টোকিও অলিম্পিক ২০২১

২ কোটি ৭ লাখ শরণার্থীর প্রতিনিধি ২৯ জন!

ক্রীড়া প্রতিবেদক

২০১৯ সালের বসন্তে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ২ হাজার ৮৮০ জন দৌড়বিদ লড়ছিলেন ১০ কিলোমিটারের এক প্রতিযোগিতায়। এটা প্রতি বছরের নিয়মিত আয়োজন, যদিও এবার ফল হলো অবিশ্বাস্য। এবার যিনি চ্যাম্পিয়ন হলেন তিনি এক এতিম শরণার্থী, দক্ষিণ সুদান থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেন কেনিয়ায়। এমনকি তিনি মাত্র কয়েক বছর আগে প্রথমবারের মতো দৌড়ানোর জুতা পরার সৌভাগ্য অর্জন করেন। 

শরনার্থীদের জীবনে নিশ্চিত বলতে কিছু নেই। কিন্তু পাঁচ বছর আগে অন্তত একটা নিশ্চয়তা মিলে যায়। ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোয় অনুষ্ঠিত ২০১৬ সালের অলিম্পিকে উদ্বোধনী মার্চপাস্টে অন্য সব দলের সঙ্গে ছিল শরনার্থীদের একটি দলও। তারা কোনো জাতির পতাকা নিয়ে মার্চপাস্টে অংশ নিচ্ছিল না, তাদের সামনে ছিল অলিম্পিকের পতাকা। 

ইউনাইটেড নেশন্স হাই কমিশন ফর রিফিউজি (ইউএনএইচসিআর) ও ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) যৌথ উদ্যোগে যাত্রা হয় আইওসি শরনার্থী দলের। ১০ জনের এই দলটি মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগেই সবার হৃদয় জয় করে নেয়। বিশেষ করে যখন মাদক আর বিতর্কে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে লড়াই করছিল বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন, তখন এই উদ্যোগ সবার মনে খানিকটা প্রশান্তি এনে দেয়। 

আগামী ২৩ জুলাই টোকিওর অলিম্পিক স্টেডিয়ামে অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও থাকছে আইওসি শরণার্থী অলিম্পিক দল। এবার শরণার্থী দলের সদস্য ২৯। সারা বিশ্বের নিজ দেশ থেকে অন্য দেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৭ লাখের মতো। এই বিশাল সংখ্যার প্রতিনিধি হিসেবে টোকিওতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন ২৯ জন, যা রিওতে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় তিনগুণ। 

রক্তপাত, ক্ষুধা, দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াইয়ে নিঃস্ব শরণার্থীদের অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্তিতে আরেকবার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়াযজ্ঞের, যা অতীতের অলিম্পিকগুলো কল্পনাও করতে পারেনি। 

এই ২৯ জনের এখন কোনো দেশ না থাকলেও তারা বিশ্বের ১৩টি জাতির প্রতিনিধিত্বকারী, যা টোকিও অলিম্পিকের জন্য অনবদ্য এক অলংকার এবং অলিম্পিকেরও, যে গেমসটি শতবর্ষব্যাপী বিশ্বের জাতিগুলোর স্বাদেশিকতা ও দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে লড়াইয়ের কেন্দ্র ছিল। 

আইওসির শরণার্থী প্রোগ্রাম বিভিন্ন অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সঙ্গে আলোচনার পর অবশেষে ২০১৫ সালে শরণার্থীদের জন্য লড়াই করার দরজা খুলে যায়। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে শরণার্থী মিশনের ডেপুটি হেড অলিভিয়ার নিয়ামকি টাইমসকে বলেছেন, শরনার্থীদের অধিকাংশেরই প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার ছিল না। এটা কেবল অর্থের জন্যই নয়। তাদের এমন কোনো পতাকা ছিল না যা নিয়ে লড়াই করবে।

পরিশেষে শরণার্থী দল তৈরির উদ্যোগ নিতে বলে আইওসি। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে খ্যাতিমান কেনিয়ান রানার তেগলা লোরোপ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পিস ফাউন্ডেশন ট্রেনিং সেন্টার দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কাকুমা শরণার্থী শিবির থেকে সেরা অ্যাথলিট খোঁজার উদ্যোগ নেয়। ১ লাখ ৭০ হাজার শরণার্থীর মধ্য থেকে মেধাবীদের বেছে নিতে লোরোপ ১০ কিলোমিটার রেসের আয়োজন করেন। যারা অংশ নিল তাদের অনেকেরই পায়ে কোনো জুতাও ছিল না, কেউবা জুতা পড়েছে, কিন্তু জার্সি ছিল না। এই রেস থেকে দ্রুততম কয়েকজনকে খুঁজে নিয়ে নিজের ট্রেনিং সেন্টারে কাজে নেমে পড়েন লোরোপ। 

তাদেরই একজন ২৮ বছর বয়সী রোজ নাথিকে লোকোনিয়েন রিওতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, এবার অংশ নেবেন টোকিওতে। লোরোপের ট্রায়াল রেসে তিনি খালি পায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। সেই স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, এমনকি অলিম্পিক কী তাও আমার জানা ছিল না। আমরা টাইমিং সম্পর্কেও জানতাম না। আমরা কেবল দৌড়েছি।

আইওসি প্রেসিডেন্ট টমাস বাখ রিও গেমসের আগে শরণার্থী দল নিয়ে বলছিলেন, বিশ্বব্যাপী যত শরনার্থী রয়েছে আমরা তাদের জন্য একটি আশার বার্তা ছড়িয়ে দিতে চাই। 

নিজ দেশে পরিবার পরিজনের ওপর চলা নিষ্ঠুরতা দেখে আসা এসব শরণার্থীদের একজন গাই জন নিয়াং বললেন, এটা (দৌড়) আমার কাছে ওষুধের মতো। যখন দৌড়াই আমি শান্ত থাকি। 

শরণার্থী দলের অলিম্পিকে অংশগ্রহণ মানে যে দ্রুততম টাইমিং কিংবা সেরা ফল করা, শুধু তা-ই নয়। আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্নে এটাও দেখা প্রয়োজন, তারা যাদের সঙ্গে লড়াই করবেন তারা সারা বছর দেশের পৃষ্ঠপোষকতা ও সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অনুশীলন করে অলিম্পিকের জন্য তৈরি হয়ে থাকেন। এখানে শরণার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের সেখানে থাকা, অংশগ্রহণ করা।

খেলাধুলার ক্ষেত্রে সর্বজনবিদিত ‘অংশগ্রহণেই গৌরব’ কথাটি বোধকরি অলিম্পিক শরণার্থী অ্যাথলিটদের জন্য আরো বেশি প্রযোজ্য।   


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন