কৃষিজমি সংরক্ষণ করে উন্নয়নের নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর

কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন দ্রুত পাস করা হোক

কৃষিজমি প্রতি বছর কমছে। বাড়ছে জমির ওপর মানুষের চাপ। শিল্পায়ন, নগরায়ণ অবকাঠামো নির্মাণেও জমির প্রয়োজন। আবার বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এমন এক পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব খাদ্য দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আবারো কৃষিজমি সংরক্ষণ করে উন্নয়নের নির্দেশনা দিয়েছেন। এর আগে তিনি একাধিক দফায় দুই তিন ফসলি জমি সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক সময়োপযোগী। এর মাধ্যমে তিনি কৃষিজমি সুরক্ষায় নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তাও দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে কৃষিজমি সুরক্ষা ভূমি ব্যবহারে পরিপূর্ণ একটি আইন বিধিমালা এখনো প্রণয়ন করা যায়নি। ভূমি মন্ত্রণালয়ে আটকে রয়েছে এটি। আইনটি দ্রুতই পাসপূর্বক প্রয়োগে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি জনগণের আয় বাড়ছে। ধরনের পরিস্থিতি খাদ্য চাহিদা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেবল পরিমাণে নয়, গুণ-মানেও উন্নত খাদ্য চাইছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। তারা ভাতের সঙ্গে ডাল-সবজি-মাছ-ডিম-মাংস-দুধ-ফল চাইবে। জনগণের বহুমুখী চাহিদা জমি থেকেই পূরণ করতে হবে। আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে স্বাভাবিক নিয়মেই আমাদের নগর যোগাযোগ অবকাঠামো সম্প্রসারিত হতে থাকবে। কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ধরনের সুবিধা বেড়ে চলবে। গ্রামের তুলনায় শহরবাসীর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। প্রতিটি কার্যক্রমের জন্য চাপ পড়ছে জমির ওপর। তাই কৃষিজমি সুরক্ষার বিকল্প নেই। কৃষিজমি সুরক্ষা ভূমি ব্যবহার নিয়ে প্রথম আইনের খসড়া হয় ২০১১ সালে। এরপর ১০ বছর কেটে গেছে। কিন্তু চূড়ান্ত হয়নি কৃষিজমি সুরক্ষা ভূমি ব্যবহার আইন। রকম একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন এবং তা মানার বাধ্যবাধকতা নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। সত্য বটে, বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে এবং শহর-বন্দরসহ নানা স্থানে শিল্প-কারখানাসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে। তবে এসবের অধিকাংশই অপরিকল্পিত, ভূমির ব্যবহার যথেচ্ছ এবং কোথাওবা অবৈধ। সরকারি খাসজমি এমনকি জলাশয়, নদ-নদী দখল করেও চলছে নির্মাণ পর্বের দক্ষযজ্ঞ। ভূমির পরিমাণ যেহেতু সীমাবদ্ধ সীমিত, সেহেতু তা অবশ্যই পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবহারের দাবি রাখে। সেটাও হতে হবে সুষ্ঠু, সমন্বিত, সর্বোপরি পরিবেশবান্ধব। নতুন ভূমি আইনে তা নিশ্চিত করা গেলে একদিকে যেমন জমির অপরিকল্পিত ব্যবহার রোধ হবে, অন্যদিকে সুনিশ্চিত হবে উন্নয়নের গতি।

বিশ্বের অনেক দেশেই কৃষিজমি সুরক্ষিত করে নগরায়ণ শিল্পায়ন করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় খাল কেটে মরুভূমিতে ফসল ফলানো হচ্ছে। ভিয়েতনামে এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে জমির ওপর দিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করে কৃষিজমি রক্ষা করা হচ্ছে। এর বিপরীতে প্রকৃতিগতভাবে আমাদের দেশ কৃষি উপযোগী এবং কোনো ধরনের চাষ ছাড়াই বীজ ফেলে রাখলে গাছ জন্মে যায়। কোনো কোনো জমিতে বছরে দুবারের অধিক ফসল ফলানো যায়। এমন উর্বর দেশ পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। অথচ বছরের পর বছর ধরে প্রকৃতির অপার দান স্বেচ্ছায় বিনষ্ট করা হচ্ছে। যেখানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি উদ্বৃত্ত ফসল রফতানি করার অপার সুযোগ রয়েছে, সেখানে কৃষিজমি ধ্বংসের প্রক্রিয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশে ভূমি অনুযায়ী লোকসংখ্যা অনেক বেশি। প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ মানুষ বাড়লেও, কৃষিজমি শতাংশ বাড়ছে না। বরং মোট আয়তনের শতাংশ জমি কমে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সমুদ্রে দ্বীপ এবং নদীতে চর জেগে ওঠার কথা শোনা গেলেও সেগুলো কবে চাষযোগ্য হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। ফলে আমাদের বিদ্যমান কৃষিজমির দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে। এসব জমি যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, তবে সংকট যে তীব্র হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহ নেই।

কৃষিপ্রধান দেশে কৃষিজমি সুরক্ষার কোনো আইন নেই ভাবতেই অবাক লাগে। যে যার মতো করে কৃষিজমিকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে। জমির শ্রেণীকরণ না থাকায় চিহ্নিত করা যাচ্ছে না কৃষি শিল্পের জমি। জমির সিএস, আরএস বা বিআরএসে কোথাও উল্লেখ নেই যে জমিটি কৃষিজমি না অন্য কোনো জমি। জমির ধরনে যেটা উল্লেখ থাকে সেটি হলো নামা, বিলউঁচু বা কান্দা, বাড়ি ইত্যাদি। জমির সর্বশেষ যে মাঠ পর্চাটি বাংলাদেশ সরকার তৈরি করেছে যেটি বিআরএস নামে পরিচিত, সেখানেও জমিকে ভূমির বন্ধুরতা অনুযায়ী শ্রেণীকরণ করা হয়েছে, জমির উপযোগিতা বিবেচনা করে নয়। এতে একজন কোম্পানির মালিককে কৃষিজমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। এসব কোম্পানি কৃষিজমিতে শিল্প-কারখানা স্থাপন করে বিশাল অঞ্চলজুড়ে কৃষি পরিবেশ নষ্ট করছে। রাসায়নিক দূষণের ফলে শিল্প-কারখানার আশপাশের কৃষিজমির উৎপাদনশীলতা স্থায়ীভাবে হ্রাস পাচ্ছে। রাতারাতি নদী-নালা, খাল-বিল, ডোবা ভরাট করে কৃষিজমির স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করছে। এসব বন্ধ করতে হবে।

জমির প্রকৃতি জমির ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে ল্যান্ড ব্যাংক তৈরি করা এবং উন্নয়নের ইস্যু-তে তা যথাযথভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। অর্থাৎ, উর্বর কৃষিজমিতে যথাসম্ভব হাত না দিয়ে বিকল্প জমিতে শিল্প আনুষঙ্গিক উন্নয়নমূলক কাজ করা এবং যে জমি যে কাজের জন্য সর্বাধিক উপযুক্ত সেই জমিকে সেই কাজেই ব্যবহার করা। কিন্তু ল্যান্ড ব্যাংক তৈরিই একমাত্র সমাধান নয়। কারণ পরিবহনসহ পরিকাঠামো উন্নয়ন জরুরি ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োজনে কৃষিজমির ব্যবহার করতেই হবে। ঠিক ততটুকুই, যতটুকু না করলে নয়। প্রয়োজন জমি জমি-সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে একটি কম্বাইন্ড ডাটা ব্যাংক তৈরি করা, যাতে ইউনিয়ন স্তর থেকে রাষ্ট্রীয় স্তর পর্যন্ত জনসংখ্যা, জমির ব্যবহার কৃষি উৎপাদন সম্পর্কিত তথ্যাবলি কালানুক্রমিক চিত্রটি সুস্পষ্ট রূপে ধরা পড়ে এবং পরিকল্পনা তার রূপায়ণের কাজে সহজে ব্যবহার করা যায়।

প্রতি বছর দেশের জনসংখ্যায় যোগ হওয়া নতুন মুখের জন্য সাড়ে তিন লাখ টন বাড়তি চালের দরকার হয়। একদিকে খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া এবং অন্যদিকে কৃষিজমি কমে যাওয়া রীতিমতো উদ্বেগজনক ব্যাপার। অবস্থায় জমির পরিকল্পিত ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। সীমিত আয়তনের বাংলাদেশে জমি খুবই মূল্যবান, এখানে ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রতি ইঞ্চি জমি হিসাব করে ব্যবহার করতে হবে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন নগরায়ণের কারণে দেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। আবাদি জমি কমে যাওয়ার কারণে বছরে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন কম হচ্ছে। আবাদি জমি যেভাবে কমছে, তাতে দেশে আগামীতে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। তাই সারা দেশে জমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জমির পরিকল্পিত ব্যবহারের বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা সচেতনতা দরকার। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে দেশে সংরক্ষিত কৃষিজমি বনভূমির পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। সেই সঙ্গে উন্নয়ন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আওতায় আনতে হবে।

কৃষিজমি রক্ষায় সরকারকে সুনির্দিষ্ট আইন দ্রুত প্রণয়ন বাস্তবায়ন করতে হবে। এক যুগ ধরে কৃষিজমি সুরক্ষা ভূমি ব্যবহার আইন ঝুলিয়ে রাখার অর্থ হচ্ছে, কৃষিজমিকে হারিয়ে যেতে দেয়া। এটা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, আবাসন অবকাঠামো নির্মাণের রাশ টেনে ধরতে হবে। কৃষিজমি বাঁচিয়ে পরিকল্পিতভাবে এসব কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা দরকার। যে জমি থেকে মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ হয়, সে জমি যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট খসড়া আইনে বলা হয়েছিল, সব কৃষিজমির ওপর কৃষক কৃষিজীবীদের অধিকার থাকবে। এখন দুটি কাজ জরুরি। এক. আইনটি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন অনুমোদন; দুই. আইনের বাস্তবায়ন। আইন চূড়ান্ত করার কাজে সংশ্লিষ্ট সবার মতামত গ্রহণের প্রয়োজন পড়বে। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা জানাও গুরুত্বপূর্ণ। আইনের বাস্তবায়নের কাজ কঠিন হবে তাতে সন্দেহ নেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে দেশ খাদ্যে উৎপাদন বাড়ছে, তবে যেভাবে অলক্ষ্যে কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে, তাতে সংকট দেখা দিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। দেশের মানুষের খাদ্য সংস্থান যে জমি থেকে হয়, তা রক্ষায় সরকারকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন