বাংলাদেশের ‘গ্রামীণ সংস্কৃতি’ ‘শহুরে’ কিংবা ‘নাগরিক সংস্কৃতির’ কাছে ‘গেয়ো’ হিসেবে পরিচিত। গেয়ো কিংবা ‘ক্ষ্যাত’ প্রত্যয়গুলো অনেকটাই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ব্রিটিশ ভারতে টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকাওলি কর্তৃক প্রণীত ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল বিজ্ঞানভিত্তিক ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার ওপর। এর বাইরের লোকজ চর্চা পরিগণিত হয় ‘কুসংস্কার’ হিসেবে। নিউটনের সূত্র বাদ দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ ‘প্রকৃতি পূজা’ করে, রাতের বেলা গাছের পাতা ছেঁড়ে না, বছরের বিশেষ সময়ে মাছ ভক্ষণ করে না, পুস্তক মাটিতে পড়ে গেলে সেটাকে মাথায় ঠুকে শ্রদ্ধা করে। তাদের দৃষ্টিতে কী আশ্চর্য ধরনের ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ আমরা’?
বিজ্ঞান কিংবা কুসংস্কারের মধ্যকার এ বিভাজনের পেছনে জটিল রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। দীর্ঘকালের চর্চিত সংস্কৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে চলমান সংস্কৃতিকে ‘খারিজ’ করে দেয়ার জন্য শক্তিশালী কর্তৃত্ববাদের প্রয়োজন হয়। এ অস্ত্রগুলো ঔপনিবেশিক শাসকরা অতিসূক্ষ্মভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রয়োগ করেছিলেন। ‘আমরা’ এখনো ঠিক একই পথে হাঁটছি। যে কারণে উচ্চাভিলাষী নাগরিক জীবনের কাছে গ্রামীণ জীবন হয়ে পড়েছে ‘চাষাভুষার সংস্কৃতি’।
আমাদের বৈচিত্র্যময় নদীবেষ্টিত বঙ্গীয় উপত্যকার জনমানুষের কাছে আধুনিক বিদ্যায়তনিক বিজ্ঞানচর্চার প্রয়োজন পড়েছিল কিনা, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে। কারণ নদীর সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের আন্তঃসম্পর্ক এতটাই গভীরে যে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের অতি সুকৌশলে অভিযোজিত করতে শিখেছিল। সেই শিক্ষায় তথাকথিত ‘আধুনিক বিজ্ঞানের’ তেমন কোনো প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। বছরের বিশেষ সময় এ অঞ্চলের মানুষ মাছ ভক্ষণ করে না কিংবা মাছ শিকার না করে বিকল্প খাবার খেত। কেন? এই কেনর উত্তরে এখন জানা যাচ্ছে যে বছরের বিশেষ সময়ে সামুদ্রিক মাছ প্রজননের জন্য মিঠা পানির নদীতে চলে আসে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের গভীর একাত্মতা না থাকলে কী করে এ ধারণা পাওয়া সম্ভব?
স্থানিক পরিপ্রেক্ষিতে চর্চিত জ্ঞান কিংবা লোকায়ত চর্চার এ ধারণাগুলোকে গভীরভাবে জানার জন্য কয়েক বছর ধরে সমতলের আদিবাসী অধ্যুষিত দুটি গ্রামে কাজ করছি। যদিও এই স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক কিছুই অজানা রয়েছে, তবে যা জানতে পেরেছি সেগুলোর গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। সিরাজগঞ্জের ক্ষিরতলা ও জয়পুরহাটের উচাই গ্রামে প্রাথমিক জরিপ থেকে লোকায়ত চর্চা সম্পর্কে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। প্রথম কাজটার কেন্দ্র ছিল আদি পদ্ধতি অনুসরণ করে শিশু জন্মদান প্রক্রিয়া। দ্বিতীয় কাজটার কেন্দ্র ছিল চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভেষজ পদ্ধতির ব্যবহার এবং তৃতীয় কাজটার মূল ফোকাস ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে স্থানীয়দের অভিযোজনের ধারণা ও পদক্ষেপ।
এ তিনটি বিষয়ের মধ্যে আজ শুধু লোকজ পদ্ধতি অনুসরণের মধ্য দিয়ে শিশু জন্মদানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সামান্য কিছু বিষয় উপস্থাপন করছি। যদিও কাজটি পুরোপুরি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কাজটি করতে গিয়ে আমরা খেয়াল করেছি প্রাচীন সময়ের পোড়ামাটির ফলকে যেসব পদ্ধতিতে শিশু জন্মদানের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, সেগুলোর অনেকটাই উচাই ও ক্ষিরতলার আদিবাসী প্রসূতি নারীরা অনুসরণ করেন। চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন যে দাই, স্থানীয়ভাবে তিনি ‘দাইমা’ নামে পরিচিত। একজন দাইমার ওপরে বছরব্যাপী পরিচালিত অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেছে ২০২১ সাল পর্যন্ত শতাধিক শিশু জন্মদানের সঙ্গে তিনি প্রায় ৫০ বছর ধরে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। দাইমার ভাষ্য এবং যাদের শিশু প্রসব করিয়েছেন সেসব নারীর ভাষ্যমতে, সেই দাইমার হাতে এখন পর্যন্ত একটি শিশুরও মৃত্যু হয়নি।
এথনোগ্রাফিক জরিপটিতে গর্ভবতী কয়েকজন আদিবাসী নারীর অবস্থাও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। উল্লেখ্য, বছর দশেক আগে দাইমা যদিও প্রথাগত পদ্ধতির বাইরে আধুনিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তারও অনেক আগে থেকে তিনি আদি পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রসূতির সেবা দিয়ে আসছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেন্দ্রি নামের গাছের পাতা গরম করে প্রসূতির পেটে মালিশ করা, গর্ভে শিশুর শারীরিক অবস্থান বোঝা, এমনকি শিশুটির লিঙ্গীয় প্রেক্ষিত সম্পর্কে ধারণা দিতে সক্ষম সেই দাইমা। কীভাবে? আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, হরমোন পরিবর্তনের কারণে গর্ভবতী নারীর বিশেষ কিছু শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। সেসব পরিবর্তনের ধরন বোঝার জন্য যথেষ্ট অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, যা দ্বারা গর্ভে শিশুর অবস্থান ও লিঙ্গীয় প্রেক্ষিত জানা সম্ভব; সে অভিজ্ঞতা দাইমার রয়েছে।
এমনকি আমরা শুধু শোয়া অবস্থায় শিশুজন্মদান সম্পর্কে জানি, অথচ দাইমা জানেন এ পদ্ধতি ছাড়াও বসে, হাঁটু গেড়ে, দাঁড়িয়ে ইত্যাদি পদ্ধতি অনুসরণ করেও শিশুজন্মদানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। প্রাচীন রোমান পোড়ামাটির ফলক ও প্যানেলে এ ধরনের পদ্ধতির চিত্র অঙ্কিত রয়েছে। এমনকি কুমিল্লার ময়নামতিতে হাঁটুতে ভর করে উল্টোভাবে শুয়ে থাকা অবস্থায় শিশু প্রসবের পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে। যার আনুমানিক সময়কাল প্রায় ৬০০ থেকে ৮০০ খ্রিস্টাব্দ।
প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশে শিশুজন্মদান প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ আদি পদ্ধতি থাকার পরেও আমরা কেন ‘সিজারিয়ান’ পদ্ধতিতে শিশুজন্মদানের দিকে ধাবিত হলাম? বিশ্বের বেশির ভাগ উন্নত দেশে বিশেষ কোনো জটিলতা না ঘটলে সাধারণত সিজারিয়ান পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না, সেখানে ‘আমরা’ কেন আধুনিকতার নামে উল্টো পদ্ধতি অনুসরণ করছি। আমাদের বিজ্ঞ প্রসূতি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এ প্রশ্নের ভালো এবং যথার্থ উত্তর দিতে পারবেন।
উল্লেখ্য, প্রাচীন পদ্ধতিতে শিশুজন্মদান প্রক্রিয়ার ত্রুটির মাত্রা সম্পর্কে আদিবাসী দাইমা যথেষ্ট সচেতন। শিশুজন্মদান থেকে শুরু করে বেড়ে ওঠায় দাইমার পরিচর্যার ক্ষেত্রে চলমান গবেষণাটিতে এখনো তেমন কোনো ত্রুটি চিহ্নিত করা যায়নি। তাহলে আমরা কেন আমাদের লোকায়ত চর্চাকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ কিংবা ‘কুসংস্কার’ হিসেবে খারিজ করে দিচ্ছি? আমরা কোনটাকে ‘বিজ্ঞান’ বলছি, কোনটাকে ‘কুসংস্কার’ বলছি? লোকায়ত জ্ঞানের চর্চা, যা এখনো বিলুপ্ত হয়নি, সেগুলো নিয়ে বিশদ পরিসরে গভীরভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন।
মো. রিফাত-উর-রহমান: শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগ
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ