থাকলে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির লোকসানের বোঝা আরো বাড়বে। দ্বিতীয়ত বলা হচ্ছে, প্রতিবেশী ভারতে জ্বালানি তেলের দাম তুলনামূলক বেশি ছিল। গত মাসের হিসাবে কলকাতায় প্রতি লিটার ডিজেলের দাম বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩৪ দশমিক শূন্য টাকা বেশি ছিল। আর পেট্রলের দাম বেশি ছিল প্রতি লিটার প্রায় ৪৪ দশমিক ৪২ টাকা। পার্থক্যের কারণে জ্বালানি পণ্যের পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মূলত এসব কারণে বর্তমান অবস্থায় অনেকটা নিরুপায় হয়েই নাকি জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন ভিন্ন কথা। সরকার অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চাপে আছে। অবস্থায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে। আইএমএফের ঋণের শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার। হঠাৎ করে বড় মাত্রায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে বৈশ্বিক সংস্থাটির শর্ত পূরণের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন তারা।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। বিধি অনুসারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির এখতিয়ার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নিয়ম হলো জ্বালানি বিভাগ প্রথমে প্রস্তাব পাঠাবে। কমিশন সেটি বিবেচনায় নিয়ে গণশুনানির ব্যবস্থা করবে। গণশুনানিতে সব পক্ষের অংশীজনদের মতামত শোনা হবে। সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজন হলে জ্বালানির দাম সমন্বয় করা হবে। কিন্তু এবার কমিশনকে পাশ কাটিয়ে আকস্মিকভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে যে বড় ধরনের নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে, তা বলা বাহুল্য। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, অন্যান্য দেশেও জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। তবে সেখানে ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অভিঘাতের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মতো কেউ এক ধাপে এতটা মূল্যবৃদ্ধি করেনি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে সরকারকে অবশ্যই দাম বাড়াতে হতো। কিন্তু এক লাফে এতটা বাড়ানো যৌক্তিক হয়নি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, প্রতি লিটার জ্বালানি তেলে ৩০-৩২ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স নেয় সরকার। তা কমালে দাম বৃদ্ধির তেমন প্রয়োজন হয় না। এছাড়া বাজারে দাম কম থাকায় তেল বিক্রি করে আগের বছরে ৪৮ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে সরকারি সংস্থা বিপিসি। যার বেশির ভাগই সরকার নিয়ে গেছে। অর্থ দিয়ে একটা তহবিল গঠন করা হলে সংকটকালে কাজে লাগানো যেত। অথচ সেটা করা হয়নি, এখন যার দায় চাপানো হচ্ছে ভোক্তাদের ওপর।

দেশের জ্বালানি খাতে ব্যাপক অদূরদর্শিতা দৃশ্যমান। দীর্ঘমেয়াদি সুচিন্তিত পরিকল্পনার পরিবর্তে অনেকটা নেয়া হচ্ছে অস্থায়ী কৌশল। আশু সংকট মোকাবেলায় নেয়া হচ্ছে সাময়িক ব্যবস্থা। কিছুদিন আগে সংকটের অজুহাতে গৃহস্থালি শিল্প উভয় পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয় শিল্পোৎপাদন ব্যয়ে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। এবার আকস্মিকভাবে বাড়ানো হয়েছে সব ধরনের জ্বালানি তেল। এর অভিঘাত হবে আরো বিপুল। বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে বিশ্ববাজারে কমলে দাম সমন্বয় করা হবে। কিন্তু সাধারণত দেখা যায়, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়লে বাড়ানো হয়। কমলে আর কমানো হয় না। এর আগে কম দামে আমদানি করে বেশি দামে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করেছে বিপিসি। তখন দাম কমানো হয়নি। কাজেই সামনে কমানোর যে আশ্বাস দেয়া হচ্ছে, তা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক বাজারে এক সপ্তাহ ধরে জ্বালানি তেলের দাম কমতির দিকে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমে ১০০ ডলারের মধ্যে নেমে এসেছে। দর চলতি বছর ৭০-৮০ ডলারে নামতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। সময়ে বরং বাংলাদেশ বিপরীত পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন নানামুখী চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ। কঠিন সময়ে জ্বালানির অতি মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়ে তুলবে। সুতরাং এটা পুনর্বিবেচনা জরুরি। পাশাপাশি বিপিসির মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো এবং জ্বালানি নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত উদ্যোগ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন