বিল পরিশোধে বিলম্ব বিপিডিবির

জ্বালানি তেলের দাম পরিশোধ নিয়ে সংকটে আইপিপিগুলো

মেসবাহুল হক ও আবু তাহের

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ নানা কারণে বিশ্ববাজারে বাড়ছে জ্বালানি তেলের দাম। সেই সঙ্গে ডলার সংকট বাংলাদেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনাকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে তেল আমদানি করতে পারছে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ফলে বেসরকারি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন সংকট তৈরি হয়েছে। সংকট আরো প্রকট হয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কারণে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ে বিল পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে সংস্থাটি। এসব সমস্যার কথা জানিয়ে এরই মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ)

চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং বিপিডিবি বিল পরিশোধে বিলম্ব করায় বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জ্বালানি তেল এইচএফওর বিল পরিশোধ করতে পারছে না। সংকট উত্তরণে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অনুকূলে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লিমিট বাড়ানো প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক যেন পদক্ষেপ নেয় তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বিপিডিপিকে অনুরোধ জানিয়েছে সংগঠনটি।

গত ১৮ মে চিঠি বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং অর্থ বিভাগকেও পাঠায় সংগঠনটি। বিদ্যুৎ বিভাগ বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। তবে চিঠির বিষয়ে এখনো কোনো উত্তর দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিআইপিপিএ চিঠি পাঠানোর পর দেড় মাস পেরোলেও এখনো সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

বিষয়টি জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব সাইফুল ইসলাম আজাদ (উন্নয়ন-) বণিক বার্তাকে বলেন, আইপিপির চিঠির বিষয়টি বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো কিছু জানায়নি।

বিশ্বব্যাপী দাম বাড়ার কারণে টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে জ্বালানি পণ্য আমদানিকারক দেশগুলো।

অবস্থার শিকার বাংলাদেশও। বিশেষ করে ডলার সংকটের কারণে তেল আমদানিতে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে বিপিসি। যার প্রভাব পড়ছে দেশের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে। কারণ দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি হিসেবে যে তেল ব্যবহূত হয় তা বিপিসির মাধ্যমে আমদানি করে বিপিডিবি। এরপর তা সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করা হয়।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং সরবরাহ সংকটের কারণে এরই মধ্যে দেশের বেশকিছু তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন সংকটে পড়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্তমান পরিস্থিতি জানিয়ে গত দেড় মাস আগে বিপিডিবিকে চিঠিও দিয়েছিল সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো।

বিদ্যুৎ বিভাগের এক চিঠি সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি সরবরাহে এবং কেন্দ্র চালু রাখার বিষয়টি জানিয়ে বিপিডিবিকে চিঠি দেয় বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি ইউনাইটেড পাওয়ার। চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় স্থাপিত ৩০০ মেগাওয়াট, পটুয়াখালীতে ১৫০ মেগাওয়াট, জামালপুরে ১১৫ ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) ইস্যু এবং প্রসেস করতে অসমর্থ হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সংকটে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি তেল এইচএফও সরবরাহের জন্য বিপিডিবির পক্ষ থেকে বিপিসিকে অনুরোধ করা হয়।

ওই চিঠিতেই বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির অনুরোধ অনুযায়ী ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লিমিট বাড়ানোর জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করা হয়। যদিও চিঠির বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে ছোট ছোট বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ এসব কোম্পানির পক্ষে একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত সংকট সামাল দেয়া সম্ভব। সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে তা কোম্পানিগুলোর আর্থিক সক্ষমতার বাইরে চলে যাবে।

বিআইপিপিএর সভাপতি ইমরান করিম বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সংকট এবং বিলসংক্রান্ত বিষয়টি আমরা বিদ্যুৎ বিভাগকে জানিয়েছি। একই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আমরা অর্থ বিভাগের সঙ্গে বৈঠকও করেছি। তারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছে এবং দুই মাস সময় চেয়েছে। যেহেতু বিশ্বব্যাপী সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সেই কারণে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে অর্থ বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, এতদিন বাজেট অধিবেশন চলছিল বলে অর্থ বিভাগ থেকে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি। এখন অধিবেশন শেষ হয়েছে, বাজেট পাস হয়েছে। এবার শিগগির তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। তারপর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি লেখা হবে।

উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ কেনাবেচার মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে প্রতি বছরই আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়ে বিপিডিবি। বিদ্যুৎ বিক্রিতে প্রতি মাসে ঘাটতি থাকায় সরকারের কাছ থেকে বড় অংকের সহায়তা নিতে হয় সংস্থাটিকে। আর অর্থ ছাড়ের জন্য অর্থ বিভাগের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় সংস্থাটিকে। তবে বিল বিলম্ব ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লিমিট বাড়ানোর বিষয়ে কোনো সদুত্তর নেই বিভাগটির কাছে।

ক্রয়মূল্যের চেয়ে কমে বিদ্যুৎ বিক্রি করায় সময়ের সঙ্গে বাড়ছে বিপিডিবির দেনা। সরকারের কাছে সংস্থাটির দেনা ৪৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের শুধু দুই মাসের হিসেবে দেখা গিয়েছে, বিদ্যুৎ ক্রয় বিক্রিতে বিপিডিবির ট্যারিফ ঘাটতি হাজার ২১০ কোটি টাকা। টাকা সংস্থাটি ভর্তুকি হিসেবে অর্থ বিভাগের কাছে চেয়েছিল। এসব দায়দেনা সামলাতে না পেরে এরই মধ্যে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়াতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। সে প্রস্তাবের ওপর গণশুনানিও হয়েছে। তবে দাম বাড়বে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন