স্বাধীন বাংলাদেশে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা

মো. শাহাদাৎ হোসেন এফসিএ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ভরপুর এক জীবন। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কোন বিরতি বা ছেদ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মময় জীবনের অন্যতম একটি কর্মকান্ড ছিল  দেশের শাসনতন্ত্র প্রনয়নের লক্ষে ১৯৭০-এর নির্বাচন (১৯৭০ সালের ১লা ডিসেম্বর নির্বাচনের পূর্বে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এই নির্বাচনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হচ্ছে, নির্বাচিত হবার পরপরই পরিষদ সদস্যরা বা রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার গদিতে বসে পড়তে পারবেন না। তাঁদেরকে নির্বাচিত সময়ের মধ্যে দেশের শাসনতন্ত্র প্রনয়নের কাজ সমাধা করতে হবে।) ১৯৭০-এর নির্বাচনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তান শাষক গোষ্ঠীকে পরিস্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র অথবা কোনো ফরমানবলে চাপিয়ে দেওয়া যেকোন শাসনতন্ত্রই বাঙালি জনগণ পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করবে।

তিনি আরও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে বাঙালিরা কেবল সে রকম একটি শাসনতন্ত্রই মেনে নেবে, যা জনসংখ্যার অনুপাতে এবং প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি গণপরিষদ (বা সংবিধান সভ্য) কর্তৃক প্রণীত ও গৃহীত হবে (ড. কামাল হোসেন- মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল পৃষ্ঠা-৪৯)। ৭০-এর নির্বাচনের পর পশ্চিমা শাষকগোষ্ঠী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের তালবাহানায় শাসনতন্ত্র প্রণয়ন বন্ধ হয়। এর  পরের ইতিহাস প্রায় সকলেরই জানা।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক ভাষণ এবং অত:পর ২৬মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পশ্চিমা শাষকগোষ্ঠী বাঙালির ওপর চালিয়েছিল বর্বরচিত গণহত্যা। গণহত্যাকে মোকাবেলা করতে কৃষক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। মুক্তিযুদ্ধকে সঠিক ভাবে নিদের্শনা দানসহ স্বাধীন দেশের সকল কার্যক্রমকে শুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের চার মূলনীতির অন্যতম একটি হচ্ছে সরকার -সেটি পুরণকল্পে  ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল শপথ গ্রহনের মাধ্যমে গঠন করা হয় মুজিবনগর  সরকার। যে সরকারের প্রধান বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার হিসেবে মুজিবনগর সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে ৭০-এর নির্বাচন ৩১৩টি আসনে হলেও বাংলাদেশের ১৬৯টি আসনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গণপরিষদ গঠন। যে গণপরিষদ ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর দেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করেন এবং একই বৎসরের ১৬ই ডিসেম্বর বলবৎ করেন। শাসনতন্ত্র প্রনয়নের লক্ষ্যে গণপরিষদ গঠন ছাড়াও  মুজিবনগর সরকার পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

উদাহরণস্বরুপ ১৯৭১ সালের ১৮ই মে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম  (উপ-রাষ্ট্রপতি, যিনি বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন) মুক্তি ফৌজের ভূমিকার উচ্ছসিত প্রশংসা করেন, এবং বলেন, মুক্তি ফৌজের কঠোর প্রতিরোধ ও তীব্র পাল্টা আক্রমণে  পাকিস্তান বাহিনী হিমসিম খাচ্ছে এবং তাদের মনোবল একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭১ সালের ৬ই জুন সংগ্রামী বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বেতার ভাষণে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের প্রশংসা করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান আরও বলেন, “বাংলাদেশ সরকারের সীমিত সামর্থের জন্য আপনাদের প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

বিভিন্ন রনাঙ্গনে আপনারা যে অসীম অটল মনোবলের পরিচয় দিচ্ছেন, তার জন্যে আজ সারা বাঙালি জাতি গর্বিত। দেশমাতৃকার বীর সন্তান আপনারা। এ সংগ্রামে আপনাদের যে সব সাথী শহীদ হয়েছেন যারা পঙ্গু হয়েছেন তাঁদের পরিবারবর্গের  রক্ষণাবেক্ষণের পুরো দায়িত্ব আমার সরকার ইতোপূর্বেই গ্রহণ করেছেন। ১৩ই জুন ১৯৭১ তারিখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বেতার ভাষণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়ে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন,“ জনসাধারণের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে গঠিত এই সরকারই দলের একমাত্র প্রতিনিধি। পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসন সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখান করে আমাদের জনগন স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। বেতার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বীর জওয়ানদের অতুলনীয় সাফল্য বর্ণনা প্রসঙ্গে আরও বলেন, “প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র পেলে ইনশাল্লাহ্ অচিরেই আমাদের মুক্তিবাহিনী দেশ থেকে দুর্জন সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হবে।

স্বাধীনতা যুদ্ধকে অধিকতর সুসংগঠিত ও জোরদার করার জন্য প্রধানমন্ত্রী দুনিয়ার বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সাহায্যের আবেদন জানান। অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান জেদ্দায় আসন্ন বিশ্ব -মুসলিম সম্মেলনের নেতৃবৃন্দের কাছে ২৫ জুন ১৯৭১ মুজিব নগর সরকার থেকে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানদের অনুরোধ করেছেন, যেন তাঁরা বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশের জনগনের স্বাধীনতা, রক্ষার জন্য সম্মেলনে তাঁদের প্রভাব খাটান। ১৮ই জুন ১৯৭১ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী জনাব এম মনসুর আলী স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেন,“স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আপনাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে কর্তব্য রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে আপনাদের আবার মনে করিয়ে দেবার প্রয়োজন বোধ করছি। যেহেতু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম্য রাষ্ট্র সেহেতু ২৫শে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের যাবতীয় খাজনা-ট্যাক্স একমাত্র বাংলাদেশ সরকারেই  প্রাপ্য।

কোন বিদেশী সরকারের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, “গ্রামীন অর্থনীতির উপর জোর দিয়ে গ্রাম গুলিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পন্ন  করে তুলুন। গ্রামে গ্রামে কুটিরশিল্প গড়ে তুলুন। পরস্পর সহযোগীতার মাধ্যমে নিজেদের বাঁচার পথ বেছে নিন।  মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর উপরোক্ত কার্যক্রম থেকে এটি খুব সহজেই অনুধাবন করা যায় যে  এদেশের মানুষদেরকে নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ, বঞ্চনা আর বৈষম্যের হাত থেকে রক্ষার সংগ্রামে মুজিব নগর সরকারের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে ৭০-এর নির্বাচনের অন্যতম একটি প্রত্যাশা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন যেটি সম্পূন্ন করতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ব্যর্থ হলেও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগন সেই শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সফল হয়েছেন। উক্ত শাসনতন্ত্র প্রনয়ন এবং অনুমোদনের জন্য যে সংবিধান সভ্য বা গণপরিষদের প্রয়োজন ছিল সে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল এই মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে।

লেখক  
সাবেক সহ-সভাপতি, আইসিএবি
সিনিয়র পার্টনার
ম্যাবস এন্ড জে পার্টনার্স

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন