ধর্ষণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ও সামাজিক সংস্কৃতির অবয়ব

শীপা হাফিজা

নারীর প্রতি সহিংসতা বিশ্ব সভ্য জগৎ ব্যবস্থার প্রতি কঠোর কশাঘাতস্বরূপ শারীরিক মানসিক নির্যাতন, নারীকে পদে পদে হেয় বা অবমাননা করা, সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা, নারীর অর্জন বেহাত করা, জোর খাটানো, গৃহস্থালি সম্পৃক্ত নারীর কাজকে অবমূল্যায়ন করা, অ্যাসিড দিয়ে মুখ ঝলসে দেয়া, যৌন অন্যান্য নির্যাতন-নিপীড়নের পাশাপাশি নারী তথা মানবসভ্যতার সহিংসতার সবচেয়ে মারাত্মক ভয়ংকর রূপটি বলে বিবেচিত হয় ধর্ষণ ধর্ষণ শিশু পুরুষের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে ব্যক্তির ইচ্ছে বা সম্মতির বাইরে জোরপূর্বক যৌন হেনস্থা বা যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে ধর্ষণ বলা হয় এটি কখনো একক পুরুষ কর্তৃক বা দলবদ্ধভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০০ জনে সাতজন নারী কোনো না কোনোভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, শতাংশ নারী সরাসরি ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন উন্নত অথবা অনুন্নত দেশ, সবখানে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র অমানবিক

আমেরিকায় প্রতি ১০৭ সেকেন্ডে একজন নারী ধর্ষণ অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হন এবং বছর শেষে গড়ে সংখ্যা এসে দাঁড়ায় প্রায় লাখ ৯৩ হাজার শান্তির দেশ কানাডায় প্রতি চারজনে একজন নারী যৌন সহিংসতার শিকার হন, বার্ষিক যা প্রায় লাখ ৬০ হাজার মুক্ত গণতন্ত্রের দেশ গ্রেট ব্রিটেনে প্রতি বছর ৮৫ হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটে

বাংলাদেশও ধর্ষণ প্রবণতার বাইরে নয় যদিও অধিকসংখ্যক ধর্ষণ ধর্ষণের প্রচেষ্টার প্রকৃত সংখ্যা রূপ দেশে সমাজের প্রচলিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোবৃত্তি বিচারহীনতার কারণে প্রকাশ পায় না বা অজানা থেকে যায়, তার পরেও বলা যায় ধর্ষণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে  চলেছে যদিও সঠিক তথ্য-উপাত্তের অভাবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা এখনো কম বিষয়টি সুষ্ঠু অনুসন্ধানী গবেষণার দাবি রাখে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্ব ক্রাইম ট্রেন্ড রিপোর্টের ২০১৫ সালের ভার্সন থেকে জানা যায়, প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ডটকম প্রকাশিতরেইপ স্ট্যাটিস্টিকস বাই কান্ট্রি-২০২০শিরোনামে প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০২০ সালে আমেরিকায় মোট ধর্ষণের সংখ্যা ৮৪ হাজার ৭৬৭!

শীর্ষ ধর্ষণ তালিকার দ্বিতীয় নম্বরে আছে দক্ষিণ আফ্রিকা, তাছাড়া সুইডেন, ভারত, ইথিওপিয়া, শ্রীলংকা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডার মতো দেশের ধর্ষণ চিত্রও কঠিন ভয়াবহ 

বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরের ধর্ষণ চিত্র বিশ্লেষণ করে খুব বেশি ভালো ফল দেখা যায়নি সরকারের নানা চেষ্টা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক পদচারণার পরেও দেশের ধর্ষণ চিত্র ঊর্ধ্বগামী তবে এখানে স্বীকার করে নেয়া প্রয়োজন যে উল্লিখিত অধিকাংশ দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ধর্ষণের পরিসংখ্যান জানার জন্য নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের অভাব রয়েছে আমাদের মূল তথ্যসূত্র হচ্ছে থানায় রিপোর্টকৃত সংখ্যা দৈনিক খবরের কাগজ বেসরকারি ঊন্নয়ন সংস্থাগুলো, যাদের তথ্য মূলত কিছুসংখ্যক প্রচারিত দৈনিক কাগজ থেকে জোগাড় হয়ে থাকে আবার এটাও সত্য যে থানা খবরের কাগজভিত্তিক তথ্যগুলো আদতে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ পরিমাপের তুলনায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু মাত্র এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ধর্ষণ সংঘটনের খবর জানার পর তার সুষ্ঠু বিচার করতে না পারার অক্ষমতা যেকোনো জাতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়  

দৈনিক ইত্তেফাকে ২০১৯ সালের ১৫ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৪ সালে দেশে মোট ধর্ষণের সংখ্যা রেকর্ড হয়েছে ৭৫৭ ২০১৫ সালে ৮৮৫, ২০১৬ সালে ৭৫১, ২০১৭ সালে ৯৫৮, ২০১৮ সালে ৮৭৮ এবং ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৪২৯ মানবাধিকার-বিষয়ক সংস্থাঅধিকারেরদেয়া তথ্যমতে বা সাধারণত ঊর্ধ্বমুখী হয়ে থাকে তার হিসাবে ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল, অর্থাৎ ১৯ বছরে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৩ হাজার ৬৩৮টি, যার ভেতরে গণধর্ষণ ছিল হাজার ৫২৯টি মূল প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় হাজার ৪৬৭ জনকে ধর্ষণের গ্লানি সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন ১৫৪ জন যেকোনো বিচারেই চিত্র যদিও খণ্ডচিত্র, তবে আশঙ্কাজনক একটি দেশের উন্নতি সমৃদ্ধির পথে বিরাট অন্তরায় সে কারণেই নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সব ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যেতে আগ্রহী সরকার সম্প্রতি ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাস হয়েছে শুরু থেকেই চালু রয়েছে যাবজ্জীবন সাজার বিধান ধর্ষণ চেষ্টার জন্য সশ্রম কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডের বিধানও রয়েছে এবং সরকারের ঘোষণা রয়েছে, যেকোনো মূল্যে ধর্ষণ প্রতিরোধ করার তৎপরতা চালিয়ে যাবে তবে তার কার্যকারিতা এখনো কর্মে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়নি

বিভিন্ন তথ্যমতে, বাংলাদেশে ধর্ষণের ভয়াবহতার যাত্রা শুরু হয়েছিল মূলত ২০০১-০৫ সময়ে, বিএনপি-চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে বিএনপির শাসনামলে আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতিসহ সারা দেশ অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল নারীর প্রতি সহিংসতা পৌঁছেছিল তুঙ্গে পরিতাপের বিষয় হলো, পদযাত্রার আজও তেমন উল্লে­খযোগ্য কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি এবং একই পথ ধরে এখনো অব্যাহত রয়েছে সরকারদলীয় ক্যাডারদের সীমাহীন নির্যাতন-নিপীড়ন; যার সঙ্গে প্রায়ই হাত মেলাচ্ছে থানা পুলিশ প্রশাসনের কিছুসংখ্যক দায়িত্বপ্রাপ্ত অযোগ্য-লোভী ব্যক্তিও, যার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশু, নারী তার পরিবার-পরিজনরা   

ধর্ষণ পরিস্থিতির নিরীক্ষার আলোকে একে নিখুঁতভাবে বুঝতে প্রতিকারের অঙ্গীকার নিয়ে দেশে দেশে বিভিন্ন সময়ে এর সংজ্ঞার ঊল্লেখযোগ্য পরিশীলন হয়েছে, অনেকের মাঝে সুইডেনের সমসাময়িক পর্যালোচনাভিত্তিক নবতর (২০১৮) সংজ্ঞা, যা অত্যন্ত ব্যাপক (extensive) সর্বাঙ্গীণ (inclusive), যার অনুসরণ করে সে দেশের রিপোর্টে ধর্ষণের সংখ্যা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। এতে রাষ্ট্রকে হকচকিত না হয়ে এবং লুকোনোর চেষ্টা না করে সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন সমস্যার গুরুত্ব ব্যাপকতা স্পষ্ট সঠিকভাবে অনুধাবন করা এবং দ্বিতীয়ত, তা সমাধানে একনিষ্ঠ মনোনিবেশ করা। এক্ষেত্রে দেশের আইন, বিচার প্রশাসনের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সর্বোত সহযোগিতা করা। বাংলাদেশের ধর্ষণের সংজ্ঞা সুস্পষ্ট বা সময়োপযোগী কিংবা সর্বাঙ্গীণ নয় এবং তা বিচারপ্রার্থী যারা ধর্ষণের শিকার, তাদের জন্য মানহানিকর বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে বলে কথিত আছে।

  

কেন বাড়ছে ধর্ষণ ?

ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধি তথা ঘৃন্যতম অপরাধের পেছনে দায়ী বহুমুখী কারণ সমূহ। সমাজ বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজ বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশে ধর্ষণের প্রবণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-

সামাজিক অস্থিরতা: ধর্ষণের প্রধান কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা, বিশেষ করে নাগরিক সমাজের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। মানুষে মানুষে পারস্পরিক অমানবিকতা অনাচার ধর্ষণের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছে বলে ধারণা পাওয়া যায়। তাদের একদিকে সুস্থ বিনোদনের অভাব, পাড়া-মহল্লায় সাংস্কৃতিক ক্লাবভিত্তিক সেবামূলক চর্চার অভাবে সুস্থ মানবিকতা বিঘ্নিত হচ্ছে, অন্যদিকে তরুণ সমাজের জন্য সুষ্ঠু একটি সামাজিক ব্যবস্থাপনাহীতার কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে বলে কারো কারো মনে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছে যে তরুণ বা মানুষের একটি বিন্যস্ত পরিকল্পিত জীবন ব্যবস্থা থাকলে সে মানুষ কখনো ধর্ষণের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে না। কাজেই এক ধরণের অস্থিরতা এবং হতাশা থেকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে পারে, তবে প্রশ্ন থেকে যায়, তাই যদি সত্য মানব ধর্ম হয় তাহলে তো সব নারী বা মেয়েদেরও সামাজিক অস্থিরতার কারণে একইভাবে সহিংস হওয়ার কথা ছিল, তা তো দেখা যায়নি?

আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব: বর্তমানে দেশে বিভিন্ন বিদেশী চ্যানেল, বিভিন্ন ধরনের ডার্কসাইটসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম,  ইউটিউবইন্সটাগ্রাম ইত্যাদিতে অবাদ যৌনতার ছড়াছড়ি। সমস্ত যৌনতার চটুল প্রচারণায়  অনেক বিকৃত রুচিকে উসকে দিচ্ছে বা প্রকাশ ঘটাচ্ছে   সাইবার সেক্সুয়াল ক্রাইম, নারী পুরুষের বৈষম্যমূলক ক্ষতিকর চরিত্র চিত্রায়নের  ফলে ধরণের ঘটনা গুলো বাড়ছে বলে মনে করেন অনেক সমাজ বিজ্ঞানীরা। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব ধর্মীয় শিক্ষার ভ্রান্ত প্রচারণা সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রবণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করো সনাতন সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট নারী পুরুষের মধ্যে বিভাজন; যা বৈষম্যমূলক যা পুরুষতন্ত্রকে সমর্থন প্রচার করে। নারীবিদ্বেষ নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির এটি একটি অন্যতম কারণ।

সামাজিকতার কৌশল এবং আচার-আচরণ শিক্ষার অভাবশিক্ষালয়ে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সামাজিকভাবে মেয়ে ছেলে শিশুদের যৌথভাবে কাজে অংশগ্রহণে করাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে তারা মেলামেশার কৌশল এবং সভ্যতাভব্যতা শেখার সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে অফিস-আদালতে, রাস্তাঘাটে, পার্ক খেলার মাঠে এবং যানবাহন বাজার-হাটে প্রতিনিয়ত নারী শিশুরা যৌন আক্রমণের শিকার হয়।

যৌন প্রজনন শিক্ষার অভাব: আমাদের শিক্ষা কাঠামোর মধ্যে কৈশোর বয়সের জন্য এখন পর্যন্ত যৌন প্রজনন শিক্ষার প্রচলন হয়নি। ফলে নিজের শরীর-মন নিয়ে তাদের সচেতনতা, অধিকার সম্মানবোধ তৈরি সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে যৌন শিক্ষার অভাবের কারণে তরুণ মন সহজেই বিভিন্ন প্ররোচনা কুশিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়ে, যা তাদের বিভিন্ন রকম ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রান্ত দৈহিক মানসিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।

 

নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষার অভাব: ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধ প্রবনতা বাড়ার একটা বড় কারণ হলো নৈতিক মুল্যবোধের অভাব। শিশু এমনকি বয়স্কদের নৈতিক শিক্ষায় ঘাটতি থাকায় অনেকটা মূল্যবোধহীন হয়ে বেড়ে উঠছে, একটা জাতি বললে অত্যুক্তি হয়না। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সামাজিক আচার আচরণে ব্যাপারে প্রণোদনা বা উত্সাহ অনুশাসনের ঘাটতি সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত। ফলে পরিবারে, সমাজে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার আনাচে-কানাচে, চিন্তাচেতনায় নৈতিক মূল্যবোধের প্রভাব, প্রয়োগ, প্রসার প্রচারের আকাল দেখা দিয়েছে। সুযোগসন্ধানীরা সেই সুযোগে নৈতিক বিবেচনাবোধ বর্জিত হয়ে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। এতে সমাজের তথাকথিত শক্তিশালী বা পাওয়ারহোল্ডাররা মদদ জোগাচ্ছে। আবার মাদক ব্যবসা আসক্তির উত্তরোত্তর বৃদ্ধি মানুষের মানবতাবোধ ধ্বংস করতে ইন্ধন জোগাচ্ছে।

বিচারহীনতা অবিচারের সংস্কৃতি: বিচারহীনতা অথবা অবিচারের সংস্কৃতি, সময়মতো বিচার না পাওয়া কিংবা দুষ্ট চক্রের ইন্ধনে অন্যায্য বিচার পাওয়া ইত্যাদি  আমাদের কাছে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা খুবই স্বাভাবিক বিষয় বলে বিবেচিত। নারীর প্রতি যেকোনো সহিংসতা ধর্ষণের বিচার চাওয়া যেমন দুষ্কর, তেমনি বিচার পাওয়া আরো অসম্ভব। উপরন্তু, ধর্ষণের শিকার নারী তার পরিবার-পরিজনের ওপর দেশের সমাজ অপশাসনের ব্যবস্থাপাড়াপ্রতিবেশী থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিতরা, বিচার ব্যবস্থাখড়্গহস্ত হয়ে ওঠে। মামলার তথ্য আদায়ের প্রক্রিয়াও মোটেও স্বচ্ছ সহজগম্য নয়। সবকিছু মিলিয়ে বিচারের বাণী যেমন বিলম্বিত হয়, তেমনি আরো বিলম্বিত বা অসম্ভব হয়ে পড়ে তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। বাংলাদেশে ৩৪ লাখ মামলা জমা পড়ে আছে, যেখানে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। তথ্য প্রগতির যুগেও কেন্দ্রীয়ভাবে মামলাগুলোর নথিভুক্তির কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির অভাবে হারিয়ে যাওয়া স্বীয় মামলার তথ্য জানা মামলা চালানোর জন্য ভুক্তভোগীরা উেকাচ প্রদানে বাধ্য হয়। সবকিছুই বিচার পাওয়ার জটিলতাকে ভয়াবহ আকার দান করেছে, যার প্রমাণ রাষ্ট্রীয় পরিচালনাধীন ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী গত ১৯ বছরে শতকরা মাত্র দশমিক ভাগ ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলা নারী শিশু নির্যাতন আইনের আওতায় আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে, বিচার হয়েছে শতকরা মাত্র শূন্য দশমিক ৩৭ ভাগের। এই একটি চিত্রে নারী নির্যাতন-সংক্রান্ত বিচারকার্যে ধীরগতি সার্বিক অবহেলা পরস্ফুিট, যা অস্বীকার করা যায় না এবং বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। এবং হাজার ৮০০ খ্রিস্টাব্দে ভূতপূর্ব ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অমোঘ বাণী থেকে আমরা এও জানি যে ন্যায়বিচার বিলম্বিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করা বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। দৃশ্যত আমাদের বিচার ব্যবস্থা নারী অধিকার সুরক্ষা তো নয়ই, বরং নারীর প্রতি অনাচার, অবহেলা এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মাধ্যমে নারী নির্যাতন নিপীড়নের প্রজ্জ্বলিত শিখায় ঘৃতাহুতি ঢেলে চলেছে। 

সিস্টেম ক্রাইসিস: আমাদের মিডিয়া, প্রচারমাধ্যম, শিক্ষা ব্যবস্থা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে যে ছকে বেঁধে রাখা হয়েছে, সেই ছকের মধ্যে অদ্ভুত অমানবিকতার চর্চা রয়েছে। সব ছকই চলছে পুঁজিবাদী আর বস্তুবাদী কায়দায়। মিডিয়ায় নারী হলো আনন্দ-বিনোদনের এক মোহনীয় বস্তু। ফলে নারী নিজেই নিজেকে উচ্চতর সত্তা এমনটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এমনভাবে নারীকে চিত্রায়িত করা হচ্ছে যেন নারীর কাজই হলো নিজেকে রূপসজ্জায় সজ্জিত করা, বিনা বা নামমাত্র পারিশ্রমিকে অধস্তন কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত হওয়া আর পুরুষ হচ্ছে সবকিছুর ভোক্তা। এভাবে মিডিয়া নারী পুরুষ উভয়কে পুরুষতান্ত্রিক মোহাচ্ছন্নতার জালে আবদ্ধ রাখছে। আর ধরনের মিডিয়াকে দেয়া হচ্ছে অপার স্বাধীনতা। কেননা বহুজাতিক কোম্পানির পুঁজিবাদী বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে চাঙ্গা রাখতে এরূপ নিম্নমানের স্বাধীনতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতা দেয়া হচ্ছে।

হিংস্র বয়ান: প্রচলিত সমাজে যে ধর্মীয় বয়ান চলছে, তাতে যথেষ্ট প্রাজ্ঞতার অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। অধিকাংশ বয়ানে নারীদের যেভাবে হিজাব-পর্দার ব্যাপারে সতর্ক হতে বলা হয়, সেভাবে পুরুষদের বলা হয় না। তাছাড়া নারীর বেপর্দাকে যেভাবে দায়ী করা হয়, সেভাবে পুরুষের বেপর্দা, হিংস্র লোভী মানসিকতাকে দায়ী করা হয় না। ধর্ষণের ক্ষেত্রে আক্রমণকারী যেহেতু পুরুষ, সেক্ষেত্রে কী করে পুরুষরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কীভাবে নারী পুরুষ নৈতিকতার চর্চা করতে পারে নিয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান প্রশিক্ষণের অভাব লক্ষ করা যায়। 

ক্ষমতার অপব্যবহার: ক্ষমতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ও বহুলাংশে ধর্ষণের মতো অপরাধ বাড়িয়ে দেয়। ক্ষমতাশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে অধস্তন কর্মিবাহিনীর কেউ কেউ অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে। বিপদ হলে আইন আদালত সামলে নেয়ার আশ্রয় আছে ভাবনায় তারা অসহায় নারী শিশুর ওপর আক্রমণপ্রবণ হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিকালে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির জোরদার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এই হিংসাত্মক আক্রমণের আশঙ্কা হ্রাস পাবে বলে জাতির প্রত্যাশা।

ধর্ষণ প্রতিরোধে কতিপয় করণীয়: একটি উন্নত মানবাধিকারসম্পন্ন নিরাপদ দেশ গঠনের জন্য  নারীর প্রতি সহিংসতা বিশেষ করে ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধগুলো প্রতিরোধ প্রতিকার করা অত্যন্ত জরুরি। কথাও সত্য যে, সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করার পরও অন্য যে কোন অন্যায় বা অপরাধের মতো আমরা হয়তো ধর্ষণ পুরোপুরি প্রতিরোধ বা বন্ধ  করতে পারব না, তবে সচেতনতা, সতর্কতা, সামাজিক আইনি প্রতিকার সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনতে পারে।

নারীর রূপকার বা চালিকাশক্তির ভূমিকাকে স্বীকৃতি ও সম্মান করা:  প্রতিটি নারীর অন্তর্নিহিত শক্তি বা নিজের প্রতি বিশ্বাস এবং তার অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি, স্বকীয় জীবন বিকাশে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে অন্যায়  প্রতিরোধে নারীকে এমনভাবে ক্ষমতায়িত করতে হবে, যেন তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শেখে যেনাবলার আত্মরক্ষারঅধিকার সক্ষমতা তার রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আনুষঙ্গিক সব প্রকার সুযোগ-সুবিধা পরিবেশ তৈরি সংরক্ষণ করার দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ ক্ষমতাশীল পুরুষদের। পরিবেশ, নিয়মকানুন সামাজিক পরিস্থিতিকে সহায়ক না করতে পারলে নারীর ক্ষমতায়ন কার্যকরী হবে না, এটা নিশ্চিত।

নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি শিক্ষিত, বিনয়ী এবং দায়িত্বশীল  জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা: নারীকেমানুষনয়ভোগের সামগ্রীহিসেবে ভাবার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন করতে হবেই।  প্রথমেই প্রয়োজন ধর্ষণ-সংস্কৃতিকে উসকে দেয়, প্রশ্রয় দেয় তেমন সমাজকে ধর্ষণবিরোধী, ধর্ষণ প্রতিরোধী সমাজে রূপান্তর করা। এর জন্য গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে নারীকেযৌন পণ্যহিসেবে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। নারীকেমানুষহিসেবে ভাবার সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। অন্যদিকে সমাজে যেসব মিথ ভ্রান্ত ধারণা ধর্ষণকে প্রশ্রয় দেয়, তেমন মিথগুলোকে ভেঙে দিতে হবে। তেমন কিছু প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে: নারীর উগ্র পোশাক, চালচলন ধর্ষণকে উত্সাহিত করে, নারী ধর্ষিত হতে চায়, পুরুষেরা অধিক যৌনকাতর, তাই তারা নিজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, ভূমিদস্যুদের মতো এই যৌনদস্যুদের মানসিকতা এই যে নারীর দেহের ওপর সেঅধিকারপ্রাপ্ত’ (এনটাইটেলমেন্ট); একবার শারীরিক সম্পর্ক হওয়া মানে পরবর্তী সময়েও সে অধিকার থাকবে, রাতবিরাতে নারীর একাকী চলাফেরা ধর্ষণের অন্যতম কারণ, ধর্ষিত নারীর শরীরে আঘাতের চিহ্ন নেই, তাই তাঁর নীরব সমর্থন ছিল ইত্যাদি। এসব ভ্রান্ত বিশ্বাস সমাজ থেকে দূর করতে হবে। এসব ধারণা দূর করে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি শিক্ষিত, বিনয়ী এবং দায়িত্বশীল জনগোষ্ঠী গড়ে তোলায় রাষ্ট্রকে কার্যকর ভাবে মনোনিবেশ করতে হবে।

ধর্ষণের দায় অন্যায্য সমাজ, ঘুণে ধরা আইন, আইনের অস্পষ্ট বাস্তবায়ন বিচারহীনতার: মনে রাখতে হবে ধর্ষণে নারীর কোনো দায় নেই। নারী যেভাবেই চলুক, যে পোশাকই সে পরুক, তাতে কোনোভাবেই ধর্ষণকে জাস্টিফাই করার সুযোগ নেই। তবে পুরুষ নারী উভয়েই সংযমী হবেন। ধর্ষণ প্রতিরোধে শুধু নারীকে সতর্ক থাকতে বললে হবে না, পুরুষকেওধর্ষণ করবে না’— বার্তা বারবার দিতে হবে। পরিবার সমাজে নারীরসম্মতি নেয়ার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে, পৌরুষত্বের সনাতনী ধারণায় পরিবর্তন আনতে হবে, ধর্ষণপ্রাকৃতিক ব্যাপার ভুল ধারণা ভেঙে একেঅপরাধ নারীর প্রতিসহিংসতা হিসেবে দেখতে হবে, ধর্ষণ মানে ধর্ষণ, প্রেম-বন্ধুত্বের নামে একেবৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা যাবে না, চোখের সামনে ধর্ষণ হচ্ছে অথচ নির্বিকার, নিষ্ক্রিয় থাকার কাপুরুষতা পরিহার করতে হবে, সামাজিক বা আইনগত হয়রানি, অসম্মানের ভয়ে ধর্ষণের ঘটনা লুকিয়ে রাখা যাবে না।

অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে’— মতাবলম্বনে যারা ধর্ষণ উসকে দেয়, সহযোগিতা করে, ধর্ষণের সংবাদ গোপন করে, ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তথ্য প্রদান বিচারকার্য ব্যাহত করে, আইনের চোখে তাদের অপরাধ ধর্ষকসম বলে বিবেচিত হতে হবে এবং তা শাস্তির আওতায় আসতে হবে।

ধ্যান-ধারণাগুরলা হূদয়ঙ্গম করে প্রচার, ধারণ বাস্তবায়ন করার সর্বোপরি দায়িত্ব জনপ্রতিনিধী তথা সংসদকে নেয়া উচিত, যা বিশ্বে আলোড়নকারী একটি ইতিহাস হতে পারে। এই বাঙালি জাতিই তো তারা, যারা মাতৃভাষার সম্মানে জীবন বাজি রেখেছিল, সমগ্র জাতির মান রক্ষার্থে আরেকবার কি আমরা সেই ধ্বজা ধরতে পারি না?

ধর্ষণ প্রতিরোধে মূল দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকে : আমরা ধর্ষনের কারন আলোচনা করতে গিয়ে মানসিকতা রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্ষমতা বৃদ্ধি, আইনের সংঙ্কার সার্বিক একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক বলয় (মন্ডল) সৃষ্টি জাতীয়ভাবে তার অবলোকন বা পরিবীক্ষণ জরুরি। কাজেই ব্যক্তিকে সতর্ক সচেতন হতে হবে যেমন, তেমনি ধর্ষণ প্রতিরোধে মূল দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকে, পরিবার সমাজকে উদ্ভুদ্ধ সম্পৃক্ত করার দায়ও কিন্তু রাষ্ট্রের। দেশের আইন কাঠামোকে প্রয়োজনে আরো ঢেলে সাজাতে হবে তবে পারিপাশ্বিক দায়বদ্ধতা   পৃথক ন্যায়বোধ বাড়াতে হবে। ধর্ষণজনিত মামলা যত দ্রুত খালাস করা যাবে, তত দ্রুত আসামী সাজার আওতায় আসবে। আমেরিকায় সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) কেন্দ্রীয়ভাবেরেপ প্রিভেনশন অ্যান্ড এডুকেশন’ (আরপিই) প্রোগ্রাম চালু করেছে। ধরনের প্রোগ্রাম আমাদেরও নিতে হবে, যেখানে পৃথিবীব্যাপী পরীক্ষিত বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত কার্যকরপ্রতিরোধপ্রোগ্রামগুলো বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। রেপ শিল্ড অনুসরণ করতে হবে, যাতে ভিকটিমকে অনাবশ্যক প্রশ্ন না করা হয়, ব্যক্তিগত বিষয় বেশি প্রকাশ্যে আনা না হয়, মেডিকেল পরীক্ষায় মানসম্মত প্রটোকল মেনে চলতে হবে, অভিজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে, সবকিছুর ডকুমেন্ট রাখতে হবে, কোনো চাপ, দুর্নীতির যেন অবকাশ না থাকে, ধর্ষণের স্বীকার ধর্ষকদের পূর্ণ জীবনবৃত্তান্ত রেজিস্ট্রি করে তা গোপনীয় রক্ষা করেমানসম্মত নিয়মকানুন মেনে, জায়গামত  সংরক্ষণ করতে হবে, প্রয়োজনে ইন্টারনেটে তা প্রাপ্তির সুযোগ থাকতে হবে এবং কঠোর শাস্তির জন্য আইনি সংস্কার আনতে হবে। ছাড়া ন্যূনতম সাজার উল্লেখ থাকতে হবে, বিচার দ্রুত শাস্তি দৃশ্যমান করতে হবে।

পুরুষ নারী উভয়ের চারিত্রিক উন্নতিকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাকার্যক্রম চালাতে হবে: এক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবারকে অঞ্চলভিত্তিক শিক্ষাদানের লক্ষ্যে প্রতিটি স্তরে নৈতিক শিক্ষার কোর্স বাধ্যতামূলক করতে হবে। যার যার ধর্ম অনুসারে প্রত্যেক নারী পুরুষকে যথাযথ নৈতিকতা শিক্ষা দিতে পারলে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি পাবে।

সুচিন্তা সুনাগরিক গড়তে শিক্ষাকার্যক্রমে নৈতিকতা মূল্যবোধের শিক্ষা, প্রচার প্রসারে মনোযোগ দিতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, ঈশপের গল্প বা অন্যান্য প্রচলিত নৈতিক গল্প থেকে জীবনে বাস্তবায়নের নজির তৈরী করতে হবে। ঈশপের গল্প যার শৈল্পিক আবেদন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার জন্য। জীবনের নানা পর্যায়ে আমাদের বিভিন্ন রিপু দমনে ঈশপের গল্প এক ধরনের উপাত্ত হিসাবে কাজ করে থাকে। নীতিবাক্য কিভাবে মানুষের কাছে পৌছানো যায় তার এক সার্বজনিন দ্রষ্টা এই ঈশপ।

বাধ্যতামূলক যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার শিক্ষার প্রচলন: বিশ্বজুরে অসংখ্য প্রমান রয়েছে যে যৌন অধিকার   নিজের বয়সন্ধি-কালীন শারিরিক মানসিক বেড়ে উঠা সম্পর্কে  যে তরুণদেরর কোন ধারনা নেই, তাদের চাইতে যে তরুনরা  যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার শিক্ষা পেয়েছে তারা যৌন আচরণের বিপদ সঙ্কুল ঝুকি এড়িয়ে চলতে সক্ষম। যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার জানা না থাকলে ব্যাক্তি তার স্বাস্থ্য শিক্ষা  এবং  সামাজিক অর্থনৈতিক জীবন যাপন নিজ পছন্দ অনুযায়ী বেছে নিতে পারেনা যা তার ক্ষমতায়নকে ব্যাহত করে।

যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার শিক্ষায় বিনিয়োগ করা মানবাধিকার বাস্তবায়নের একটি পন্থা যা লক্ষকোটি অল্পবয়স্ক মেয়েদের অপমৃত্যু, ধর্ষন, নির্যাতন, যৌন  অনাহুত মাতৃত্ব রহিত করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য যা সন্দেহাতীতভাবে অতীব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হবে।

একটি সঠিক ভাবে সংশোধিত, সময়োপযোগী পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়নযোগ্য আইন: ধর্ষন আইন  সংশোধনে প্রানিধানযোগ্য বিষয়সমূহের অন্তর্ভূক্তিও বিবেচনা জরুরী  যথা, বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক অধিকার, আন্তর্জাতিক  মানবাধিকার চুক্তপত্র সমূহ, ধর্ষন, নির্যাতন, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, ইত্যাদী বিষয়ক জাতিয় আইন নীতিমালা সমূহধর্ষন বা ধর্ষনের আক্রমনের স্বীকার নারী, পুরুষ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক, জেন্ডার বৈচিত্র, বর্ণ, সক্ষমতা, সকল জাতিগোষ্ঠির মানুষ, সম্মতিহীন সকল ধরনের পেনিট্রেশন বা অনুপ্রবেশ, আগ্রাসনের অন্তর্ভুক্তি এবং কোন ভাবেই ধর্ষণের স্বীকারের যৌন, সামাজিক, পেশাগত বা অন্যান্য পরিচয় নিয়ে কোন প্রকার বিদ্বেষ অসহযোগিতা প্রকাশ, প্রচার বিচারের বিষয়বস্তু হবেনা যাতে আসামী কোনক্রমেই বাদীর কোন ক্ষতিসাধন করতে না পারে।

আইন বাস্তবায়নে ধর্ষনের কারনে সামাজিক রাষ্ট্রীয় সাহায্য সহযোগিতার অভিগম্যতা বা নিরাপত্তা বিধানে সরকারী কর্মকর্তাগন দায়বদ্ধ থাকবেন।

এই আইনটিতে শাস্তিবিধানের সাথে সাথে ধর্ষনের ( ধর্ষনের আক্রমনের) স্বীকার বা তার পরিবারকে সচরাচর যে আনুসাঙ্গিক বাধাবিপত্তির অপমানের মুখাপেক্ষী  হতে হয় তার সমাধানের নির্দেশ বা পুর্ণ দায়িত্ব সরকারী কর্মকর্তাগনের উপর ন্যাস্ত থাকবে।  কোন কারনে জামিন (যদি হতে হয়) হলে সেই সময়টা অবশ্যই আদালতের নিবিড় নিরীক্ষণে রাখতে হবে।

নারী চরিত্র সম্পর্কে ঘৃণা হিংস্রতা উদ্রেককারী বক্তব্য বা বয়ান শাস্তিযাগ্য অপরাধ: নারী চরিত্র সম্পর্কে ঘৃণা হিংস্রতা উদ্রেককারী বক্তব্য বা বয়ান অবমাননা চিত্রায়ণ করা, যা ধর্ষণের পশুত্বকে উসকে দেয় বা ধর্ষণ করতে উত্সাহিত করে, তাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। অচিরেই কালক্ষেপণ না করে কঠোর আইনের মাধ্যমে নারী বা নারী চরিত্র সম্পর্কে ঘৃণা হিংস্রতা উদ্রেককারী কথা, হিংসাত্মক অসংলগ্ন বক্তব্য বা বয়ান, অবমাননা চিত্রায়ণ করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে কঠোর বিচারের আওতায় আনা আবশ্যকীয়। আদেশ বা আইন বাস্তবায়নে বাধাদানকারী বা বাস্তবায়নে অপারগ ব্যক্তি বা সম্পৃক্ত সংস্থার জন্যও সুস্পষ্ট শাস্তির বিধান থাকবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা নিরসনে যা যা করা দরকার তা করায় অবহেলা হলে বিচার ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়যদি থাকেদায়বদ্ধ করা হবে।

পারঙ্গমতার (জ্ঞান+দক্ষতা+মানসিকতা) উত্কর্ষ সাধন: আমাদের প্রচলিত শিক্ষা মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল দায়িত্ববান করে তোলে না, যা দেশে প্রতিনিয়ত প্রকাশিত নারী নির্যাতন, নিপীড়ন, খুনের তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রমাণিত।

সেকথা মনে রেখে মাঠ থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিটি দায়িত্বশীল পদে আসীন ব্যক্তি গোষ্ঠীকে সমস্যা উত্তরণে কৌশলগত যোগ্যতায় যোগ্যতর করে গড়ে তুলতে হবে, যোগ্যতার বাস্তবায়ন নিশ্চত করা প্রতিজনের কর্মদক্ষতা নিয়মিত নিরীক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি।  

সর্বোপরি জাতিকে ধর্ষণসম্পৃক্ত নিগ্রহ থেকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা, যা অঞ্চলভিত্তিক বহু খণ্ড পরিকল্পনার অংশ হতে পারে। কর্মযোগ পরিবীক্ষণের দায়িত্ব নিবিড়ভাবে পালন করার জন্য কৌশলগত দক্ষতায় দক্ষ প্রস্তুত করতে হবে সম্পৃক্ত বিষয়ে দায়িত্ববান সরকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিচার আইন ব্যবস্থায় সম্পৃক্তদের, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক মিডিয়া গোষ্ঠী এবং আমাদের স্থানীয় জনগণকে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সামনে রেখে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ, অবহেলা নিপীড়নের ঘটনাগুলো চিহ্নিত করে তা সুরাহায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিয়মিত, কার্যকরী শক্তিশালী নিরীক্ষণের আওতায় আনা জরুরি। দায়িত্ব পরিবার. পাড়াপড়শী, সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করে দেশব্যাপী মানবতা উন্নয়নের ধস বন্ধ করতে হলে একমাত্র উপায় হচ্ছে সুরক্ষার সর্বজনীন আন্দোলন সৃষ্টি, যা এগিয়ে নেয়ার এখনই সময়।

শীপা হাফিজা

সমতা মানবাধিকার কর্মী

তথ্যসূত্র:


১. ধর্ষণ পরিক্রমা: যুদ্ধের ময়দান থেকে জাতীয় জীবনে- ফজলে রাব্বি খান, ১৭ এপ্রিল, ২০১৯, ঢাকা ট্রিবিউন ডটকম


২.‘রেইপ স্ট্যাটিসটিকস বাই কান্ট্রি-২০২০, ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ডটকম, ভিজিট- ১৫ জানুয়ারি, ২০২১


৩.Victims of Sexual Violence: Statistics, Rainn.org, ভিজিট- ১৮ 


৪.     জানুয়ারি, ২০২১


৫.Rape conviction rates rise 75% in Sweden after change in law, June 22, 2020, Reuters.com 


৬.‘রেইপ স্ট্যাটিসটিকস বাই কান্ট্রি-২০২০, ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ডটকম, ভিজিট- ১৫ জানুয়ারি, ২০২১


৭.‘রেইপ স্ট্যাটিসটিকস বাই কান্ট্রি-২০২০, ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ডটকম, ভিজিট- ১৫ জানুয়ারি, ২০২১


৮.‘রেইপ স্ট্যাটিসটিকস বাই কান্ট্রি-২০২০, ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ডটকম, ভিজিট- ১৫ জানুয়ারি, ২০২১


৯.     দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ মে, ২০১৯


১০.‘রেইপ স্ট্যাটিসটিকস বাই কান্ট্রি-২০২০, ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ডটকম, ভিজিট- ১৫ জানুয়ারি, ২০২১


১১.Rape, Abuse & Incest National Network, rain.org


১২.Governemt of Sweden and Crime Victim Compensation and Support Authority, 2014


১৩.The National Crime Records Bureau, report of 2006, India


১৪.দৈনিক যুগান্তর, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২০


১৫.বাংলাদেশে ধর্ষণের পরিসংখ্যান, দৈনিক প্রথমআলো, ২৬ জানুয়ারি, ২০২০


১৬.আমরা করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) নিয়ে একটা সার্ভে করেছি। কোভিডকালীন ১০ মাসে দেখেছি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ৫ হাজার ও একই সময়ে আত্মহত্যায় ১১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।


১৭.বৃহস্পতিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) নগরীর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অডিটোরিয়ামে ‘স্টেকহোল্ডার (মিডিয়া) কনসালটেশন ওয়ার্কশপে’ পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী এসব কথা বলেন।    


১৮.Justice and Prison Reform for Promoting Human Rights and Preventing Corruption

Commissioned by: German Federal Ministry for Economic Cooperation and Development (BMZ), 2018 to 2021

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন