‘দাঁড়াও, ঢাকা’

আলোকচিত্রে ঢাকার দুনিয়াদারি

মোজাব্বীর হাসান

গত শতাব্দীর শেষ দশকে যখন আমরা গ্রাম থেকে এসে মেট্রোপলিটন ঢাকায় প্রথম পা রাখি, তার আগের ঢাকা ছিল আমাদের চোখে এক স্বপ্নের জগৎ। যেন আমরা তৃষ্ণার্ত ছিলাম ঢাকা দেখার জন্য। আসার পর গানের মতো করে আমরা গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠেছিলাম, ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে অথবা চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া, ঢাকার শহর দেখমু আজ দুইজনে ঘুইরা ঘুইরা। তো সেই ঢাকা শহরে এসে আমাদের আশা পূরণ হয়েছিল, নাকি স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল তা আজ আর নিশ্চিত করে মনেও পড়ে না। হয়তো বলাও যাবে না।

তবে ঢাকাকে আমরা তখন যেমন দেখেছিলামদৃশ্য মানুষ, মানুষ মানুষের মুখ, মানুষের মুখচ্ছবিতে জীবন জীবিকার রেখাচিহ্ন, সে রেখাচিহ্নই যেন ঢাকার গলি রাজপথের রেখাচিত্র। বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির মিশে যাওয়া রাজপথ, আর পথে পথে শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের জীবনের প্যানোরমিক স্থিরচিত্র। আর এসব স্থিরচিত্রেরই দেখা মিলল বশীর আহমেদ সুজনের তোলা আলোকচিত্রে।

যদিও সুজন জানাচ্ছেন, ছবিগুলো মূলত ২০০৬ সালের দিকের এর পরের তোলা। তার পরও আমার স্মৃতিদৃশ্যের সঙ্গে সুজনের সাদাকালো ফ্রেমের মেলবন্ধনে কোনো অসুবিধা হয় না। ছবিগুলো সম্পর্কে সুজনও জানাচ্ছেন, স্থিরচিত্রগুলো মূলত অনেক দিনের স্মৃতি। ডিঙি নৌকাগুলো ভেসে বেড়ায় প্রাণহীন বুড়িগঙ্গায়। শহরজুড়ে আর দেখা যায় না দোয়েল, ফিঙে আর চড়ুইয়ের ঝাঁক। নেই দুপুরের লেইস ফিতা বা সন্ধ্যার হট পেটিস। ফেরিওয়ালার মনিহারি এখন কাচের দেয়ালে বন্দি। সবুজে ঘেরা, উৎসবে ফুরসতে গ্রামে ফেরা আমাদের ঢাকা কখন যেন হয়ে গেল অচেনা দূর উচ্চতার শহর। দাঁড়াও, ঢাকা শিরোনামের প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে সেই নিকটে ফেলে আসা নগর ঢাকার জীবনের চালচিত্র।

.

কোনো এক কিশোর, মিছিলের মুখ কিংবা আকাশে উদ্যত তার হাঁকডাকের হাত, কী যেন বলতে চাইছে, ক্লান্ত পথিকের বিশ্রাম, বাদামতলীর আড়ত, কোনো এক রিকশার গ্যারেজ, মনিহারি দোকানের সদাই, টিন দোতলার ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা হাস্যোজ্জ্বল শিশুদের মুখ কিংবা ফুটপাতে খেলতে বসে যাওয়া টোকাই জীবিকার বিশ্রাম আনন্দ। জাতীয় মসজিদের বহিরাঙ্গনে মুসল্লিদের জুমার নামাজের জমায়েত। এসব অতি সাধারণ চেনা দৃশ্যই আমাদের সামনে হাজির করেছে সুজনের ক্যামেরার প্যানোরমিক ফ্লাশব্যাক। হয়তো একসময় আর ঢাকার রাজপথে দেখা যাবে না টকটক করে বয়ে চলা ঘোড়ার গাড়ি কিংবা শহরতলির এপার-ওপারের খেয়া পারাপার। কিন্তু সে দৃশ্যগুলো বন্দি হয়ে থাকল সুজনের ক্যামেরায়। প্রদর্শনীতে কিউরেটরদের চিন্তা ছবি উপস্থাপনার মুন্সিয়ানায় ছবি প্রদর্শনী নানা মাত্রা পায়। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার লা গ্যালারিতে প্রদর্শিত ছবিগুলো বিন্যস্ত করেছেন কিউরেটর আমিরুল রাজীব নাঈম উল হাসান। নগরে গড়ে ওঠা ক্রমবর্ধমান দালানকোঠার অবয়বে দৃশ্যত এক শহরের বিন্যাসে গ্যালারিতে ছবিগুলো দর্শককে দেখানোর জন্য হাজির করেছেন তারা। কিউরেটরদ্বয় ছবিগুলো সম্পর্কে জানাচ্ছেন, শহরে মানুষ বাড়ে, তার সঙ্গে আবাসনও বাড়ে সমানতালে। দৃষ্টিসীমা ছাপিয়ে ওঠা দালান ধূসর উন্নয়নে সবুজ প্রাণপ্রকৃতি কারোরই দম ফেলার উপায় থাকে না। ক্রমপরিবর্তনের বাক্সে বাক্সে জ্যামিতিক গাঁথুনির যে শহর গড়ে উঠেছে তা বশীর আহমেদ সুজন তার আলোকচিত্রে দেখাতে চেয়েছেন।

.

প্রতিদিনই বদলে যাচ্ছে ঢাকা। ৪০০ বছরের ঢাকার আগে বদল ঘটত ধীরলয়ে। অতিসম্প্রতি জনচাপ যানচাপে শহরের বদল ঘটছে দ্রুতলয়ে। লাফিয়ে লাফিয়ে। জ্যামিতিক হারে। পুরনো শহরের সঙ্গে নতুন ঢাকার বৈসাদৃশ্য ব্যাপক। যেন গতকালের সঙ্গে আজকের মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একটা বছর পেরিয়ে গেলে মনে হয়, যেন ঢাকা ফেলে এসেছে একটা যুগ।

যদি আপনি মনে করেন, ঢাকা মনে হয় আর নিজেকেই নিজে ধারণ করতে পারছে না, ঢাকা হয়তো আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তখন হয়তো কেউ আপনাকে দেখিয়ে দেবে নতুন ঢাকার সুরম্য অট্টালিকা। মেগাসিটির ঝিলিক। তখন হয়তো আপনি আশাবাদী হয়ে উঠবেন। ঢাকাকে নিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচলে দাঁড়িয়ে দেখে আসতে পারেন সুজনের ছবিতে পেছনে ফেলে আসা ঢাকা। দাঁড়াও, ঢাকা

তবে একটা কথা আপনাদের বলে রাখি, ছবিগুলো দেখতে দেখতে আপনি যখন পেছনে ফিরে তাকাবেন, তখন আপনার মনে হতে পারে প্রতিটি ছবির একটি ছোট শিরোনাম এবং ছবি ধারণের সময়কাল উল্লেখ থাকলে ভালো হতো। কেননা এসব ফ্রেমবন্দি স্মৃতিদৃশ্য তো মূলত ইতিহাস বইয়ের উপকরণই।

বশীর আহমেদ সুজন ম্যাপ ফটো এজেন্সির সদস্য। শখ পেশার সমন্বয়ে ছবি তুলছেন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। এর আগে প্রকাশনা যৌথ প্রযোজনার প্রদর্শনীতে সুজনের ছবির অংশগ্রহণ থাকলেও এটিই তার প্রথম একক প্রদর্শনী। দুনিয়াদারি আর্কাইভের আয়োজনে দাঁড়াও, ঢাকা শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনীটি শুরু হয়েছে ১৩ মে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান। প্রথিতযশা আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন ছিলেন অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার পরিচালক ফ্রঁসোয়া ঘ্রোজঁ স্থপতি নুরুর রহমান খান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ধানমন্ডির  আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য প্রদর্শনীটি উন্মুক্ত থাকবে ২১ মে পর্যন্ত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন