দেশে বৈদেশিক
মুদ্রা রিজার্ভের
একটি বড়
উৎস রেমিট্যান্স।
বৈদেশিক মুদ্রায়
আসা সব
রেমিট্যান্স যেহেতু
টাকার বিনিময়ে
বাংলাদেশ ব্যাংকে
সমর্পণ করতে
হয় এবং
যেহেতু বৈদেশিক
মুদ্রা কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের ধারণকৃত
আন্তর্জাতিক রিজার্ভের
মজুদে যোগ
হয়, সেহেতু
একটি ভুল
ধারণা জন্মেছে
যে রেমিট্যান্স
এমন এক
ফান্ড, যা
আবশ্যিকভাবে সরকার
হস্তগত করতে
পারে। এ
ধরনের ভুল
ধারণা সৃষ্টি
ও বজায়
থাকার ক্ষেত্রে
দেশে পরিচালিত
আর্থিক ব্যবস্থাই
মূলত সহায়তা
করেছে।
এটা কীভাবে
ঘটে, তা
বোঝার জন্য
প্রবাসী শ্রমিক
থেকে তাদের
পরিবারে রেমিট্যান্স
পৌঁছানোর যাত্রাটা
চিহ্নিত করা
জরুরি। ধরা
যাক, বিদেশী
ব্যাংকের মাধ্যমে
প্রবাসী কর্মীরা
তাদের বাড়ির
নিকটস্থ ব্যাংকের
শাখাগুলোয় ১
বিলিয়ন ডলার
পাঠালেন। কিন্তু
আমাদের দেশের
আর্থিক আইন
অনুসারে সমমূল্যের
বাংলাদেশী টাকার
বিনিময়ে বাণিজ্যিক
ব্যাংকগুলোকে বৈদেশিক
মুদ্রা বাংলাদেশ
ব্যাংকের কাছে
বিক্রি করতে
হয়। যদি
১ ডলার
৮৫ টাকার
সমান হয়,
তাহলে ডলারের
বিপরীতে বাংলাদেশ
ব্যাংকের রিজার্ভ
অ্যাকাউন্টে সংশ্লিষ্ট
ব্যাংকগুলোকে ৮৫
বিলিয়ন টাকা
পরিশোধ (ক্রেডিট)
করতে হবে।
এভাবে বাংলাদেশ
ব্যাংকের সম্পদ
১ বিলিয়ন
ডলার বাড়লে
যুগপত্ভাবে টাকায়
এর দায়ও
(ব্যাংকগুলোর রিজার্ভ)
সমপরিমাণে বৃদ্ধি
পায়। ব্যাংকগুলো
এই পরিমাণ
অর্থ প্রবাসী
শ্রমিকদের পরিবারের
হিসাবে পরিশোধ
করে দেয়।
তারপর পরিবারগুলো
সেখান থেকে
তাদের ইচ্ছা
অনুযায়ী অর্থ
খরচ করে,
তবে তারা
বৈদেশিক মুদ্রা
পায় না;
যা তাদের
প্রবাসী স্বজনরা
পাঠিয়েছিলেন। যখনই
তারা অর্থটা
খরচ করে,
তখন পুুরো
রেমিট্যান্সই পরিবারের
কেনা পণ্য
ও সেবায়
পরিণত হয়।
সেদিক থেকে
চিন্তা করলে
তাহলে রেমিট্যান্স
কীভাবে পুনরায়
সরকার কিংবা
অন্য কারো
খরচ করার
তহবিল হতে
পারে?
রেমিট্যান্স
ও দেশের
অভ্যন্তরীণ আয়ের
মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ
পার্থক্য হলো
প্রথমোক্তটি বৈদেশিক
মুদ্রায় উপার্জিত
আর শেষোক্তটি
দেশীয় মুদ্রায়
উপার্জিত। অভ্যন্তরীণ
বাজারের লেনদেনের
সঙ্গে যুক্ত
করতে বৈদেশিক
মুদ্রাকে দেশীয়
মুদ্রায় রূপান্তর
করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক
যখন সমপরিমাণ
টাকা বাণিজ্যিক
ব্যাংকগুলোর নিজস্ব
হিসাবে ক্রেডিট
করে বৈদেশিক
মুদ্রার রেমিট্যান্স
কেনে, তখন
আবশ্যিকভাবে তা
দেশীয় মুদ্রাই
সৃষ্টি করে।
এই একটি
ক্ষমতা কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের আছে
বৈকি। প্রবাসী
পরিবারগুলোকে দেয়ার
জন্য বাণিজ্যিক
ব্যাংকগুলো মূলত
বাংলাদেশ ব্যাংক
থেকে প্রাপ্ত
অর্থই ব্যবহার
করে। বৈদেশিক
মুদ্রায় রেমিট্যান্স
বাংলাদেশ ব্যাংকের
ধারণকৃত আন্তর্জাতিক
রিজার্ভের মজুদে
যোগ হয়।
আর এগুলো
দেশের মুদ্রা
ভিত্তির বৈদেশিক
সম্পদের উপাদানে
যোগ হয়।
তদুপরি এগুলো
যথার্থভাবেই রেমিট্যান্স
কেনার পর
সৃষ্ট বাংলাদেশ
ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ
রিজার্ভের দায়ের
সঙ্গে মিলে
যায়। কাজেই
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
নিট সম্পদ
বা দায়
অবস্থানে আসলে
কোনো পরিবর্তন
ঘটে না।
তবে আন্তর্জাতিক
রিজার্ভ বিদেশীদের
প্রাপ্য অর্থ
পরিশোধে ব্যবহূত
হতে পারে।
এভাবে এসব
সম্পদ বিদেশী
আউটপুটের ওপর
দেশের দাবি
বা ক্রয়ক্ষমতার
প্রতিফলন ঘটায়।
এটিকেই সাধারণভাবে
দেশের বৈদেশিক
মুদ্রা রিজার্ভে
রেমিট্যান্সের অবদান
হিসেবে ব্যাখ্যা
করা হয়।
কিন্তু
রেমিট্যান্স একাই
রিজার্ভ গড়ে
তোলে না;
বরং অর্থনীতির
সব আয়
ও ব্যয়
এবং আন্তর্জাতিক
মূলধন লেনদেন/বিনিময়
রিজার্ভের পরিমাণ
নির্ণয় করে।
আন্তর্জাতিক রিজার্ভের
প্রকৃতি বোঝার
সহজ উপায়
হলো বাংলাদেশ
ব্যাংক থেকে
প্রকাশিত লেনদেন
ভারসাম্যের টেবিল
পরিবীক্ষণ করা।
এতে দেখা
যায়, চলতি
হিসাবের স্থিতি
ও আর্থিক
হিসাবের স্থিতির
সমষ্টিই হলো
বাংলাদেশ ব্যাংকের
আন্তর্জাতিক রিজার্ভের
সংযোজন। কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের ক্ষুদ্র
একটি মূলধন
হিসাবও আছে,
যা আমাদের
আলোচনার ক্ষেত্রে
কিছুটা উপেক্ষিত
হতে পারে
কিংবা তেমন
কোনো প্রায়োগিকতা
ছাড়াই আর্থিক
হিসাবের সঙ্গে
একীভূত হতে
পারে।
জাতীয়
আয় হিসাব
থেকে এটি
জানা যে
চলতি হিসাবের
স্থিতি হলো
বিনিয়োগের বিপরীতে
জাতীয় সঞ্চয়ের
আধিক্য কিংবা
এটিকে নিট
জাতীয় সঞ্চয়ও
বলা যেতে
পারে। আর
আর্থিক হিসাবের
স্থিতি হলো
সমরূপ আন্তর্জাতিক
মূলধন বহিঃপ্রবাহের
বিপরীতে আন্তর্জাতিক
মূলধন আন্তঃপ্রবাহের
(বৈদেশিক ঋণ
ও বিদেশী
বিনিয়োগ উভয়ই)
আধিক্য। এটি
অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে
বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর
নিট দাবি
কিংবা নিট
আন্তর্জাতিক মূলধন
আন্তঃপ্রবাহের একটি
ব্যাপকভিত্তিক মানদণ্ড।
যেহেতু এসব
মূলধন ও
এর রিটার্নগুলোর
মালিক বিদেশী
উদ্যোক্তারা এবং
শেষ পর্যন্ত
এগুলো বিদেশী
প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিশোধযোগ্য,
সেহেতু আর্থিক
হিসাবের স্থিতিকে
কিছু ক্ষেত্রে
সহজে বোঝার
জন্য দেশের
নিট বৈদেশিক
ঋণ হিসেবে
বিবেচনা করা
যেতে পারে।
এভাবে দেখলে
আন্তর্জাতিক রিজার্ভে
সংযোজন হলো
নিট জাতীয়
সঞ্চয় এবং
নিট বৈদেশিক
ঋণেরই সমষ্টি।
এটা অনেকটা
পরিবারের নগদ
ধারণের সঙ্গে
তুলনাযোগ্য, যা
তাদের নিট
সঞ্চয় ও
নিট ঋণের
অভিপ্রকাশ।
নিট জাতীয়
সঞ্চয়ের সঙ্গে
রেমিট্যান্সসহ সব
আয় এবং
চূড়ান্ত ভোক্তার
ওপর ব্যয়,
পণ্য-সেবায়
বিনিয়োগ, সরকারি
ক্রয়, রফতানি
আয়, আমদানি
দায় পরিশোধসহ
সবকিছু যুক্ত।
১ বিলিয়ন
ডলার রেমিট্যান্স
রিজার্ভে সমপরিমাণ
বৃদ্ধি ঘটায়।
অন্যদিকে ভোগ,
বিনিয়োগ কিংবা
আমদানিতে ১
বিলিয়ন ডলার
হ্রাস রিজার্ভে
সমপরিমাণ মজুদ
বাড়ায়। রফতানি
কিংবা বিদেশী
বিনিয়োগে উল্লম্ফনও
রিজার্ভ বাড়ায়।
এর অর্থ
হলো, শুধু
রেমিট্যান্স নয়,
প্রতিটি লেনদেনই
রিজার্ভের মজুদে
প্রভাব ফেলে।
আন্তর্জাতিক রিজার্ভ
বৈদেশিক মুদ্রায়
ধারণ করা
হয় বিধায়
এটিকে সাধারণভাবে
বিদেশী মুদ্রার
জোগান দাতাদের
অবদান বলে
ভুল করা
হয়।
এটি পরিষ্কার
যে রিজার্ভ
বৈদেশিক ঋণ,
বিদেশে প্রত্যক্ষ
বিনিয়োগ ও
পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্টের
মাধ্যমে স্ফীত
হতে পারে,
যেহেতু এগুলোকে
লেনদেন ভারসাম্যে
ঋণ আইটেম
হিসেবে দেখানো
হয় এবং
তাই সেগুলো
সার্বিক স্থিতিতে
যোগ হয়।
রফতানি কমা
সত্ত্বেও রিজার্ভে
উল্লম্ফনের একটা
কারণ হলো
সহায়তা ও
ঋণের অর্থের
বিপুল আন্তঃপ্রবাহ
এবং রেমিট্যান্স
বৃদ্ধির সঙ্গে
আমদানি কম
হওয়া। অতীতে
অনেকবারই রিজার্ভের
নিম্নমুখিতার সঙ্গে
রেমিট্যান্সের বিপুল
আন্তঃপ্রবাহ দেখা
গেছে। এ
থেকে এটি
স্পষ্ট, আন্তর্জাতিক
রিজার্ভের পুঞ্জীভবন
ঘটাতে রেমিট্যান্স
একাই সাহায্য
করে না,
আরো কিছু
অনুঘটকও এক্ষেত্রে
কাজ করে।
তবে এক্ষেত্রে
রেমিট্যান্সকে অবশ্যই
একটি গুরুত্বপূর্ণ
নির্ধারক বললেও
ভুল হবে
না।
আন্তর্জাতিক
রিজার্ভের বিপুল
মজুদ অস্থিতিশীলতার
কারণ হতে
পারে, যদি
এর বড়
অংশ বিদেশী
মূলধন (ঋণ),
বিশেষ করে
পোর্টফোলিও মূলধন
হয়—খুব
স্বল্প নোটিসে
যা প্রত্যাহার
করা সহজ।
গত চার
দশকের আর্থিক
সংকটগুলো বিদেশ
থেকে আসা
বিপুল নিট
ঋণে (মূলধন
আন্তঃপ্রবাহ) নিহিত
বিপদগুলো দেখিয়ে
দিয়েছে, যার
মধ্যে বিপুল
বাধ্যবাধকতাহীন পোর্টফোলিও
বিনিয়োগের উপাদানও
আছে। শক্তপোক্ত
ফান্ডামেন্টালস থাকা
সত্ত্বেও গত
শতকের শেষের
দিকে এশীয়
আর্থিক সংকটের
সময়ে এশিয়ার
কিছু দেশ
যে অস্থিতিশীল
হয়েছিল, তার
কারণ বিদেশী
মূলধনের গণপ্রত্যাহার।
সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের
আন্তর্জাতিক রিজার্ভের
মজুদের বেশির
ভাগই আমাদের
কষ্টার্জিত নিট
সঞ্চয়। কাজেই
এটি আকস্মিক
বিদেশমুখী প্রত্যাহার
থেকে অনেকটাই
মুক্ত। তবে
সরকারের এক্ষেত্রে
খুব সাবধান
থাকা উচিত,
বিপুল বাজেট
ঘাটতি বা
ব্যক্তি খাতের
বড় মাত্রার
বৈদেশিক ঋণের
কারণে পরিস্থিতি
বেশ দ্রুতই
বদলে যেতে
পারে।
১৯৭০-এর
দশকে বৈদেশিক
শ্রমবাজারের উন্মোচন
কয়েক মিলিয়ন
কর্মীকে বিদেশে
যাওয়ার সুযোগ
করে দিয়েছে,
বিশেষ করে
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে।
কাজেই তাদের
মাধ্যমে বৈদেশিক
মুদ্রায় আসা
রেমিট্যান্স বরাবরই
সংবাদের শিরোনাম
হয়। অবশ্য
এটিই তাদের
একমাত্র কৃতিত্ব
নয়। দেশের
মোট পরিবারের
এক-ষষ্ঠাংশ—যাদের
বেশির ভাগ
তুলনামূলকভাবে নিম্ন
আয়ের পরিবারভুক্ত—রেমিট্যান্সের
মাধ্যমে বড়
ধরনের আয়
সমর্থন পায়,
যা তাদের
জীবনমান উন্নয়নে
সহায়তা করে।
আরো গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় হলো,
দেশের পুরো
শিল্প খাতের
শ্রমশক্তির চেয়ে
বড় একটা
জনশক্তির বিদেশে
কর্মসংস্থান হয়,
যা অভ্যন্তরীণ
শ্রমবাজারে চাপ
অনেকটা কমায়।
সুতরাং এসব
সুফল বিবেচনায়
জনশক্তির বহিঃপ্রবাহ
ও রেমিট্যান্সের
আন্তঃপ্রবাহের ধারাবাহিকতা
বজায় রাখতে
বিশেষ মনোযোগ
দেয়া জরুরি।
এম এ
তসলিম: অর্থনীতির অধ্যাপক
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি