আইপিপি ও বড় প্রকল্পে চলে যাচ্ছে বিপিডিবির ব্যয়ের ৭৪%

আবু তাহের

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) দেনা বাড়ছে প্রতি বছরই। ভর্তুকি দিয়েও তা কমানো যাচ্ছে না। এর মধ্যেই বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো (আইপিপি) থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনে তা কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। এর সঙ্গে চলতি অর্থবছরে যুক্ত হচ্ছে পায়রা রামপালের মতো যৌথ বিনিয়োগভিত্তিক বড় প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ কেনার ব্যয়ও। সংস্থাটির মোট ব্যয়ের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই এবার চলে যাচ্ছে আইপিপি এসব বড় প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ।

বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ সক্ষমতার প্রায় অর্ধেকই গড়ে অব্যবহূত থাকছে। যদিও সংস্থাটি আইপিপি কুইক রেন্টাল থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতে আইপিপি-নির্ভরতার কারণে একদিকে লোকসানের বৃত্ত থেকে বেরোতে পারছে না বিপিডিবি। অন্যদিকে সংস্থাটির দেনার বোঝাও প্রতিনিয়ত ভারী হয়ে উঠছে।

সংস্থাটির প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ব্যয় নির্বাহের জন্য বিপিডিবির প্রয়োজন হবে ৫৯ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে আইপিপি এবং পায়রা রামপাল থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৭৪ শতাংশেরও বেশি। এর সঙ্গে রেন্টাল কুইক রেন্টালের ব্যয় যুক্ত হলে তা দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ৯১৬ কোটি টাকায়, যা চলতি অর্থবছরের মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৭৭ শতাংশ।

বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারদরে অস্থিতিশীলতার কারণে এখন নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রেও উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। সংস্থাটির প্রাক্কলনে উঠে এসেছে, বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও (নিট) এবার গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থাটির বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিজস্ব ব্যয় ছিল হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়াবে ১১ হাজার ৩০১ কোটি টাকায়।

বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, বিপিডিবির রাজস্ব চাহিদা বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ বিশ্বব্যাপী জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়া। বিশেষ করে এলএনজির মূল্য অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমিয়ে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বেড়েছে। গ্যাস অপেক্ষা জ্বালানি তেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেশি। এতে বিপিডিবির ব্যয়ও বেড়েছে বেশি। চলতি বছর বিপিডিবির রাজস্ব চাহিদা প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপিডিবির রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির বড় কারণ সংস্থাটির নীতিগত ভুল সিদ্ধান্ত। অযৌক্তিক এসব ব্যয় সমন্বয় করতে পারলে বিদ্যুৎ খাতে রাজস্ব ব্যয় না বেড়ে বরং কমত। বিশেষ করে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় কমানো, সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে নীতি গ্রহণ এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসংক্রান্ত চুক্তির সংস্কার করা গেলে বিপিডিবির ভর্তুকির প্রয়োজন হতো না।

বিষয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক . এম শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় করা গেলে বছরে বিপিডিবির হাজার ৭৩২ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিরও প্রয়োজন হবে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। অর্থ সরকারের পকেট থেকে দিতে হয়। অথচ সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর শতাংশ নতুন কর আরোপ, জ্বালানি তেলে শুল্ক-কর অব্যাহতি কয়লায় নতুন করে শতাংশ ব্যয় না বাড়ালে নতুন করে ঘাটতি বাড়ত না।

বিপিডিবি জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে সংস্থাটির রাজস্ব চাহিদা বেড়েছে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় বেড়েছে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ। গত অর্থবছরের তুলনায় এবার শুধু আইপিপি এসআইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ সংস্থাটির ব্যয় বাড়তে যাচ্ছে প্রায় ১০ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে আইপিপি এসআইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা।

বিপিডিবির রাজস্ব ব্যয়ের বড় অংশজুড়ে রয়েছে বাস্তবায়নাধীন কয়লাভিত্তিক দুটি বৃহৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়। এর একটি হলো পায়রায় হাজার ৩২০ মেগাওয়াট রামপালে নির্মাণাধীন একই সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। দুটি প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ চলতি অর্থবছরে বিপিডিবির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে হাজার ৪৬ কোটি টাকা। যদিও দুটি প্রকল্পের একটি উৎপাদনে এলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কবে নাগাদ উৎপাদনে আসবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এছাড়া রেন্টাল কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কিনতে সংস্থাটির ব্যয় হবে হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাবদ ব্যয় হবে হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, দেশে সরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা বেশি থাকলেও বিপিডিবি সেগুলোকে বসিয়ে রেখে আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কিনছে সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছরই বিদ্যুৎ ক্রয় বাড়ছে। এতে সংস্থাটির বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ বিপুল অংকের অর্থ পরিশোধ করছে হচ্ছে। যদিও সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দুই-তৃতীয়াংশই এখন বসিয়ে রাখা হচ্ছে।

বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবদান হবে ৫৬ শতাংশ। বাকি ৪৪ শতাংশ জ্বালানি তেল, কয়লা সৌরবিদ্যুিভত্তিক।

দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। বিপিডিবির সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্লান্ট ফ্যাক্টর মাত্র ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে আইপিপি এসআইপিপিগুলোর প্লান্ট ফাক্টর যথাক্রমে ৬৩ ৭৪ শতাংশ।

অন্যদিকে বিপিডিবির বসিয়ে রাখা নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পেছনেও ব্যয় এখন বাড়ছে। দীর্ঘসময় বসিয়ে রাখলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রাংশের ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে ব্যয়ের অংকও বেড়ে যায়, যা বিপিডিবির রাজস্ব চাহিদার সঙ্গে যুক্ত হয়।

সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিদ্যুতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের রাজস্ব ব্যয়ে সরকার গুরুত্বারোপ করেছে। বিশেষ করে ব্যয় কমাতে এরই মধ্যে নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্টের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ক্রয়ের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে না। একই সঙ্গে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেগুলো নবায়ন না করার নীতিতে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এসব ব্যয় কমাতে পারলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় কমে আসবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন