বাংলাদেশ-মিয়ানমার-চীন ত্রিপক্ষীয় বৈঠক

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন দ্রুত শুরু হোক

এক বছর বিরতির পর বাংলাদেশ-মিয়ানমার-চীন ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো সম্প্রতি। বড় কোনো অগ্রগতি ছাড়াই সম্পন্ন বৈঠকে নেয়া হয়েছে কিছু সিদ্ধান্ত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মতদ্বৈধতা ছিল আলোচনার পুরোটা জুড়ে। বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল, গ্রাম বা অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। মিয়ানমার বলেছে, যে ৪২ হাজার রোহিঙ্গা তারা চিহ্নিত করেছে, তাদের দিয়ে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করা হবে। এর আগেও আমরা কয়েকবার এমন আশার কথা শুনেছি। বিশেষ করে ২০১৭ ২০১৯ সালে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তখন জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে মিয়ানমার ঘোষণা দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে রাজি হয়েছিল। বিস্তারিত তথ্য দিয়ে একটি তালিকাও তাদের দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথা রাখেনি দেশটি।

নতুন আলোচনায় চীনের উপস্থিতি বাংলাদেশকে আশা দেখাচ্ছে বৈকি। কারণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মিয়ানমার চীনের ভালো বন্ধু এবং তাদের ওপর নির্ভরশীলও বটে। আবার বাংলাদেশের সঙ্গেও চীনের সুসম্পর্ক রয়েছে। এর সদ্ব্যবহারে কূটনৈতিক সক্রিয়তা আরো বাড়াতে হবে। ইতিবাচক বিষয় হলো বাংলাদেশ অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জারি রেখেছে। কেননা আলোচনাগুলোকে বহুপক্ষীয় করতে গিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সংলাপ উপেক্ষা করলে মিয়ানমার বলত, আমরা সমাধান চাই, কিন্তু বাংলাদেশ চায় না। আবার শুধু মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা করলেও বাংলাদেশের পক্ষে সমাধান সম্ভব হবে না।

রোহিঙ্গা সমস্যার মতো একটা জটিল চলমান সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ মিয়ানমারের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি দুদেশের নাগরিক সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে আস্থার অবস্থা সৃষ্টি করা দরকার। আন্তর্জাতিক ফোরামে মিয়ানমারের পক্ষে থাকা চীন, রাশিয়া, ফিলিপাইন, লাওস, কম্বোডিয়া, বেলারুশ, জিম্বাবুয়ে ভিয়েতনাম আটটি দেশকে বাংলাদেশ গত তিন বছরে পক্ষে আনতে পারেনি। এমনকি ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল ভুটানদক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশকেও নয়। বাংলাদেশের জায়গায় কূটনৈতিক তত্পরতা জোরালো করা দরকার। কারণ, আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের পক্ষে যত বেশি দেশ থাকবে, বাংলাদেশের অবস্থান তত শক্ত থাকবে। আশার কথা হচ্ছে, গত ৩১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ওয়ার্কিং সেশনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, সেখানে নতুন করে নয়টি দেশ মিয়ানমারের পক্ষ ছেড়ে বিপক্ষে এসেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত চীন, ভারত জাপান এই তিনটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেরও সুসম্পর্ক রয়েছে। তাই মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে কাজ করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার মূল সমাধান অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের কোনো প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখেনি। প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা ফেরানোর ওপর মনোযোগ দেয়া উচিত।

সাম্প্রতিক সময়ে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের এমন অপরাধপ্রবণতা উদ্বেগজনক। রোহিঙ্গাদের অপরাধ নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রায় ৭৫০ মামলা হয়েছে। যেখানে রয়েছে অস্ত্র মাদক থেকে শুরু করে খুনের মামলাও। এমন তথ্য আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য সুখকর নয়। বাস্তবতা হলো আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের আর্থসামাজিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি কাম্য নয়। এত দীর্ঘ সময় ধরে রোহিঙ্গারা এখানে বসবাস করায় নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থাকেও সংকটাপন্ন করে তুলেছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা শরণার্থী ক্যাম্পের নিয়মের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে রোহিঙ্গারা শরণার্থী বসতি স্থাপন করেছে। শুধু তা- নয়, তাদের অবাধ বিচরণে স্থানীয় শ্রমবাজারে পড়েছে বিরূপ প্রভাব। মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাংলাদেশী পাসপোর্ট বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসন এবং বঙ্গোপসাগর দিয়ে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের মতো অনৈতিক কাজেও তারা জড়িয়ে পড়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দ্রুত পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর প্রত্যাবাসন। গত বছর জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চার দফা প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। প্রথম প্রস্তাব ছিল রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন এবং আত্মীকরণে মিয়ানমারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন দেখাতে হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে ছিল বৈষম্যমূলক আইন রীতি বিলোপ করে মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থা তৈরি করতে হবে এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের উত্তর রাখাইন সফরের আয়োজন করতে হবে। এছাড়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনেও প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে পাঁচ দফা প্রস্তাব করেছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে প্রস্তাব তুলে ধরলেও শঙ্কার জায়গা হলো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুতে জাতিসংঘ প্রভাবশালী দেশগুলো দীর্ঘদিনেও মিয়ানমারের ওপর তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং তারা বলছে, শরণার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না। এখন প্রশ্ন হলো তবে তারা কেন মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে না। যদি জাতিসংঘ প্রভাবশালী দেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের ওপর যথাযথ চাপ সৃষ্টি করা যেত, তাহলে অনেক আগেই সংকট দূর হতো। কিন্তু বিষয়ে প্রভাবশালী দেশগুলো জোরালো ভূমিকা রাখছে না।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুতে জাতিসংঘ এবং বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিলেও সে অর্থে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না কেউ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়া মানেই আরো দীর্ঘমেয়াদে তা ঝুলে যাওয়া। এর জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করতে হবে মিয়ানমারের ওপর। পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে কোনো গোষ্ঠী যেন পরিস্থিতি জটিল করতে না পারে, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। সংগত কারণেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে চীনের আরো কার্যকর জোরালো ভূমিকা আশা করে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে, আসিয়ান জোটসহ ভারত, জাপান দক্ষিণ কোরিয়াও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরো কার্যকর ভূমিকা নিয়ে সম্পৃক্ত হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং রোহিঙ্গারাও আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন