গ্রামীণ মানুষের মনস্তত্ত্ব

তানভীর শাতিল

হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে ওঠা আজকের বাংলাদেশ তার পথপরিক্রমায় মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের মাইলফলকগুলো পেরিয়ে, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের মহাসড়কে যাত্রা করেছে। এ রোল মডেল উন্নয়নের গড়পড়তা বয়ানে দেখা যায়, নানান ধরনের সূচকের গতিপথ। উন্নয়নের যে বয়ান সেখানে কেবলই বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান পরিবর্তনগুলো নিয়েই আলোচনার ঘনঘটা। তবে এ দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন সূচকসমূহের কীরূপ প্রভাব চিরায়ত সামাজিক কাঠামোগুলোতে পড়ছে কিংবা ব্যক্তিক সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রাত্যহিক জীবনে কী পরিবর্তন আসছে, তা নিয়ে খুব একটা আলোচনা চোখে পড়ে না। 

খুব সহজ কথায় যদি বর্তমান সময়টাকে আমলে নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি তবে দেখা যায়, গ্রামীণ সমাজে যে শহুরে হাওয়া লেগেছে যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নতি, ডিজিটাল প্রযুক্তির বিস্তার, কৃষিতে প্রযুক্তির বিকাশ ও বাণিজ্যিকায়নের বিস্তার, শিল্পায়নভিত্তিক নগরায়ণ মানুষের কর্মসংস্থান প্রভৃতি সমহারে নতুন এক পরিবর্তনকে চিত্রায়ণ করে উন্নয়নের মহাবয়ানে। কিন্তু একজন নৃবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এ মহাবয়ানের বাইরে থেকে দেখতে পাই, এসব অবকাঠামোগত পরিবর্তন মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে নানা মাত্রায় প্রভাব রেখে যায়। প্রতিটি প্রভাবের সমষ্টি হিসেবে মোটা দাগে এটাকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে পরিবর্তন হিসেবে বোঝা যেতে পারে।

এ পরিবর্তন সামাজিক মানসিকতা থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক সামাজিক ও ব্যক্তিক আচরণ অবধি বিস্তৃত। এই বিস্তর আলোচনা এ অল্প পরিসরে পেড়ে বসার দুঃসাহস আমার নেই। আর এ আলোচনা নিয়ে অন্য কোনো সময়ে আলোচনার অবতারণা করা যেতে পারে, ভিন্ন পরিসরে। আজকের আলোচনায় বরং আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি বিষয়ের উদাহরণ টেনে আলোচনা করতে চাই। এ সামাজিক সাংস্কৃতিক ঘটনাভিত্তিক ‘পরিবর্তনের’ উদাহরণগুলোকে একেকটা কেস হিসেবে বিবেচনা করলে বুঝতে সুবিধা হয়। এ পরিবর্তনগুলোর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব উভয়ই রয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে। 

বর্তমান সময়ের অবকাঠামোগত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ভার্চুয়াল যোগাযোগের বিস্তার, ডিজিটাল বাস্তবতার জীবন যেভাবে নাগরিক জীবনকে গ্রামের কাছে পৌঁছায়, ঠিক তেমনি গ্রামকেও শহরের কাছাকাছি নিয়ে আসে। ব্যবসা-বাণিজ্যের যে প্রসার হয়েছে তাতে নগর জীবনে ব্যবহার্য পণ্যে বাজার বিস্তার লক্ষণীয়। সোজা কথায় শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের বাজার গ্রামীণ লোকায়ত পণ্যসামগ্রী ও তার সঙ্গে যুক্ত পেশার মানুষদের জীবনকে কোণঠাসা করে দিয়েছে অনেকাংশেই। আর এ গ্রামীণ পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলো যে সামাজিক সাংস্কৃতিক বলয়ে আবর্তিত হওয়ার কথা সে কক্ষপথ থেকেও ছিটকে পড়ে। ফলে গ্রামীণ যে উৎপাদন ব্যবস্থার ভারসাম্য তা নানাভাবেই বেসামাল হয়ে যায়। গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সমাজের একজন গ্রামীণ মানুষ টিকে থাকার তাগিদে পেশা পরিবর্তন করার বাস্তবতায় এসে উপনীত হয়। আর শিল্পায়নের নগরে নাগরিক উৎপাদন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সব সামাজিক সাংস্কৃতিক বন্ধনের শেকড় ছিন্ন হয়ে জীবন খুঁজে পাওয়ার বাসনায় গ্রাম থেকে শহরমুখী হয়। নগরে ভাসমান মানুষ আর সকালে টুকরি কোদাল নিয়ে দিনমজুর কিংবা রিকশাচালকদের জীবনের বাস্তবতাকে নিবিড়ভাবে দেখলে খুব সহজেই সেই প্রেক্ষিতটা অনুধাবন করা যায়। 

আবার এর বাইরেও নানান মাত্রার বিড়ম্বনা উন্নয়নের ছায়ায় লুক্কায়িত আছে, অনেকটা প্রদীপের তলায় অন্ধকারের মতো। যেমন গ্রামীণ সমাজে একজন কুমার কিংবা গৃহস্থালি পণ্য তৈরি করা বাঁশ-বেতের কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলো, তাদের পণ্য নিয়ে বেকায়দায় পড়ে যায় যখন বাজারে প্লাস্টিকের নানান বাহারি পণ্য মানুষের হাতে চলে আসে। পাটের দড়ি, বস্তা, ব্যাগের জায়গায় যখন পলিথিন, প্লাস্টিক চলে আসে কিংবা মাটির দধির হাঁড়ির জায়গায় প্লাস্টিকের বাটি। এসবই মানুষের জীবনকে সহজ করছে হয়তো, তবে টেকসই উন্নয়নের এ যুগে মাটি, পানি, প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার প্রেক্ষিত থেকে দেখা হয় অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার ক্ষেত্রে নিবিড়ভাবে ভাববার অগাধ অবকাশ রয়েছে। 

আর যদি খুব নির্দিষ্টভাবে, কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলো দেখা যায় তাহলে আমরা দেখতে পাই কৃষিতে প্রযুক্তির বিস্তার পুরো কৃষি সংস্কৃতিকে নতুন এক রূপদান করেছে। কৃষি সংস্কৃতির যে প্রতিবেশ তার মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। হাইব্রিড, জেনেটিক্যালি মোডিফাইড ফসলের জাত থেকে শুরু করে সবুজ বিপ্লবের রাসায়নিক ও যান্ত্রিকায়নের কৃষি, কৃষি প্রতিবেশে পরিবর্তন এনেছে। যেমন গ্রামের কৃষকের সঙ্গে কথা বললে জানা যায় যে এখন কৃষিতে অনেক খরচ করতে হয়। পর্যাপ্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক, আগাছানাশক ব্যবহার না করলে ফসল হয় না। ফলে কৃষি হয়ে পড়েছে অনেকটাই অর্থ লগ্নিকারী একটা খাত। এক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় যে আগের যে কৃষি সমাজ ব্যবস্থা ভূমির মালিক, কৃষক, বর্গা কৃষক, কিংবা কৃষি মজুরের আন্তঃসম্পর্ক সেখানেও পরিবর্তন এসেছে। এখন দেখা যায়, বড় আকারের ভূমি মালিকের সংখ্যা কমে এসেছে। গ্রামীণ এই ধনিক শ্রেণী তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষিত করে শহরমুখী হয়ে পড়েছে। আর যে যুবসমাজ শিক্ষিত হচ্ছে তারা গ্রামের কৃষিকাজের সঙ্গে আর নিজেদের জড়াতে আগ্রহী হচ্ছে না। তারা বরং শহুরে জীবনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।

আগের কৃষি ব্যবস্থায় এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ফলে চুক্তিভিত্তিক বর্গা বা লিজ নিয়ে আবাদ করা ক্ষুদ্র কৃষক শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছে, যাকে ক্ষুদ্র কৃষক বা ‘স্মল হোল্ডার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে উন্নয়ন প্যারাডাইমে। ফলে দেখা যায়, লিজ নেয়া জমিতে অধিক ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে আধুনিক কৃষি মূলত অজৈব কৃষিপণ্যের বাজারকেই প্রস্তাব করে। আবার যদি যান্ত্রিকায়িত কৃষিকে আলোচনায় আনা যায় সেখানে দেখা যায় গবাদি পশুপাখির ওপর নির্ভরশীল কৃষি সংস্কৃতিতে এক আমূল পরিবর্তন এসেছে। এই গবাদি পশুপাখি পালনের সঙ্গে কৃষক সমাজের যে সাংস্কৃতিক বন্ধন তাতেও একটা পরিবর্তিত রূপ ধরা পড়ে। শরত্চন্দ্রের মহেষের উদাহরণ কৃষক পরিবারে এখন খুব একটা চোখে পড়ে না। বরং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নানান হাইব্রিড জাতের খামারি চোখে পড়ে। ফলে সামাজিক মানসিকতা তথা সংস্কৃতিতে এমন নানান পরিবর্তন লক্ষ করা যাবে প্রতিটা ক্ষেত্রেই।

কিন্তু প্রশ্ন হলো বর্তমান নগরায়ণের যে এজেন্ডায় গ্রামীণ সমাজ শহুরে সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে সেটি আসলে কীভাবে ঘটছে, সেই প্রক্রিয়াটা কী? এই প্রক্রিয়াটা এতটাই জটিল এক মিথস্ক্রিয়া যার সহজ কোনো সংজ্ঞায়ন এ মুহূর্তে মাথায় আসছে না। তবে এতটুকু অনুধাবিত হয় যে গ্রামীণ সমাজের যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা তা অনেকটাই সালভাদোর দালির সুরিয়্যাল চিত্রকলায় সময়ের সঙ্গে গলে পড়ার মতো, ‘পরাবাস্তব’ একটা বাস্তবতা ব্যক্তিক জীবনে বিরাজ করছে। এটাকে সহজভাবে বুঝতে বরং একজন গ্রামীণ কৃষাণীর ডিজিটাল প্লাটফর্মে তার প্রবাসী ছেলের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলার অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিত থেকে দেখলে সহজে বোঝা সম্ভব হয়। যখন সেই গ্রামীণ কৃষাণী আধুনিক প্রযুক্তির অভিজ্ঞতা বিস্ময়ভরে অনুধাবন করে, এমন অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয় যেন, ‘এও কি সম্ভব!’

‘প্রবাসী’ বাংলাদেশী গ্রামীণ সমাজে আরেকটা ফেনোমেনা (ঘটনা)। প্রবাস জীবন, প্রবাসে পাড়ি জমানোর ব্যাপারে পুশ-পুল ফ্যাক্টর নিয়ে নতুন করে আলোচনার তেমন কিছু না থাকলেও এতটুকু বলা যায় যে, ‘প্রবাসী’ শব্দটি গ্রামীণ সমাজে আলাদা এক দ্যোতনা হিসেবে হাজির হয়, যা সামাজিক মূল্যায়ন ও সম্মানের প্রেক্ষিত থেকে আলাদা এক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটায়। এখানে পুঁজিভিত্তিক সামাজিক স্তরায়ন প্রকটভাবে লক্ষ করা যায়। যেমন গ্রামে যারা প্রবাসে বসবাস করছে তাদের সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণা হলো, বিদেশ বা প্রবাসে থাকা মানেই ভালো আয়-রোজগার আর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উচ্চতর অবস্থায় উপনীত হওয়ার একটা পথ। যদিও প্রবাসে পাড়ি জমিয়ে উন্নত জীবনের আশায় অনেকে সর্বস্বান্তও হয় কিংবা তৌকীর আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’র উদাহরণও স্থাপিত হয় হয়তো। তবুও প্রবাসী আপাতদৃষ্টিতে সমাজে নতুন সংস্কৃতির (প্রবাসীর স্ত্রী, সন্তান, পরিবার, জ্ঞাতি সম্পর্ক) অবতারণা করে গ্রামীণ প্রাত্যহিক সামাজিক জীবনে। ফলে গ্রামীণ সমাজের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে পরিবর্তন একরৈখিকভাবে বোঝার চেষ্টা মোটেও কার্যকর হতে পারে না। সূচকের মানদণ্ডে সামাজিক সাংস্কৃতিক নানান মাত্রার ইতিবাচক, নেতিবাচক পরিবর্তনগুলোকে মাপার পাশাপাশি বরং এর ঘটনাভিত্তিক নিবিড় (ফেনোমেনোলজিক্যাল) বিশ্লেষণ এখন গুরুত্বপূর্ণ।

এসব খিটমিটে আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে খুব সহজ বাংলায় যদি আমরা আমাদের চারপাশের প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাগুলোকে নিবিড়ভাবে একটু দেখার চেষ্টা করি তবে খুব সহজে নানান পরিবর্তনগুলো সামনে চলে আসবে একের পর এক। কিছু হয়তো অতীতকাতুরে করে তুলবে আবার কিছু হয়তো বর্তমানের চাকচিক্যকে সামনে নিয়ে আসবে। তবে এ অতীত আর বর্তমানের মাঝে তুলনা করে একটা আলোচনা দাঁড় করানো যায়, যার মাধ্যমে সামনের দিনে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের দিকে এগোনোর সাঁকোগুলোকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। 

এই পর্যায়ে নানান অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিবিধ পারিসংখ্যানিক বয়ানে দেখা যায় জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান দিন দিন কমে আসছে। জাতি অনেক বেশি ব্যবসা আর কারখানানির্ভর হয়ে উঠছে। ফলে গ্রামীণ সমাজে আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনোসামাজিক পরিসরে বিস্তর পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে তা সহজে অনুমেয়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক কিংবা সামাজিক মানসিকতার প্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা করলে, মানুষের আচরণগত ও অভ্যাসগত জায়গায় নানান পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। তবে উদাহরণ হিসেবে বড় যে পরিবর্তনটা খালি চোখে ধরা পড়ে তা হলো প্রযুক্তির ব্যবহারের বিস্তৃতি। তা সেটা গ্রামের চায়ের দোকানের কাঠ কয়লার উনুন থেকে পারমাণবিক চুল্লি কিংবা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উেক্ষপণ যে পরিসরেই হোক না কেন! আর প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে হলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরে একধরনের পরিবর্তন আসে তা খুব স্বাভাবিক। যদিও গ্রামীণ সমাজের কৃষি সাংস্কৃতিক আবহের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির নতুন নতুন কী বিকাশ ঘটল, কে মহাশূন্যে কী করল এগুলো নিয়ে চিন্তিত না, যতক্ষণ না ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবিত হওয়ার অভিজ্ঞতা তাদের অর্জিত না হয়। তারা বরং প্রতিনিয়ত প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহূত প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যস্ত। আর এ প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রুদ্ধশ্বাসে চলার নামই বোধ হয় বর্তমান ‘উন্নয়নের রোল মডেল’। 

মানুষের প্রত্যহিক প্রত্যক্ষ কাজকর্মকে আমলে নেয়ার আগে, একটি কাজ, কর্মকাণ্ড বা ঘটনাকে তার ‘কার্যকারণ’ বা ‘কজালিটি’ দিয়ে বোঝাটা জরুরি। আর এই বোঝাবুঝি তৈরি করতে হলে, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার কিছু ঘটনাকে মোটাদাগে কিছু বর্গীকরণের মাধ্যমে সামাজিক মানসিকতায় কেমন পরিবর্তন আসছে তা দেখতে পারাটা জরুরি। ঘটনাকে বুঝতে চাওয়া বলতে এমন কিছু ঘটনাকে বুঝতে চাই যা সমাজকে নানা দিক থেকে নাড়া দিয়েছে। 

যেমন সাম্প্রতিক সময়ের করোনা মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে, মানুষের যে সচেতনতা, বিনোদন, সামাজিক মেলামেশা ও সচেতনতা ইত্যাদি বিষয়ে সামাজিক মানসিকতায় কীভাবে তাদের করণীয় দানা বাঁধে এবং মানুষ তার প্রাতহিক জীবনে কী চর্চা করে তা নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখতে পাই, মানুষ আসলে বর্তমান ডিজিটাল সময়টাতে দুটো বাস্তবতাকে ধারণ করে। একটা তার রিয়েল বা অবকাঠামোগত বাস্তবতা আর একটা হলো ভার্চুয়াল বাস্তবতা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই দুই বাস্তবতা নির্দিষ্ট কিছু বিন্দুতে এসে মিলে যায় এবং একজন ব্যক্তির নিকট দিন শেষে পরাবাস্তবতার অনুভূতি তৈরি করে অনেক ক্ষেত্রেই (যেমন অনলাইনে গুজবনির্ভর বাস্তব জীবনে সহিংসতা)।

মূলত দিনশেষে একটাই বাস্তবতা মানুষের সামনে আসে তা হলো প্রাত্যহিকতা। এ প্রাত্যহিকতায় মানুষ তার সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবন যাপন করে সামাজিক নানা কাঠামোর সঙ্গে ক্রিয়া করে। এখানে সোস্যাল ফ্যাক্টগুলো যেমন কাজ করছে, ঠিক তেমনি মানুষের জৈবিক বিষয়গুলো জড়িত আছে। ফলে প্রাত্যহিক অভ্যাস ও আচরণগুলোকে প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রণ করে প্রাত্যহিক জীবনের বায়োপলিটিক্স আর ক্ষমতা সম্পর্কের ছাঁচ। তবে বর্তমান সামাজিক ব্যক্তি (সোস্যাল বিং) তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচরণকে দুটি বাস্তবতার (ভার্চুয়াল ও রিয়েল) আলোকে কাঠামো দান করে। আর এমন বাস্তবতাই গ্রামীণ মানুষকে পরাবাস্তবতার সামনে এনে দাঁড় করায়। 

পরিশেষে, গ্রামীণ মানুষের বিনোদন আর মনন বিকাশে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে সেটার দিকে আলোকপাত করেই আজকের আলোচনার যবনিকা টানতে চাই। বিনোদনের জায়গায় যদি দেখা যায় কৃষি সমাজে মৌসুমভিত্তিক যে ধরনের বিনোদন বা সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো প্রচলিত ছিল যেমন বিভিন্ন খেলাধুলা, গান-বাজনা, নাটক, সার্কাস, কীর্তন কিংবা ইসলামী জলসা সবকিছুতেই একধরনের ভাটা পড়েছে কিংবা কিছু জায়গায় নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। যেমন ভার্চুয়াল সময়ে ‘ভাইরাল হুজুর’ (ওয়াজ ভাইরালের মাধ্যমে) কিংবা ভাইরাল স্থানীয় তারকাদের (হিরো আলমের মতো) দেখা মেলে। 

ডিজিটাল প্রযুক্তি বিনোদনকে মোবাইল ফোন ডিভাইসের মাধ্যমে ব্যক্তিক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। অতীতের অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড রয়েছে যেগুলোর পেছনে সামাজিক যৌথ উদ্যোগ ছিল, ছিল সামাজিক সংহতি, সেগুলো এখন সমাজে কমে এসেছে। মানুষের মাঝে গ্রামীণ যে যূথবদ্ধতা তা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার দিকে এগোচ্ছে। আগে পাড়া, মহল্লা, গ্রাম, ইউনিয়নভিত্তিক কিশোর ক্লাব, স্পোর্টিং ক্লাব, থিয়েটার, নাটকের দলসহ নানা ধরনের ক্লাব সংস্কৃতির দেখা মিলত। আজ সেগুলো নানা কারণে নানাভাবে স্তিমিত হয়ে এসেছে। এখন বরং তরুণ যুবকদের মাঝে সাম্প্রদায়িক কট্টরতা বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা যায়। পাশাপাশি দেখা যায় পাবজি, অনলাইন লুডু কিংবা আইপিএল খেলা নিয়ে বাজি ধরার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। 

তবে প্রতিটি পরিবর্তনেই সন্ধিকালীন সময়ে একটা ধাক্কা থাকে এবং সেটাকে সামলে নিয়েই উন্নয়নকে শাণিত করতে হয়। আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষিত থেকে বিশ্লেষণ করতে হয়। ক্ষমতার সম্পর্ক, পুঁজি, দক্ষতা, সক্ষমতা ও সম্ভাবনার আলোকে সমাজের এ পরিবর্তনকে বিশ্লেষণ করা এখন সময়ের প্রশ্ন। আর এর পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টকে মাথায় রেখে নতুন নতুন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নীতি প্রয়োগ জরুরি, সামনের দিনের সোনার বাংলা বিনির্মাণে।


তানভীর শাতিল: উন্নয়ন গবেষক, বিআইজিডি

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন