দুই দশকে বেড়েছে পাঁচ শহরের তাপমাত্রা

উষ্ণতা রোধে পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক

দেশের বড় শহরগুলোয় ক্রমেই বাড়ছে তাপমাত্রা। তথ্য বলছে, গত দুই দশকে গ্রামের তুলনায় ঢাকায় দশমিক ৭৪ ডিগ্রি, চট্টগ্রামে দশমিক ৯২, খুলনায় দশমিক ২৭, সিলেটে দশমিক ১০ রাজশাহীতে শূন্য দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে শহরাঞ্চলে প্রকোপ বাড়ছে নিত্যনতুন রোগবালাইয়ের। বিরূপ প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। দুঃখজনকভাবে দেশে এখনো নগর জলবায়ুর অভিঘাতের বিষয়টি ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত। দ্রুত পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় এক্ষেত্রে দ্রুত নীতিগত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

প্রকৃতপক্ষে সময়ান্তরে দেশে নগরের বিস্তার ঘটলেও আন্তর্জাতিক বাসযোগ্যতার সূচকে আমাদের বড় শহরগুলোর অবস্থান দিন দিন তলানিতে। এর সঙ্গে নগর উষ্ণায়নের একটা যোগসূত্র আছে। বড় শহরগুলোর তাপমাত্রা আজকে যে উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে, তার পেছনে বেশকিছু কারণ বিদ্যমান। এক সময় দেশের মানুষের জীবনযাপন গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে কাজের প্রয়োজনে দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিপুল জনস্রোত শহরমুখী হয়েছে। এতে বেড়েছে শহরের জনঘনত্ব। এটা তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অন্যতম প্রভাবক ভূমিকা রেখেছে। একই সঙ্গে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে কংক্রিটের অবকাঠামোর আচ্ছাদন বেড়েছে বহুগুণ। শহরাঞ্চলে কমেছে কৃষিজমির পরিমাণ। হ্রাস পেয়েছে জলাভূমি। পরিকল্পনাহীন কংক্রিটের অবকাঠামোর দাপটে কমে এসেছে সবুজ আচ্ছাদিত পরিসর। মোটাদাগে বলতে গেলে অস্বাভাবিক জনঘনত্ব, কংক্রিটের আচ্ছাদনের অব্যাহত বৃদ্ধি, অফিস-আদালত/কলকারখানা/পরিবহনের বর্জ্য তাপ এবং অত্যধিক ভবনের আধিক্য শহরের বাতাস ভূপৃষ্ঠের ত্বকের উষ্ণতাকে ত্বরান্বিত করছে। এছাড়া আমাদের শহরের ভবনগুলো যেসব আনুষঙ্গিক উপকরণে নির্মিত, তা জলবায়ু সংবেদনশীল নয়। ফলে বেশির ভাগ অবকাঠামো দিনের বেলা উত্তপ্ত থাকে, আবার রাতে যে হারে শীতল হওয়ার কথা, তা না হয়ে তাপ ধরে রাখে। উদ্বৃত্ত তাপই আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিশে তাপমাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। তাই নগরবাসী বিদ্যমান বহু সমস্যার সঙ্গে অতিমাত্রায় উষ্ণতাও অনুভব করছে। একদিকে জনজীবনে বাড়ছে অস্বস্তিঅন্যদিকে শক্তিসম্পদের ওপর বাড়ছে চাপ। দেখা দিচ্ছে নিত্যনতুন রোগবালাইও। এর একটি বড় উদাহরণ ডেঙ্গুর প্রকোপ। ২০০০ সালের আগে ঢাকার তথা দেশের মানুষের কাছে ডেঙ্গু ছিল অনেকটা অচেনা, কিন্তু ডেঙ্গু এখন নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে; যা শহরের উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত। একইভাবে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা হচ্ছে শীতলতা বজায় রাখতে, যা অদূরভবিষ্যতে বাড়াবে পানিসম্পদের ওপর চাপ। বলা চলে, সামনে সার্বিক পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে বৈকি। সুতরাং নগরের উষ্ণায়ন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিকল্প নেই।

ভারসাম্যপূর্ণ নগর বিন্যাসের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনা। নগর পরিকল্পনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হলো ফ্লোর এরিয়া অনুপাত বা এফএআর। উন্নত দেশের শহরগুলোয় এফএআর মেনে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এটি যথাযথভাবে মানা হয় না। জনসংখ্যার চাপ সামলাতে অনেকটা পরিকল্পনাহীনভাবে আমাদের বড় শহরগুলোয় অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এর ফলে সবুজ আচ্ছাদিত পরিসর আজ ক্রমসংকুচিত, যার পরোক্ষ প্রভাবে বাড়ছে তাপমাত্রা। দেশে আইন-বিধির ঘাটতি নেই। নগরে ভবন নির্মাণে রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিল্ডিং কোড। এতে কীভাবে নির্মাণ করতে হবে, কার কাছে অনুমতি নিতে হবে, কতটুকু জায়গা ছেড়ে বা সবুজ জায়গা রেখে ভবন নির্মাণ করতে হবে, তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা বিদ্যমান। স্থপতিরা ডিজাইন করার সময়ও বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখেন। অথচ বাস্তবায়নের সঙ্গে ডিজাইনের অমিল বিস্তর। ফলে যতটুকু জায়গা রাখার কথা ছিল, অনেক ক্ষেত্রে তা থাকে না। তাই শুধু আইন বিধিবিধান থাকলে হবে না, নির্মাণের ক্ষেত্রে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, তাও তদারক করা জরুরি। নইলে শহরাঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সমস্যা মোকাবেলা করা কঠিন।

বলার অপেক্ষা রাখে না, নগরের উষ্ণতা দুই ধরনের। এক. বাতাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, যা সরাসরি মানুষের আরাম বা স্বস্তির সঙ্গে জড়িত; দুই. ভূপৃষ্ঠের-নগরের ত্বকের উষ্ণতা, যা কোনো অঞ্চলের শক্তি বা এনার্জির স্থিতাবস্থার নিয়ন্ত্রক। দুই ধরনের উষ্ণতার একটি বা দুটোর সম্মিলিত প্রভাবে নগরের মাইক্রো-ক্লাইমেট পরিবর্তিত হয়। যেহেতু তাপমাত্রা মানবীয় প্রাকৃতিক পরিবেশের নিয়ন্ত্রক, সেহেতু এর সামান্যতম পরিবর্তন নগরের অধিবাসীদের জন্য বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব, দাবদাহের তীব্রতা সংখ্যা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে যা এরই মধ্যে পরস্ফুিট।

আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালক এখনো নগর। অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের পারিকল্পনা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের। কাজটি বেগবান করার জন্য নগরের টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ঘনত্ব বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে। সেক্ষেত্রে নগরগুলোর পরিবেশ সুরক্ষা   অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটা ভারসাম্য প্রয়োজন। নগরের উষ্ণতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে গবেষণাভিত্তিক পরিকল্পনা না নিলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অধরাই থেকে যাবে। নগরের উষ্ণতা রোধে বাড়াতে হবে সবুজ আচ্ছাদিত পরিসরের সংখ্যা। সংরক্ষণ করতে হবে বিদ্যমান জলাভূমিগুলো। তাপমাত্রার প্রকোপ কমাতে উদ্ভাবনমূলক নানা কৌশলের উন্মেষ ঘটাতে হবে। তার জন্য চাই গবেষণা। অনুপুঙ্খ গবেষণা সুষ্ঠু পারিসরিক পরিকল্পনাই কেবল পারে নগরের উষ্ণায়নের সঙ্গে অভিযোজনের পথটি সহজ করতে। বিষয়টি আমলে নিয়ে নীতিনির্ধারকরা সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেবেন বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন