মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মধ্যে সাম্প্রতিক কিছু ইস্যু নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। নিয়ন্ত্রকদের সমন্বয় সভায় কিছু বিষয় উঠেও এসেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে এমন মতভেদ নতুন নয়। আগেও বিভিন্ন ইস্যুতে এক হতে পারেনি তারা, যার প্রভাব অতীতে আর্থিক খাতের পাশাপাশি পুঁজিবাজারেও পড়েছে। এবার যেন তেমনটি না ঘটে, তার জন্য আগে থেকেই বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যেসব ইস্যুতে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে সেগুলো সমাধানে নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। নইলে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়ে। কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কথা শুনবে আর জরিমানা দিতে হবে এসব বিষয়েই তাদের তটস্থ থাকতে হয়। ফলে দ্রুতই দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতবিরোধ নিষ্পত্তি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ও উদ্যোগ নিতে পারে। বিষয়গুলো আইনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের সঙ্গে সম্পর্কিত। কোনো অস্পষ্টতা থাকলে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণ এবং বৃহত্তর স্বার্থে আইন বা বিধিবিধানে সংশোধনও আনা যেতে পারে। তবে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক না কেন, তা যেন কোম্পানি, বিনিয়োগকারী, বাজার সবার জন্য টেকসই সুফল বয়ে আনে।
পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরেও বিভিন্ন খাতের কোম্পানি তালিকাভুক্ত। আইন ও বিধিবিধানে কিছু অসামঞ্জস্য থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে মতদ্বৈধতা তৈরি হচ্ছে। কোম্পানিগুলো উভয়ের নির্দেশনা মানতে গিয়ে জটিলতায় পড়ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঞ্জীভূত লোকসান বিদ্যমান থাকলেও সংশ্লিষ্ট বছরের অর্জিত মুনাফা থেকে নগদ লভ্যাংশ সুপারিশ, ঘোষণা ও বিতরণ করতে পারবে বলে ঘোষণা করেছিল বিএসইসি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, বিএসইসির এমন নির্দেশনা ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯৯’-এর ২২ ধারা এবং ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩’-এর ১০ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিএসইসি টেকসই পুঁজিবাজার স্থাপন ও তারল্য সরবরাহের ধারা বজায় রাখতে বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু বিএসইসির এসব নির্দেশনার কিছুু ক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইনের বিদ্যমান ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় তা পরিপালনে উভয়সংকটে পড়ে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার বিএসইসির এক গেজেটে বলা হয়, তালিকাভুক্ত কোনো সিকিউরিটিজের ইস্যুয়ারের কাছে যদি তিন বছর বা বেশি সময় ধরে কোনো নগদ বা স্টক ডিভিডেন্ড বা রাইট শেয়ার অদাবীকৃত অবস্থায় থাকে বা বিতরণ বা বরাদ্দ প্রদান করা না হয়, অথবা লভ্যাংশ কোনো আইপিওর সাবস্ক্রিপশন অর্থ ফেরত দেয়া না হয়, তবে তা পারসেপচুয়াল ফান্ড হিসেবে পুঁজিবাজার স্ট্যাবিলাইজেশন তহবিল নামে ব্যবহূত হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বিএসইসির অদাবীকৃত লভ্যাংশ পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলে জমা দেয়ার বিধান ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১’-এর ৩৫ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংক কোম্পানি আইনানুসারে, ব্যাংক হিসাবে থাকা নগদ আমানতের অর্থ যদি ১০ বছর পর্যন্ত অদাবীকৃত থাকে তাহলে ব্যাংক কোম্পানি আইনানুসারে এ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠিয়ে দেবে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকে এ অর্থ পাঠানোর পর দুই বছরের মধ্যে যদি কোনো দাবি উত্থাপিত না হয় তাহলে এ অর্থের ওপর কারো দাবি থাকবে না এবং সেটি সরকারের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। এ অর্থ তখন সরকারের কাছে ন্যস্ত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিএসইসি বলছে, আমানতকারীর অর্থ ও বিনিয়োগকারীদের অর্থের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে আমানতকারীর অর্থের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বিনিয়োগকারীর বিষয়ে কোনো কিছু বলা নেই। আলোচনার মাধ্যমে এসব জটিলতা নিরসন করা কঠিন নয়। এর জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা ও নিয়মিত আলোচনা। বড় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিলে এমন জটিলতা পরিহার করা সহজ হয়।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে অবণ্টিত ও দাবিহীন লভ্যাংশ সাত বছর পর্যন্ত সাসপেন্ডেড থাকতে পারে। এরপর সেটা চলে যায় বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিলে। কিন্তু বাংলাদেশে এতদিন এ ধরনের কোনো তহবিল ছিল না। এ প্রেক্ষাপটে বিএসইসি যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিয়ে আরো পর্যালোচনা হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামতও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। আস্থা অর্জনের জন্য বিএসইসিকে আরো কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। শেয়ার কেনাবেচা করতে গিয়ে যাতে তহবিলের কোনো লোকসান না হয়, তার জন্য ভারতের আদলে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন প্রণয়ন এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও অডিট কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। বিনিয়োগকারীর পড়ে থাকা অর্থ ও শেয়ার ওই তহবিলে হস্তান্তরের বিষয়টি এখনো অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। এ ধরনের বিধান করা হলে তা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে কিনা, তাও ভাবনার বিষয়। অনেক বিনিয়োগকারী রয়েছেন, যারা শেয়ার রেখে বিদেশে অবস্থান করছেন, বিও হিসাব নবায়নের জন্য কয়েক বছরের টাকাও রাখেন। আবার অনেকেই শেয়ার জামানত রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। কিছু বিনিয়োগকারী রয়েছেন, যারা বছরের পর বছর শেয়ার ধরে রাখেন, শুধু লভ্যাংশ নেন। তাদের কাছে শেয়ার অন্যান্য সম্পদের মতো। এ ধরনের অ্যাকাউন্টে লভ্যাংশ এলে তা অবণ্টিত বা অদাবীকৃত কিংবা অনিষ্পন্ন রয়েছে বলার সুযোগ নেই। বছরের পর বছর লেনদেন না হওয়া এসব বিনিয়োগকারীর শেয়ার ও অর্থ কীভাবে তহবিলে হস্তান্তর হবে, তার একটি যৌক্তিক নিয়ম থাকা উচিত। কোম্পানির অবণ্টিত বা অদাবীকৃত লভ্যাংশ তহবিলে হস্তান্তর নিয়ে কারো কোনো আপত্তি না থাকলেও তিন বছর পড়ে থাকলেই ব্রোকার বা মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে অর্থ বা শেয়ার তহবিলে হস্তান্তর করা নিয়ে আপত্তি রয়েছে কিছু ব্রোকারেজ হাউজের। তাদের মতে, এটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করতে পারে। বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
পুঁজিবাজার সংবেদনশীল জায়গা। এখানে যেকোনো সিদ্ধান্ত দ্রুত বিনিয়োগকারীদের প্রভাবিত করে। পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য এককভাবে কেউ কিছু করতে পারবে না। প্রয়োজন বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও বিএসইসির যৌথ সহযোগিতা। পুঁজিবাজার সম্পৃক্ত কোনো কিছু জারি করতে গেলে বিএসইসির সঙ্গে আলাপ করে নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। ঠিক একইভাবে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বিএসইসিরও উচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে নেয়া। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সহযোগী ভূমিকাই পারে শক্তিশালী আর্থিক খাত গঠন করতে। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, কোনো রেগুলেটরি সিদ্ধান্ত যেন কারো অসুবিধার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। মতবিরোধ এড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে যোগাযোগ আরো বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে আইন ও বিধিমালার মধ্যে যেসব বিষয়ে জটিলতা বা দ্বৈততা রয়েছে, তা নিরসনেরও উদ্যোগ নেয়া দরকার। পুঁজিবাজার উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক বিএসইসি একসঙ্গে কাজ করছে। ফলে পুঁজিবাজারের তারল্য সংকট দূর হয়েছে এবং স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। এ সহযোগিতা আরো সুদূরপ্রসারী করতে বিদ্যমান মতভেদ সমন্বয়ের মাধ্যমে দূর করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও আমানতকারীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। আইনের বাইরে গিয়ে কোনো পদক্ষেপ যেমন নেয়া ঠিক হবে না, তেমনি মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজারের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে এমন উদ্যোগকে সহায়তা জোগাতে হবে। সর্বাগ্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতবিরোধ আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত নিরসন প্রয়োজন, যা মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজার উভয়ের স্থিতিশীলতার জন্য প্রত্যাশিত।
