করোনার নতুন ঢেউয়ে কাবু তামাম দুনিয়া। গত বছরের চেয়েও যেন বেশি শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে ভাইরাসটি। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে থমকে গেছে গোটা বিশ্ব। প্রতিদিনই সংক্রমিত রোগী ও মৃত্যুসংখ্যা বেড়েই চলেছে। করোনার চলমান ঢেউ মোকাবেলায় সারা দেশে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। গতকাল সকাল ৬টায় শুরু হওয়া লকডাউন চলবে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত। কিন্তু আসন্ন ঈদুল ফিতরকে ঘিরে নতুন সব নাটকের শুটিং অব্যাহত আছে।
নাটকের শুটিং
লকডাউনের ঘোষণা আসার পর টেলিভিশন নাটকের শুটিং নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল নাটকের সংগঠনগুলো। টেলিভিশন নাটকের শুটিং বন্ধ নাকি চালু রাখবেন সেটি নিয়ে রোববার এক বৈঠকে বসেন অভিনয়শিল্পী সংঘের নেতারা। তারা সিদ্ধান্ত নেন শুটিং বন্ধ থাকবে না। তবে শুটিং চালু রাখার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতনতা অবলম্বন ও কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
এ বিষয়ে অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব নাসিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার যেহেতু লকডাউন দিয়েছে, তা অবশ্যই আমাদের সবার মানতে হবে। কিন্তু প্রজ্ঞাপনে শুটিং বন্ধ নিয়ে তেমন কোনো নিষেধাজ্ঞা এখনো আমাদের দেয়া হয়নি। তাই আমরা শুটিং বন্ধ করতে বলছি না। তবে সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নাটকের শুটিং করতে হবে সবাইকে। যারা এখনো শুটিংয়ের জন্য ডেট দেননি তাদের আমরা নিরুৎসাহিত করব নতুন করে শুটিং না করার জন্য। কিন্তু যারা এরই মধ্যে শিডিউল দিয়ে ফেলছেন, তারা শুটিং চালিয়ে যেতে পারবেন। কারণ শুটিং মানেই তো শুধু শুটিং না, অনেকের রুটি-রুজির ব্যাপারও বটে। তাই সব দিক বিবেচনা করে আমরা শুটিং চালিয়ে যেতে বলেছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘শুটিং চলবে। আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। শুটিং চলা নিয়ে সমস্যা নেই। তবে সমস্যা হচ্ছে ট্রান্সপোর্ট নিয়ে। যেহেতু গণপরিবহন বন্ধ থাকছে সেক্ষেত্রে শুটিংয়ের ইউনিটের গাড়ি নিয়ে কোনো সমস্যা হবে কিনা এ নিয়ে আমরা কথাবার্তা বলছি। শুটিং চালানোর বিষয়ে আমরা একটা নির্দেশনা দিয়েছি। সন্ধ্যা ৬টার পর কোনো শুটিং হবে না। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শুটিংয়ের কাজ শেষ করতে হবে।’
ডিরেক্টরস গিল্ড থেকেও নাটকের শুটিং বিষয়ে একই রকমের নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। বণিক বার্তা থেকে ডিরেক্টরস গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান সাগরের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি কভিড পজিটিভ হয়েছেন, আছেন আইসোলেশনে। টেলিভিশন নাট্যকার সংঘ, অভিনয়শিল্পী সংঘ, ডিরেক্টরস গিল্ড ও টেলিভিশন প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টেলিপ্যাব)— এ চারটি সংগঠন নিয়ে গঠিত এফটিপিও এর চেয়ারম্যান নাট্যজন মামুনুর রশীদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আসলে সবকিছু চিন্তা করেই আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছি। এক্ষেত্রে শুটিং চলাকালে যেসব বিধিনিষেধ, করণীয় রয়েছে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা চাই না কেউ শুটিং করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে যাক, আবার এটাও চাই না যে শিল্পীরা শুটিং না করে আর্থিক সংকটে ভুগবেন। তাই আমাদের এ নতুন নীতিমালা।’ বিবৃতিতে এটাও বলা হয়েছে, যদি সরকার থেকে শুটিং বন্ধের নতুন কোনো নির্দেশনা আসে, তাহলে প্রয়োজনে শুটিং বন্ধ রাখা হবে।
গতকাল ছিল লকডাউনের প্রথম দিন, নাটকের শুটিং সেট থেকে বণিক বার্তাকে অভিনেত্রী উর্মিলা শ্রাবন্তী কর বলেন, ‘আসলে সব দিক চিন্তা করেই শুটিংয়ে এসেছি। আমার সিঙ্গেল নাটকের ডেট দেয়া ছিল। এখন যদি শুটিং না করি তাহলে ডিরেক্টর ফেঁসে যাবেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই শুটিং করছি। তবে খারাপ লাগছে লাইটের মানুষগুলোর জন্য। কারণ আমরা হয়তো যেকোনোভাবেই গাড়ি ম্যানেজ করে শুটিংয়ে আসছি, কিন্তু এ মানুষগুলোর পারিশ্রমিক কম, যার জন্য চাইলেই তারা গাড়িতে করে আসতে পারবেন না। তাই এ সহকর্মীদের নিয়ে ভিন্ন কিছু পরিকল্পনা করছি আমরা, যাতে তারা শুটিং স্পটে আসার জন্য পরিবহন সুবিধাটা পান। তার পরও লকডাউনের প্রথম দিন চলছে, সাবধানতা অবলম্বন করেই শুটিং করে যাচ্ছি। ইউনিট ছোট করে এনে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ চলছে। তবে আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি ঠিক কী হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।’
অন্যদিকে বেশ কয়েকটি সিনেমার শুটিং চলছে, আবার কিছু সিনেমার শুটিং বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ ২৯ দিন একটানা শুটিং শেষ করে পাবনা থেকে ঢাকায় ফিরেছেন চিত্রনায়ক শাকিব খান। তবে ঢাকায় ফিরেই তিনি হাসপাতালে গিয়ে করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে আধা ঘণ্টা হাসপাতালে ছিলেন। ডাক্তারদের পর্যবেক্ষণ শেষে সুস্থভাবেই বাসায় যান। বিষয়টি গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন শাকিব খান নিজেই।
স্টার সিনেপ্লেক্স বন্ধ, তবে খোলা অন্যান্য সিনেমা হল
করোনার প্রভাব থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়ে দেশের সব সিনেমা হলে মুক্তি পেতে শুরু করেছিল নতুন নতুন চলচ্চিত্র। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আবারো করোনার নতুন সংক্রমণ ঢেউ হানা দেয়ায় বাধাগ্রস্ত হতে পারে নতুন সিনেমা মুক্তি দেয়ার বিষয়টি। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেও এখন সামনে কী হবে তা নিয়ে নতুন করে দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে।
দেশের নানা প্রান্তের বিভিন্ন সিনেমা হলে ২ এপ্রিল মুক্তি পেয়েছে নতুন চলচ্চিত্র ‘টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই’। কিন্তু নতুন করে করোনার প্রভাব বাড়ায় আবারো আশঙ্কা দেখা দিয়েছে হল বন্ধের। গত বছরের সাধারণ ছুটি চলাকালে সিনেমা হল ছিল বন্ধ, যার জন্য ব্যাপক আর্থিক সংকটের মুখে পড়েন সিনেমা জগতের সংশ্লিষ্টরা। এবারো এমন কিছু হলে পুরো অর্থবছরেও মন্দা কাটানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সিনেমা হলের মালিকরা। হল বন্ধ হবে কিনা এ বিষয়টি এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হল মালিক ও প্রদর্শক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এবারের লকডাউনে সরকার বা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি সিনেমা হল বন্ধের নিদের্শ আসেনি। তাই আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই হলে সিনেমা প্রদর্শন করছি। তবে যেকোনো হল মালিক চাইলে হল বা সিনেমা বন্ধ রাখতে পারবেন। এতে সমিতির কোনো আপত্তি বা নির্দেশনা নেই। যদি সরকার থেকে বন্ধের নির্দেশনা আসে সেক্ষেত্রে সব হল বন্ধ করে দেয়া হবে।’
এদিকে স্টার সিনেপ্লেক্সের মিডিয়া ম্যানেজার মেসবাহ উদ্দিন আহমেদের কাছে পরিস্থিতি বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগে জারি করা সরকারি ১৮ দফা নির্দেশনা মেনেই স্টার সিনেপ্লেক্স চলছিল। দর্শকদের স্বাস্থ্যবিধির ওপর আমরা নজরও রেখেছিলাম। আসন সংখ্যা সীমিত করে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হচ্ছিল। কিন্তু নতুন করে ভাইরাসের ভয়াবহতা তীব্র হয়েছে। সে কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি লকডাউনের মধ্যে স্টার সিনেপ্লেক্স বন্ধ থাকবে। যেহেতু বিপণিবিতান বন্ধের নির্দেশনা এসেছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। এর বাইরে যদি নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসে তাহলে আপনাদের জানানো হবে।’
পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, সবাইকে সচেতন থেকে করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হবে। সবকিছু বিবেচনা করেই আগামীর পথ চলতে হবে—এমনটাই মনে করছেন সিনেমা ও নাটকের সংশ্লিষ্টরা।