করোনার প্রভাব মোকাবেলায় বিভিন্ন খাতের জন্য কয়েক দফায় প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদানের মাধ্যমে উৎপাদনমুখী খাত ও কর্মসংস্থানকে কিছুটা হলেও চাঙ্গা রাখতে সক্ষম হয়েছে সরকার। এর আগে কৃষি, শিল্প-সেবা খাতসহ প্রবাসীদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়। এবার কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে গতি ফেরাতে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নতুন দুটি প্রণোদনা কর্মসূচি অনুমোদন করা হয়েছে। সরকারের এ পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক। কিন্তু সমস্যা তৈরি হচ্ছে বাস্তবায়ন পর্যায়ে। প্রথম দফায় প্রণোদনা বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ গুরুভার ছিল ব্যাংকের ওপর। দেখা গেছে, বড় শিল্প-ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা সুফল পেলেও তদারকির দুর্বলতাসহ কিছু বিধিমালার ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার কারণে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি পক্ষ প্রণোদনার সুযোগ নিতে পারেনি। নতুন ঘোষিত প্যাকেজ বাস্তবায়নে তাই আগেকার দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা জরুরি। তা না হলে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতসহ গ্রামীণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের সম্ভাবনা অধরাই থেকে যাবে।
তিন মাসের লকডাউনে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ায় দেশের ছোট-বড় সব উদ্যোক্তাই করোনার প্রাদুর্ভাবে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কাজ হারিয়েছেন অনেকে। সঞ্চয়ের অভাবে ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয়েছেন উদ্যোক্তারা। অর্থনীতিবিদদের মতে, পুঁজি বেশি বলে বড় উদ্যোক্তারা সহজে যেকোনো বাধা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। বিপরীতে পুঁজি কম থাকায় ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে ওঠাই মুশকিল হয়ে পড়ে। করোনা পরিস্থিতিতে হয়েছেও তাই। সেক্ষেত্রে ঋণ বা প্রণোদনা প্যাকেজের প্রয়োজনটা এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদেরই বেশি। তবে এখানে যেমন অবকাঠামোগত সমস্যা বিদ্যমান, তেমনি আছে ব্যাংকের পক্ষপাতও।
কানাডাসহ উন্নত দেশের সরকারগুলো প্রণোদনা প্যাকেজ ও আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে নিম্ন সুদের পাশাপাশি শূন্য সুদে ঋণ সহায়তায় প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। নিম্ন সুদহারের দিকে নজর দিয়ে ঋণ সুবিধা দিয়েছে জাপানও। নেপাল সরকার শ্রম ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সহায়তা করছে চাকরিচ্যুতদের। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দিকে জোর দিচ্ছে তারা। দেশে ও দেশের বাইরে নেপালের যে শ্রমিকরা চাকরি হারিয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের তালিকা তৈরির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে সরকারি ও বেসরকারি যেসব সংস্থায় চাকরির সুযোগ রয়েছে, তাদের সেখানে পাঠানো হচ্ছে। ভারত সরকারও গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা স্কিম ও পিএম কিষাণের মতো কর্মসূচির আওতায় নগদ সহায়তা প্রদান করছে। করোনায় অধিক ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছতে কেন্দ্রীয়ভাবে উন্নয়ন করা হয়েছে ন্যাশনাল আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ও সামাজিক সুরক্ষা সরবরাহ কার্যক্রমের। শ্রীলংকার সরকার ন্যাশনাল সোসিও-ইকোনমিক রেজিস্ট্রি ব্যবহারের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিতদের চিহ্নিত করছে। তালিকায় যাদের নাম নেই, মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাদের চিহ্নিত ও বাছাই করা হচ্ছে। প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধাগুলো যাতে সঠিক ভুক্তভোগীর কাছে পৌঁছানো যায়, তার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বায়োমেট্রিক পেমেন্ট সিস্টেম; যা জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের সঙ্গে সংযুক্ত। ‘সমৃদ্ধি’ কর্মসূচির আওতায় নগদ টাকা সরবরাহের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে শ্রীলংকার সরকারের সহযোগিতা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। সরাসরি নগদ অর্থসহায়তার পাশাপাশি ডাক যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও কাজে লাগিয়েছে তারা। মালদ্বীপ ও ভুটান নিবন্ধন এবং তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছে ইন্টারনেট ও সেলফোন।
করোনার ধকল কাটাতে প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু ও কার্যকর বাস্তবায়ন না হলে দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হবে। সিএমএসএমই ব্যবসার একটি বড় অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের, যাদের ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত। এ খাতকে টেকসই ও বিকশিত করতে বর্তমান প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ দেয়ার সময়সীমা বাড়ানো এবং ঋণ সহজ করতে হবে। নথিগত সমস্যা, জামানতের অভাব ও সুসম্পর্কের অভাবে ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যাংকগুলো সিএমএসএমই খাতে ঋণ দিতে অনাগ্রহ দেখিয়েছে। এ খাতে ঋণ দেয়ার ব্যয় অনেক বেশি বলেও দাবি করছে তারা। এছাড়া সিএমএসএমইর সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যভাণ্ডার না থাকায় এ প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা অনেকেই নিতে পারছে না। শহরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ কিছুটা পেলেও জেলা শহরের ব্যবসায়ীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলের উদ্যোক্তাদের অনেকেই এই ঋণ কার্যক্রম সম্পর্কে জানেন না। তথ্য ঘাটতির অভাবও বড় সমস্যা।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, রফতানিমুখী বৃহৎ শিল্প, কৃষি উন্নয়ন, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর একটি বড় অংশ বাস্তবায়িত হয় ব্যাংকঋণের মাধ্যমে। দেশের ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান তারল্য সংকট ও মন্দ ঋণের চাপ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরেই দেশের ব্যাংকিং খাত ঘুরপাক খাচ্ছে অনিয়মের ঘূর্ণিতে। ক্রমবর্ধমান মন্দ ঋণের চাপ ও তারল্য সংকটের ঝুঁকি নিয়ে সুষ্ঠুভাবে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন অনেকটাই অসম্ভব। ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে অসাধু গোষ্ঠীর সুযোগ নেয়ারও। কুটির, অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি বা সিএমএসএমই উদ্যোক্তারা আগের সহায়তা কর্মসূচি থেকে খুব কমই ঋণ পেয়েছেন। অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেয়ার পরও ব্যাংকগুলো থেকে তারা কোনো সাড়া পাননি। হয়রানি ও টালবাহানার শিকার হয়েছেন।
সরকারের প্রণোদনার ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কৃষক, প্রান্তিক উদ্যোক্তারাই সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছেন। তাদের হাতে টাকা পৌঁছানো না গেলে কর্মসংস্থান হবে না। এছাড়া প্রকৃত জনগোষ্ঠীর কাছে প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পৌঁছে দিতে হলে সুবিধাভোগী বাছাই, ত্রাণ বিতরণ ও ত্রাণের আওতা বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের বিস্তৃতি জরুরি। অভিযোগ আছে বিভিন্ন ত্রাণ কার্যক্রমে বাছাই ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব নিয়েও। এসব কারণে প্রকৃত অংশীজনরা প্রণোদনার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তদারকি বাড়াতে হবে। প্রকৃত অংশীজনদের প্রণোদনার সুবিধা নিশ্চিত করতে আগের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিতপূর্বক যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি।
