দুই শতাব্দী ধরে টিকে আছে ইস্পাহানি গ্রুপ

সুজিত সাহা

ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে ইরানের ইসফাহান থেকে মুম্বাই এসে ব্যবসা শুরু করেন হাজি মোহাম্মদ হাশিম। ১৮২০ সালে সেখানেই যাত্রা করে বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ পারিবারিক কনগ্লোমারেট ইস্পাহানি গ্রুপ। কালের পরিক্রমায় কলকাতা-ঢাকা হয়ে চট্টগ্রামে সরে আসে গ্রুপটির ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু। চলতি বছরেই দুই শতাব্দী পূর্ণ করেছে ইস্পাহানি গ্রুপের ব্যবসা। 

এ দুই শতাব্দীতে ইস্পাহানি গ্রুপের ব্যবসা বড় হয়েছে। গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই শীর্ষ কনগ্লোমারেটগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে গ্রুপটি। পরিবারও বড় হয়েছে। সদস্যরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কেউ কেউ ব্যবসার বাইরে ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যদিও পরিবার আলাদা হয়নি। ভাগ হয়নি মূল পারিবারিক ব্যবসাও। এর কারণ হিসেবে ইস্পাহানি পরিবারের সদস্যরা বলছেন, পরিবারের অলিখিত সংবিধান হিসেবে নিজস্ব কিছু নীতি অনুসরণ করে চলার কারণেই এখনো একসঙ্গে থাকতে সমর্থ হয়েছেন তারা। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের পারিবারিক ব্যবসাভিত্তিক বড় কনগ্লোমারেটগুলোয় ভাঙনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এসব কনগ্লোমারেটের অনেকগুলোই হয় ভাগ হয়ে গিয়েছে; নয়তো ভাগ হওয়ার পথে। নানা কারণে দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মে এসেই খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়ছে পারিবারিক ব্যবসা। অন্যদিকে ইস্পাহানি পরিবারের সদস্যরা নিজস্ব ব্যক্তিগত উদ্যোগ বা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লেও পরিবারের মূল ব্যবসাকে কখনো ভাগ করেননি। 

লন্ডনভিত্তিক ইস্পাহানি অ্যাডভাইজরি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী ইরাজ ইস্পাহানি বাংলাদেশে এমএম ইস্পাহানি লিমিটেডের অন্যতম পরিচালক ও পর্ষদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এমএম ইস্পাহানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মির্জা সালমান ইস্পাহানির পিতামহ  মির্জা আহমদ ইস্পাহানি ও ইরাজ ইস্পাহানির পিতামহ মির্জা আবুল হাসান ইস্পাহানি ছিলেন দুই ভাই। 

এতগুলো প্রজন্ম ধরে পরিবারের ব্যবসা একসঙ্গে চালিয়ে যেতে পারার কারণ সম্পর্কে গত বছর লিচেনস্টাইনভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান কায়সার পার্টনারকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে ইরাজ ইস্পাহানি বলেছিলেন, কোন বিষয়টি গ্রহণযোগ্য, আর কোনটি নয় বা কোন বিষয়টি উৎসাহব্যঞ্জক, কোনটি নয়; সে বিষয়ে আমাদের পরিবারে সুস্পষ্ট লাইন টেনে দেয়া রয়েছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে লিখিত কোনো পারিবারিক সংবিধানের অনুপস্থিতিতে অনানুষ্ঠানিক এসব নিয়মই বছরের পর বছর ধরে আমাদের জন্য দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে। শিশু বয়স থেকেই সম্পদশালী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যেসব দায়িত্ব তৈরি হয়, সেগুলো আমাদের শেখানো হয়েছে। এ কারণেই আমরা যে সমাজে বসবাস করছি ও কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি, সেখানকার পরিস্থিতিতে সব সময়ই একটি ব্যবধান তৈরি করতে চেয়েছি আমরা।

এর আগে ২০১৭ সালে লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে (এফটি) ইরাজ ইস্পাহানি জানিয়েছিলেন, তিনি ও তার স্বজনেরা কয়েকজন উপদেষ্টাকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের মূল্যবোধকে তুলে ধরতে একটি পারিবারিক ‘সংবিধান’ তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্ককেও আরো ঘনিষ্ঠভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে বলে সে সময়  আশা প্রকাশ করেছিলেন ইরাজ ইস্পাহানি।

সে সময় তিনি বলেছিলেন, কোনো ধরনের সংবিধান ছাড়াই আমরা একক একটি পরিবার হিসেবে কয়েক প্রজন্ম ধরে ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছি। আমাদের ব্যবসা চালানোর বা মূল্যবোধগুলো লিখে রাখার প্রয়োজন পড়েনি। আমরা সেগুলো অনুধাবন করেছি। এগুলো নিয়ে বেড়ে ওঠার কারণেই সবাইকে সাধারণ একটি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

ইস্পাহানি পরিবারের বর্তমান দুই প্রজন্মের সদস্য সংখ্যা অর্ধশতাধিক। এ কারণে কোম্পানির উদ্দেশ্য ও পারিবারিক মূল্যবোধ পরবর্তী প্রজন্মগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন ইস্পাহানি পরিবারের সদস্যরা। এ অবস্থায় একটি লিখিত সংবিধান পরবর্তী প্রজন্মগুলোর মধ্যে এসব ব্যবসার প্রয়োজনীয়তা ও পারিবারিক নীতিবোধ ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন ইরাজ ইস্পাহানি।

ভারতীয় উপমহাদেশে এমএম ইস্পাহানি চায়ের জন্য বিখ্যাত হলেও তাদের ব্যবসা ছড়িয়ে আছে নানা খাতে। বর্তমানে প্রায় ২০ হাজারের বেশি কর্মী এমএম ইস্পাহানিতে কর্মরত রয়েছেন। হাজি মোহাম্মদ হাশিম ইসফাহান থেকে এসে ব্যবসা শুরু করেছিলেন মুম্বাইয়ে। এরপর ইস্পাহানিদের ব্যবসা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। হাজি মোহাম্মদ হাশিমের মৃত্যুর পর পরিবারের ব্যবসার দায়িত্ব নেন তার পৌত্র মির্জা মেহেদি ইস্পাহানি (১৮৪১-১৯১৩)। তিনি ব্যবসায় বেশকিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন। প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তর মুম্বাই থেকে স্থানান্তর করেন মাদ্রাজে। ব্যবসার কাজে তিনি উপমহাদেশ ছেড়ে অন্যান্য স্থানেও পাড়ি দেন। বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে গিয়ে সুদূর মিসরেও তিনি দীর্ঘদিন থেকেছেন। সেখানে এ দেশ থেকে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য, চা, হলুদ, তেঁতুল, বাদাম ইত্যাদি পণ্য রফতানি করতেন মির্জা মেহেদি ইস্পাহানি। ১৮৮৮ সালে তিনি ঢাকায় প্রতিষ্ঠানটির একটি কার্যালয় চালু করেন। ১৯০০ সালে মির্জা মেহেদি ইস্পাহানির ছেলে মির্জা মোহাম্মদ ইস্পাহানি কলকাতায় এমএম ইস্পাহানি অ্যান্ড সন্সের কার্যালয় খোলেন। মির্জা মোহাম্মদ ইস্পাহানির বড় ছেলে মির্জা আহমদ ইস্পাহানি ব্যবসা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হন ১৯১৮ সালে। ছোট ভাই মির্জা আবুল হাসান ইস্পাহানিকে নিয়ে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে ‘এমএম ইস্পাহানি লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তর কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়। বন্দরকে ব্যবহার করে পুঁজি সম্প্রসারণের ধারণা থেকে চট্টগ্রামেই প্রতিষ্ঠানের মূল কার্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইস্পাহানি পরিবার। বন্দর নগরীটিতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন করপোরেট শিল্প গ্রুপ সময়ের প্রয়োজনে ঢাকায় প্রধান কার্যালয় সরিয়ে নিলেও ইস্পাহানি গ্রুপের প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামেই থেকে গিয়েছে।

স্বাধীনতার আগে দেশের সবচেয়ে সম্পদশালী ২২ পরিবারের একটি ছিল ইস্পাহানি পরিবার। স্বাধীনতার পর পরিবারটির মালিকানাধীন চা বাগান ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করে ফেলা হয়। তবে পরিবারটি বাংলাদেশে চলে আসার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের চা বাগানগুলো ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয় তত্কালীন সরকার। 

পরিবারঘনিষ্ঠ ও ইস্পাহানি গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তারাও মনে করছেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ইস্পাহানি পরিবারের ঈর্ষণীয় ব্যবসায়িক সাফল্যের পেছনে রয়েছে তাদের পারিবারিক মূল্যবোধ, সততা ও একনিষ্ঠতা। ইস্পাহানি পরিবারের প্রবীণ পুরুষ মির্জা সাদরি ইস্পাহানির সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। 

মূলত একটি পারিবারিক শিল্প গ্রুপ হলেও ইস্পাহানি গ্রুপের প্রধান চালিকাশক্তি প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা ও পরীক্ষিত কর্মীরা। ইস্পাহানি গ্রুপের পরিবারঘনিষ্ঠ চা খাতের এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, গ্রুপটি ব্যবসায়িক নীতিনির্ধারণে শুধু পরিবারকেন্দ্রিক মতাদর্শে বিশ্বাস করে না। প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে যোগ্য কর্মীকে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনেই বড় দায়িত্ব দেয়া হয়। করপোরেট কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে পরিবারবহির্ভূত শীর্ষ কর্মীরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাস্তবায়নসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করে থাকেন। এমনকি পরিবারের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হলেও তা দক্ষ কর্মীদের ক্যারিয়ারের বিকাশের পথে বাধা হয়ে ওঠেনি কখনো।

দীর্ঘ ৪৫ বছর প্রতিষ্ঠানটিতে দায়িত্ব পালন করে ২০১৯ সালের ১২ জুলাই মারা যান ইস্পাহানির চা বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা শান্তনু বিশ্বাস। শান্তনু বিশ্বাসের পিতা চিররঞ্জন বিশ্বাসের সঙ্গে মির্জা আহমেদ ইস্পাহানির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সুবাদে তার পুত্রকে প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। বিশ্বস্ততা ও কর্মদক্ষতার সুবাদে শান্তনু বিশ্বাস ছোট একটি পদ থেকে ধীরে ধীরে চা খাতের অন্যতম শীর্ষ আসনে চলে আসেন। আমৃত্যু ইস্পাহানি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। শান্তনু বিশ্বাসের মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন শাহ মইনুদ্দিন হাসান, যিনি ২৫ বছর ধরে ইস্পাহানি টি লিমিটেডে কর্মরত রয়েছেন। শাহ মইনুদ্দিন হাসানও তার ক্যারিয়ার গড়েছেন ইস্পাহানিতে। শাহ মইনুদ্দিন হাসান বর্তমানে  বাংলাদেশ টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএ) সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। 

বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, করপোরেট জগতে একটি সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ একজন কর্মীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আত্মসম্মান বজায় রেখে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করা ও কাজের মূল্যায়ন পাওয়ার পরিবেশ রয়েছে ইস্পাহানি গ্রুপে। এ কারণে এখানকার কর্মীরা অন্যত্র আরো বেশি বেতন-ভাতা পাওয়ার পরিবর্তে ইস্পাহানি গ্রুপে কাজ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মালিক পক্ষ থেকে আরোপিত সিদ্ধান্ত না আসায় কর্মীরা সবাই স্বাধীনভাবে গ্রুপের ভালোর জন্যই কাজ করতে চান, যা এমএম ইস্পাহানির সাফল্যের অন্যতম মূলমন্ত্র।

বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে চায়ের (চায়ের ট্রেডিং, ব্র্যান্ড ও বাগান) সূত্র ধরে বেশি পরিচিত হলেও কটন ও টেক্সটাইল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, ভোক্তাপণ্য, এগ্রো, আইসিটি, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, প্যাকেজিং, রিয়েল এস্টেট, শিপিং, জুট, রেস্তোরাঁ ও বেকারি, আতিথেয়তা ও অবকাশ, পোলট্রি, ট্রেডিং ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে ইস্পাহানি গ্রুপের।

শুধু ব্যবসা নয়, করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) বাইরেও দেশে নানা সামাজিক সেবামূলক কর্মকাণ্ড চালু রেখেছে ইস্পাহানি গ্রুপ। সারা দেশে শিক্ষা বিস্তারে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা স্থাপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অসংখ্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল গড়ে তুলেছে। এর মধ্যে ঢাকার ফার্মগেটে অবস্থিত ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হাসপাতালটি এখন বিশ্বখ্যাত চক্ষু প্রতিষ্ঠান সাইট সেভার্স ইন্টারন্যাশনাল ও অরবিসের সঙ্গে যৌথ কর্মসূচি পরিচালনা করছে। এছাড়া বহুজাতিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক লিমিটেডের সহায়তায় এ হাসপাতাল বাংলাদেশে অন্ধত্ব দূরীকরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে ইস্পাহানি গ্রুপ। করোনাকালেও দেশের নানা খাতে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ও বৈষয়িক সহায়তা দিয়েছে ইস্পাহানি গ্রুপ। এমনকি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মী ছাঁটাই বা বেতন-ভাতা কমানোর ঘটনাও ঘটেনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন