ধান চাষ

সেচে পানির অপচয় রোধে করণীয়

আবু হেনা ইকবাল আহমেদ

কৃষি, শিল্প নানা ব্যবহারে মাটির ওপরের পানির সঙ্গে বহু বছরের সঞ্চিত মাটির তলার সুপেয় পানিতেও টান পড়ছে। ক্রমে নিম্নগামী ভূগর্ভের পানি উত্তোলন আর কতদিন আয়ত্তে থাকবে, তা ভাবনার বিষয়। স্বাদু পানির প্রায় ৩০ শতাংশ কৃষি খাতে ব্যবহার হয়, যা শিল্পে ব্যবহারের চেয়েও অধিক। আর প্রধান ফসল ধান চাষে পানির ব্যবহার এখন সাংবৎসরিক।

এক ধরনের গভীর পানির ধান বা জলি আমন বর্ষার আগে শুকনো জমিতে বোনার পর বর্ষার পানির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ত। সে পানি কয়েক মিটার বেড়ে গেলে গোড়া পৃথক হয়ে ডুবন্ত কাণ্ডের পর্বসন্ধি থেকে শিকড় গজিয়ে প্রয়োজনীয় রসদ শোষণ করে নিত। পরে হেমন্তের শুকনো জমিতে খড়ের ডগায় সোনালি ধানের শীষ জেগে থাকত। উঁচু জমিতে বোনা আউশ ধান আসত বোনার প্রায় ৬০ থেকে ৭০ দিনের মাথায়। পানির চাহিদা প্রায় পুরোটাই জোগাত বৃষ্টিপাত। বৃষ্টিনির্ভর বোনা আমন ধানে শেষ দিকে বৃষ্টির পানির অভাবে খাল-বিল থেকে সম্পূরক সেচ দিতে হতো যৎসামান্য। দেশের হাওর এলাকায় বোরো নামের আরেক ধরনের দেশীয় ধান হতো, রবি মৌসুমে। বর্ষার পানি আসার আগেই তা ঘরে উঠে যেত।

ষাটের দশকে অধিক উৎপাদনের স্লোগান নিয়ে আসে সবুজ বিপ্লব। আসে আইআর; যা প্রকাশ্যে ইরি , ইরি , ইরি ২০ প্রভৃতি রবি মৌসুমের উফশী ধান। এর পুরো ফলন নির্ভরশীল সেচ, রাসায়নিক সার, বালাইনাশক যত্নের ওপর। এখন দেশের ৬০ শতাংশ চালের জোগান আসে উফশী হাইব্রিড বোরো থেকে। ৩০ শতাংশ উফশী রোপা আমন ১০ শতাংশ উফশী রোপা আউশ থেকে আসে।

বর্ষার অতিবৃষ্টি, বন্যা বা খরায় আউশ আমন ফসল প্রায়ই মার খায়। সে তুলনায় রবি মৌসুমে প্রাকৃতিক বিপর্যয় কম থাকায় সেচনির্ভর বোরো ধান, গম প্রভৃতি ফসল নির্বিঘ্নে ঘরে তোলা যায়। বিশেষজ্ঞদের এসব চমকপ্রদ কথায় পরামর্শে আর বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় দেশে শুরু হয় মেগা সেচ প্রকল্পগুলো। গঙ্গা, কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প (জিকে প্রজেক্ট), ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) প্রকল্প, উপকূলীয় বেড়িবাঁধ প্রকল্প, ব্রহ্মপুত্র ডান তীরবর্তী বেড়িবাঁধ প্রকল্প, চাঁদপুর সেচ প্রকল্প, মেঘনা-ধনাগোদা প্রকল্প, গোমতী নদীতীর বাঁধ প্রকল্প, মুহুরি সেচ প্রকল্প, তিস্তা বাঁধ প্রকল্প, বরিশাল সেচ প্রকল্প প্রভৃতি নদীভিত্তিক সেচ প্রকল্প। চালু হয় উত্তরাঞ্চলে গভীর নলকূপের বিশেষ প্রকল্পগুলো। দেশব্যাপী গভীর নলকূপ অগভীর নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ সেচ ব্যবস্থা বাড়তে থাকে। সঙ্গে সেচযন্ত্র কেনায় প্রায় ৭৫ শতাংশ ভর্তুকি অনুপ্রেরণা। পরে স্থানীয় সরকারের বাঁধ, স্লুইস গেট প্রভৃতি অবকাঠামো স্থাপনা বাস্তবায়ন হয়। এগুলোর বেশির ভাগই পরবর্তীকালে পরিবেশের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে উঠে।

 উল্লেখ্য, বোরো ফসল অধিক সূর্যকিরণ ভোগ করে ফলন বেশি প্রদানে সক্ষম হলেও সেচে ব্যয় হয় আবাদ খরচের বিরাট অংশ। এতে ধান উৎপাদনে মূল্যবান পানির মূল্য ধরা হয় না, ধরা হয় উত্তোলন ব্যবস্থাপনা খরচ।

সাধারণত প্রতি কেজি আধুনিক উচ্চফলনশীল ধান উৎপাদনে গড়ে হাজার ৫০০ লিটার পানির প্রয়োজন হিসেবে ধরা হয়। যদিও তা মৌসুম, জমির ধরন, জাত প্রভৃতির ওপর নির্ভরশীল। তবে কৃষক পর্যায়ে ব্যবহূত পানির পরিমাণ এককথায় -মাপা।

সেচ নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কৃষকের হাতে থাকে, কিছুটা থাকে না। জাত, মৌসুম, মাটির ধরন, আইল তাতে ইঁদুর-কাঁকড়ার দাপট, আবহাওয়াসেচযন্ত্রের সক্ষমতা, পানি পরিবহনের দূরত্ব, নালার প্রকৃতি, আগাছার প্রাদুর্ভাব, প্রস্বেদন, সেচনালা আইল উপচানো, নিচে চুয়ানো উদ্বায়ন প্রভৃতি।

সেচ যন্ত্রের মালিকরা নির্দিষ্ট মাপের জমির জন্য মৌসুমের পুরো টাকাই গ্রহণ করেন। কৃষকরাও ভালো ফলনের আশায় না জেনেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি জমিতে আটকে রাখেন। পানি উত্তোলনে চাপ পড়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল খরচের ওপর। অপচয়ের কারণে সেচাধীন জমির পরিমাণ কমে যায়। বাড়ে ধানের উৎপাদন ব্যয়। অনেকটা আড়ালেই থেকে যায় পানি অপচয় প্রসঙ্গ।

কৃষিকাজে চাহিদার মাত্র ২৫ শতাংশ পানি ভূপৃষ্ঠ বাকি ৭৫ শতাংশ ভূগর্ভ থেকে উত্তোলিত হয়। কিন্তু অর্ধশতাব্দী আগে চাষাবাদের জন্য ভূপৃষ্ঠ থেকে ৮০ শতাংশ এবং ভূগর্ভ থেকে মাত্র ২০ শতাংশ পানি ব্যবহার করা হতো।

বোরো ধান ছাড়াও গম, ভুট্টা, আলু, ডাল, বিভিন্ন রবি ফসল, আমসহ নানা ফলবাগান এমনকি মাছ চাষেও সেচ প্রয়োজন। ক্রমে ভূপৃষ্ঠ নলকূপের পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। অনেক এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানিতে ভারী ধাতব পদার্থ, যেমন আর্সেনিক, সিসা, লোহা বিভিন্ন খনিজ লবণ মিশে সেচের অনুপযোগী করে তুলছে। সময় এসেছে ভূগর্ভস্থ পানির হিসাব করে উত্তোলনের। ভূমির ওপরের স্তরে পানি না বাড়লে এবং বৃষ্টির পানি ধরে না রাখলে নিচের পানিভরণে ঘাটতি পড়বে। এতে ভয়াবহ পানি সংকটে পড়বে দেশ।

রোপা আমন রোপা আউশ উৎপাদনে আধুনিক জাত এলাকা বাড়াতে হবে। বন্যা খরাপ্রবণ, তাপ বা লবণসহিষ্ণু নতুন জাত এলাকা সম্প্রসারণের উদ্যোগ প্রয়োজন। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার উৎস তৈরি, নদী-নালা খনন পরিবেশবান্ধব বড় বড় জলাশয় তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে সেচ দক্ষতা।

যথাস্থানে যথাযথ প্রযুক্তি অনুসরণ করে সেচের পানির অপচয় কমিয়ে এর দক্ষতা বাড়ানো যায়। যেমন ধান রোপণ যন্ত্রে চাষাবাদের জন্য ট্রে বা বিশেষ পদ্ধতির শুকনো বীজতলাকরণে পানি সময়ের অপচয় কমে। ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগের আগে এবং ধান কাটার দুই সপ্তাহ আগে থেকে জমির পানি ধীরে ধীরে কমানো। আগাছা নিয়ন্ত্রণে কুশি গজানো অবস্থায় বেশি পানি ধরে না রাখা। হালকা বুনটের মাটিতে বোরো ধান চাষ না করে গভীর শিকড়সম্পন্ন এবং কম সেচ প্রয়োজন তেমন শস্য আবাদ। উল্লেখ্য, আফ্রিকার খরাসহিষ্ণু নেরিকা ধান আবাদ এখানে ফলপ্রসূ করা যায়নি।

আবাদকাল আগ-পিছুকরণ: রোপা আমন ধানের জাত ২৫ জুলাইয়ের আগে রোপণে সেচ খরচ বাড়ে এবং ১৫ সেপ্টেম্বরের পরে রোপণে ফলন কমে যায়। জাতভেদে বোরো ধানের জাত আগাম না করে যেখানে সম্ভব আগাম আলু ফসল তোলে আউশ মৌসুমের আগে বোরো ধানের আবাদ করে সেচের পানি সাশ্রয় করা যায়।

আমন ধান উৎপাদনে সম্পূরক সেচ নিশ্চিত করা: খরাপ্রবণ এলাকায় আমন ধানের সম্পূরক সেচ নিশ্চিত করে অধিক উৎপাদনের মাধ্যমে বোরো চাষ এলাকা কমিয়ে আনা যায়। এতে আয়-ব্যয় অনুপাত প্রায় :; যা বোরো ধান উৎপাদন থেকে সাশ্রয়ী।         

জমিতে ছোট পুকুর খনন করে খরা পরিস্থিতি মোকাবেলা

কম বৃষ্টি বর্ষণ এলাকায় রোপা আমন ধানের জমির কোনায় এর শতাংশ পরিমাণে দুই মিটার গভীর মিনি পুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে খরাকালে সম্পূরক সেচ দিয়ে ধানের আশানুরূপ ফলন নিশ্চিত করা যায়। এর আয়-ব্যয় অনুপাত প্রায় :১।

আইল সুরক্ষা করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: সাধারণ বৃষ্টিপাতসম্পন্ন এলাকায় জমির আইল ১৫ সেন্টিমিটার উঁচু রেখে বৃষ্টির পানি উপচানো পার্শ্বপ্রবাহ কমিয়ে রোপা আমনের শেষ দিকে পানি সংকট কিছুদিনের জন্য এড়ানো যায়। এতে আয়-ব্যয়ের অনুপাত প্রায় .২৫:১।

ফসলি জমিতে জৈব উপাদান বৃদ্ধি: জৈব উপাদান মাটির পানি ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে এর প্রাপ্যতা দীর্ঘস্থায়ী করে। খরাপ্রবণতা কমায়। এজন্য কয়েক বছর পরপর শস্য পর্যায়ের মাধ্যমে সবুজ সারের জোগান বা সম্ভব হলে ডাল বা পাট চাষ করা উত্তম।

সুদৃঢ় সেচনালা তৈরি: গভীর অগভীর নলকূপ এলকায় সনাতন পদ্ধতির মাটির সেচনালা সুদৃঢ় করে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পানির অপচয় রোধ করা যায়। এর আয়-ব্যয়ের অনুপাত প্রায় .:১।

একান্তর সেচ বা এডব্লিওডি পদ্ধতি: ধান উৎপাদনে একান্তর বা এডব্লিউডি পদ্ধতি পানি সেচের অন্যতম সাশ্রয়ী প্রযুক্তি। জমিতে পর্যায়ক্রমে ভেজানো শুকানোর মাধ্যমে ধানক্ষেতে প্রয়োজনমতো কম সেচ দিয়ে ২৮ থেকে ৩০ ভাগ পানি সাশ্রয় সম্ভব।

জমিতে টানা দাঁড়ানো পানি না রাখা: ধান রোপণের পর ১০ থেকে ১২ দিন ছিপছিপে পানি রাখলে কুশির সংখ্যা বাড়ে। এরপর থেকে সেন্টিমিটার দাঁড়ানো পানি রাখলে আগাছা অবাঞ্ছিত কুশি গজানো কম হয়। দাঁড়ানো পানি শুকিয়ে গেলে এর তিনদিন পর বা জমি চুল পরিমাণ ফাটা অবস্থায় পুনরায় সেচ দিয়ে ২৫ শতাংশ পানির অপচয় কমানো যায়।

অগভীর নলকূপে রাবারের চেক ভাল্ব সংযোজন: অগভীর নলকূপে সঠিকভাবে রাবারের চেক ভাল্ব সংযোজন করলে প্রাইমিংয়ের ঝামেলা দূর করে বেশ কয়েক বছরের সেচের সময় পানির অপচয় রোধ সম্ভব।

অগভীর নলকূপের বিতরণ ব্যবস্থায় প্লাস্টিক পাইপ সংযোজন: অগভীর নলকূপে প্লাস্টিক পাইপ সংযোজন করে অসমতল অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতেও সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করা যায়। এতে প্রায় ২০ শতাংশ সেচ এলাকা বাড়ে এবং সেচের পানির ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পরিবহন অপচয় কমে। এর আয়-ব্যয়ের অনুপাত প্রায় :১।

গভীর নলকূপের বিতরণে পিভিসি পাইপ সংযোজন: গভীর নলকূপের বিতরণে পিভিসি পাইপ সংযোজন করলে পরিবহন অপচয় প্রায় শূন্যে নেমে আসে, সেচাধীন জমির পরিমাণ ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। এজন্য স্বল্প মূল্যে পিভিসি পাইপ, ক্রস, টি বেন্ড ক্যাপের প্রয়োজন। অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতেও সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করা যায়। প্রতি বছর সেচনালার জন্য মেরামতের খরচ কমে আসে।                                                        

বারিড পাইপ বা মাটির গভীরে সেচনালা স্থাপন: গভীর নলকূপ বারিড পাইপ ব্যবস্থায় এনে দীর্ঘমেয়াদে পরিবহন অপচয় রোধ সম্ভব। এতে খোলা সেচনালা পরিবহন অপচয় না ধাকায় সেচাধীন জমির পরিমাণ প্রায় শতভাগ বাড়ানো যায়। বিএডিসি ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছে।

রবি মৌসুমে গভীর নলকূপ প্রায় ৩৮ হাজার এবং অগভীর নলকূপ প্রায় ১৭ লাখ হরদম চালু থাকে। সময়ে আরো নানা কাজে পানি উত্তোলন করা হয়। উন্নত প্রযুক্তিতে বিপুল পরিমাণ ধানের জমির সেচ অপচয় কমিয়ে, সেচ দক্ষতা বাড়িয়ে, জ্বালানি খরচ সাশ্রয় করে উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো সময়ের দাবি। সে লক্ষ্যে হাতের নাগালে থাকা লাগসই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের জন্য পানি সংরক্ষণে আশু উদ্যোগ নেয়া  প্রয়োজন।

শেষ করতে চাই নিকটতম সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলোয় পানি সংকটের কয়েকটি খবর দিয়ে।

ভারতে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র সিন্ধু নদের অববাহিকায় পানি অনেক আগে থেকেই শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে।

পাকিস্তানে ১৯৪৭- জনপ্রতি পানির প্রাপ্যতা ছিল হাজার ৬০০ কিউবিক মিটার, তা হ্রাস পেয়ে বর্তমানে হাজার ৩৮ কিউবিক মিটারে নেমে এসেছে। ইরানে তীব্র পানি সংকটের বিক্ষোভে মানুষ মারা গেছে।

আমাদের পাহাড়ি এলাকা, উত্তরাঞ্চল দক্ষিণাঞ্চলের পানির মান প্রাপ্যতা সংকটের কথা মোটামুটি সবারই জানা। জনগণও পানি নিয়ে খুব একটা সুখে নেই। গভীর সংকটকাল ঘনিয়ে আসার আগে সর্বক্ষেত্রে পানি ব্যবহারে আরো মিতব্যয়ী সাশ্রয়ী হতে সবার এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি।

 

আবু হেনা ইকবাল আহমেদ: কৃষিবিদ; সাবেক পরিচালক

বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, কৃষি মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন