অস্বাভাবিক লবণাক্ত হয়ে উঠছে কীর্তনখোলার পানি

পানি ব্যবস্থাপনায় টেকসই অভিযোজন কৌশল নেয়া হোক

দেশের স্বাদু পানির নদীর লবণাক্ততা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বৃদ্ধির পরিমাণ যেমন মাত্রাগত তেমনি সময়গতও। অর্থাৎ দিন দিন যেমন লবণাক্ততার তীব্রতা বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে লবণাক্ততার স্থায়িত্ব। ফলে একদিকে মানুষের জীবন জীবিকায় পড়েছে মারাত্মক প্রভাব, অন্যদিকে হুমকির মুখে পড়েছে জলজ জীববৈচিত্র্য। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত অস্বাভাবিক লবণাক্ত হয়ে উঠছে কীর্তনখোলার পানি শীর্ষক প্রতিবেদনটি উদ্বেগজনক। এতে বলা হয়েছে, কীর্তনখোলার পানিতে লবণের পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি বেড়েছে। ফলে এটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। চাষাবাদ থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারে নদীর পানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এখন তা ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। নদীর পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধির পেছনে বেশকিছু কারণকে দায়ী করা হচ্ছে। প্রথম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। দ্বিতীয় হচ্ছে নদীর গভীরতা কমে গিয়ে জোয়ার-ভাটা হ্রাস। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ ওপরে উঠে যাওয়ায় লবণাক্ত পানি যেভাবে প্রবেশ করছে, সেভাবে মিঠা পানি আসছে না। ফাল্গুন চৈত্র মাসে বৃষ্টির পরিমাণ কমে গিয়েও লবণাক্ততা বাড়ছে। উজানের পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় সাগরের লোনা পানি ধীরে ধীরে উজানের দিকে আসছে। ব্যাপারে এখনই সতর্ক সজাগ থাকতে হবে এবং সে অনুযায়ী দ্রুত করণীয় নির্ধারণ করা দরকার।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সামগ্রিকভাবে বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের কৃষি তথা সার্বিক জীবনযাত্রার ওপর। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততার সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমস্যা আরো প্রকট হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে পশ্চিমাঞ্চলের এলাকাগুলোয় ছড়িয়ে পড়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে সারা কৃষি ব্যবস্থাপনা বা শস্য বিন্যাসে। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নদ-নদীর পানিপ্রবাহ শুষ্ক মৌসুমে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে না। ফলে নদীর পানির বিপুল চাপের কারণে সমুদ্রের লোনা পানি যতটুকু এলাকাজুড়ে আটকে থাকার কথা ততটুকু থাকে না, পানিপ্রবাহ কম থাকার কারণে সমুদ্রের লোনা পানি স্থলভাগের কাছাকাছি চলে আসে। ফলে লবণাক্ততা বেড়ে যায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল এলাকায়।

গঙ্গার পানির ওপর নির্ভরশীল অঞ্চলের নদ-নদীগুলো মরে গেছে বা মুমূর্ষু অবস্থায় আছে। লবণাক্ততা কমাতে হলে উজান থেকে মিষ্টি পানিপ্রবাহ বাড়াতে হবে, বন্ধ করতে হবে সমুদ্রের লবণ পানি আসাও। উজানের নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনে ওইসব নদী খনন করে নাব্য বাড়াতে হবে। এরই মধ্যে পানির উচ্চতাজনিত কারণে লবণাক্ততা বেড়েছে। এদিকে ননিয়ানরেঞ্জ আক্রান্ত হওয়ার মুখে। মানুষের শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ লবণের প্রয়োজন এবং সেটি আসে খাদ্য পানি থেকে। কিন্তু উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। পানি শরীরে প্রবেশ করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জন্য তা হয়ে ওঠে আরো বেশি বিপজ্জনক। গর্ভাবস্থায় নারীরা বেশি লবণাক্ত পানি খেলে খিঁচুনি উচ্চ রক্তচাপ হয়। কারণে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে নারীদের গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা যাওয়ার হারও বেশি, যা বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) এক গবেষণায় বলা হয়, লবণাক্ততার কারণে উপকূলের নারীরা শুধু অকাল গর্ভপাতেরই শিকার হন না, শতাংশ শিশুও মারা যায়। এছাড়া বেশি লবণ খাওয়ার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক রয়েছে, যা হূদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। কিডনিতে এর প্রভাব পড়ে।

কীর্তনখোলায় লবণ পানির যে বিষয়টি শোনা যাচ্ছে, সেটিকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা করতে হবে। তড়িৎ পরিবাহিতা বেড়ে যাওয়ায় কী ধরনের কেমিক্যাল কম্পোজিশন বেড়েছে, সেগুলোও জানতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষায় -দ্বীপ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে লবণাক্ততা রোধে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। আমরা আশা করব, লবণাক্ততা বৃদ্ধি রোধের পাশাপাশি এর সঙ্গে অভিযোজনের উদ্যোগও নেয়া হবে। পানির লবণাক্ততা দূরীকরণের জন্য রিভার্স অসমোসিস স্বীকৃত একটি পদ্ধতি। ইংল্যান্ড প্রক্রিয়া ব্যবহার করে টেমস নদীর পানি ব্যবহারের উপযোগী করে তুলছে। দক্ষিণাঞ্চলে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় কয়েকটি প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। এটি পানযোগ্য পানির চাহিদা মেটাচ্ছে। একে আরো বিস্তৃত করা যেতে পারে।

দেশের উপকূল অঞ্চলে যে হারে লবণাক্ততা দিন দিন বেড়ে চলেছে, সেই হারে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। নদীগুলোয় নাব্য ফিরিয়ে আনা এবং প্রবাহ ধারণক্ষমতা বাড়ানো গেলে বন্যা ভাঙনও নিশ্চয়ই হ্রাস করা যাবে। একই সঙ্গে বৃষ্টির পানির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ যে বিশ্বের শীর্ষ ১০ বৃষ্টিবহুল দেশের একটি, বৃষ্টির পানির ব্যাপারে আমাদের সাংস্কৃতিক কারিগরি প্রবণতা দেখে তা বোঝার অবকাশ নেই। এত পরিষ্কার সুপেয় পানি আর কোনো উৎস থেকে পাওয়া যায় না বলে বিশ্বজুড়েই বৃষ্টির পানির কদর সবচেয়ে বেশি। অথচ আমাদের দেশে বৃষ্টির পানির সদ্ব্যবহারে কোনো ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। নজর দিতে হবে অভ্যন্তরীণ নদীগুলোকে দখল দূষণের হাত থেকে রক্ষায়। লবণাক্ততা আর্সেনিকের প্রকোপ কমাতেই হবে। এক্ষেত্রে পানি ব্যবস্থাপনার সঠিক কর্মপদ্ধতি তৈরি তার প্রয়োগ করতে হবে। নদী ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত কর্মকৌশলগুলোর সুষ্ঠু কার্যকরী বাস্তবায়ন এবং পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ন্যায়সংগত সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে পানি খাদ্যনিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন