চিরায়ত গ্রামবাংলা আর কখনো ফিরে পাব না

ড. সেলিম জাহান

রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, ‘গ্রাম ও শহরের মধ্যে সম্পর্ক হইবে অন্দরবাড়ী ও বহির্বাড়ীর মতো। বহির্বাড়ীতে সব বাহিরের কাজকর্ম হইবে, কিন্তু কর্মশেষে আরাম এবং শান্তির জন্যে ফেরত যাইতে হইবে অন্দরবাড়ীতে’। একই রকম ভাবনার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই যখন তিনি গ্রামকে ‘ছায়া-সুবিনিড় শান্তির নীড়’ বলে উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের উক্তিগুলোর মধ্যে গ্রাম এবং গ্রাম ও শহরের মধ্যকার সম্পর্ক বিষয়ে একটি স্বাপ্নিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে সত্যি, কিন্তু এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে গ্রামের চালচিত্র এবং সেই সঙ্গে গ্রাম-শহরের সম্পর্কের একটি মাত্রিকতা সেখানে উপস্থিত।

তবে সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম-শহরের এ সম্পর্ক বদলেছে। সে বদলের অন্যতম কারণ গ্রামীণ সমাজের রূপান্তর—যে রূপান্তরের নানান মাত্রিকতা আছে, যেমন গ্রামীণ সমাজকাঠামোর পরিবর্তন, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মনমানসিকতার বিবর্তন, গ্রামবাংলার সামাজিক সেবার উন্নীতকরণ, গ্রামীণ জনজীবনের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক চালচিত্রের পরিবর্তন ইত্যাদি।

কেমন হয়েছে সে পরিবর্তন—ভালো না মন্দ? কোথায় কোথায় হয়েছে সে বদল? বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে গত পঞ্চাশ বছরের যদি একটি খতিয়ান নেয়া হয়? বলে নেয়া ভালো যে গত পাঁচ দশকে গ্রামবাংলার সামাজিক রূপান্তরের প্রবণতা ও পরিবর্তন বুঝতে হলে তাকে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখা প্রয়োজন। 

সুদূর অতীতে ‘স্ব-নির্ভর গ্রাম’ ছিল বাংলাদেশের গ্রামীণ সামাজিক অবকাঠামোর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সে কাঠামোতে গ্রামের নানান জনগোষ্ঠী নানান কাজ করে পুরো গ্রামের চাহিদা মেটাতেন। যেমন তাঁতি সম্প্রদায় গ্রামের বস্ত্রের চাহিদা মেটাতেন, কুমোররা হাঁড়ি-পাতিলের চাহিদা ইত্যাদি। বিনিময় প্রথার দ্বারা পারস্পরিক চাহিদা মেটানোর মাধ্যমে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক চক্রের দ্বারা ‘স্বনির্ভর’ গ্রামীণ অর্থনীতির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। সামাজিক দিক থেকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী গ্রামের বিভিন্ন পাড়ায় থাকতেন। যেমন কামারপাড়া, জোলাপাড়া ইত্যাদি। 

দারিদ্র্য, অভাব, অসমতা সে কাঠামোতে অবশ্যই ছিল। কিন্তু সব ছাপিয়ে মানুষে মানুষে একটি মানবিক সম্পর্কের কারণে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব ছিল। তাই ধর্মীয় ভিন্নতা থাকলেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পারস্পরিক অংশগ্রহণ ছিল সর্বজনীন। মানুষে মানুষে সম্পর্কই ছিল সামাজিক সুরক্ষার সবচেয়ে বড় বন্ধন। 

এ ‘স্বনির্ভর’ অর্থনীতিতে প্রথম চিড় ধরে অর্থনীতিতে অর্থের অনুপ্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে—সামগ্রী ও সেবার পারস্পরিক বিনিময় প্রথাকে অর্থ দুর্বল করে দেয়। তবে আমাদের দেশের গ্রামীণ সমাজকাঠামোতে একটি বিরাট ধাক্কা আসে তেতাল্লিশের মন্বন্তরে এবং পরে বিশেষ করে সাতচল্লিশের দেশভাগের ফলে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি চুরমার হয়ে যায়, দাঙ্গার ফলে হাজার হাজার মানুষ বাড়িঘর ফেলে গিয়ে উদ্বাস্তু বনে যায় এবং গ্রামীণ অর্থনীতি দুর্বল হয়ে যায়। 

যেহেতু গ্রামেই বেশির ভাগ লোকের বাস, তাই এ দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রচুর অর্থের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে, সেখানে একটি রাজনৈতিক অনুগামী শ্রেণী সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্প্রসারণ ও সুদৃঢ়করণের প্রথম কাজটি করেছিলেন আইয়ুব খান ষাটের দশকে। তার ভৌতিক অবকাঠামো কর্মসূচি, বুনিয়াদি গণতন্ত্র ব্যবস্থা ও ‘উন্নয়নের দশক’—সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই পরিচালিত হয়েছিল। উন্নয়নের নামে এ দেশের গ্রামীণ সমাজের বহু প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ধ্বংস, বহু মূল্যবোধ নষ্ট, বহু দুর্নীতির জন্ম পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খান করেছিলেন। বলা প্রয়োজন, দুই দশক পরে এ কাজগুলো অত্যন্ত সফলভাবে করতে পেরেছিলেন জিয়াউর রহমান।

ষাটের দশকে গ্রামীণ জীবনে একটি তাত্পর্যপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল ‘ট্রানজিস্টর রেডিও’। এর ফলে একদিকে যেমন গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিনোদনের একটি মাধ্যম পেয়ে যায়, অন্যদিকে কৃষি, কুটির শিল্পবিষয়ক নানান শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নানান চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধকে বদলাতে সাহায্য করেছিল। ট্রানজিস্টর রেডিওর ফলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটি সংযোগ তৈরি হয়—গ্রামের মানুষ বিবিসি বা ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠান শোনার একটি সংস্কৃতি তৈরি করে। এর সুফল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লাভ করা গিয়েছিল।

পঞ্চাশ বছর আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল অনন্য। এ ক্ষেত্রে তিনটি ব্যাপার প্রণিধানযোগ্য। এক. শহরের পালিয়ে যাওয়া মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল আমাদের গ্রামগুলো এবং যে যত্ন ও দরদ দিয়ে আমাদের গ্রামবাসী শহুরে মানুষদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিধান করেছিল, তা অবর্ণনীয়। দুই. আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করার ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের অন্যতম আধার ছিল আমাদের গ্রাম ও গ্রামের জনগণ। তিন. পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচার ও নৃশংসতার অন্যতম লক্ষ্য ছিল আমাদের গ্রামগুলো। এখানে উল্লেখ্য যে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে আমার গ্রামীণ জনগোষ্ঠী যেভাবে সম্পৃক্ত ছিল, বাংলাদেশের পরবর্তী গণ-আন্দোলনে কিন্তু সেটা হয়নি। যেমন নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন ছিল নগরকেন্দ্রিক।

মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের গ্রামগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, ভৌতিক অবকাঠামো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন গ্রামবাংলার অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়ায়। সে লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কৃষিতে সমবায় প্রথা প্রচলনের ওপরে জোর দেন, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেন। গ্রামবাংলার পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করে দাতাগোষ্ঠী ও বেসরকারি সংস্থাগুলো। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে এসব সহযোগীর কাজ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে গ্রামীণ জীবনে একটি সামাজিক সেবার অবকাঠামো গড়ে ওঠে, যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে গ্রামীণ উন্নয়নে একটি বিরাট ভূমিকা রাখে।

আশির দশকে গ্রামবাংলার দুটো রূপান্তর গ্রামীণ জনজীবনে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। প্রথমত, গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষের অদক্ষ শ্রমশক্তি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে গমন। এর ফলে তিনটি ব্যাপার ঘটে। এক. গ্রামীণ অর্থনীতিতে কাজ করার বদলে যে করেই হোক মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার একটা হিড়িক পড়ে যায়। দুই. এসব শ্রমিকের পাঠানো অর্থের কারণে গ্রামীণ জনজীবনে একটি বিভাজন গড়ে ওঠে—যেসব পরিবারের কেউ মধ্যপ্রাচ্যে আছেন এবং যেসব পরিবারের কেউই বিদেশে নেই। তিন. এসব কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করেই গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি ব্যাপক ব্যবসা গড়ে ওঠে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে রফতানিযোগ্য নারীনির্ভর পোশাক শিল্পের অভ্যুত্থান ও বিস্তার। এর পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামাঞ্চল থেকে হাজার হাজার নারী শহরে চলে এসে পোশাক শিল্পে নিয়োজিত হলেন এবং অর্থ আয় করতে শুরু করলেন। এর ফলে গ্রামীণ সমাজে তিনটি কাঠামোগত রূপান্তর ঘটল। এক. নারীরা গ্রামীণ আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য চালিকাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। দুই. জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান একটি নতুন মাত্রিকতা ও স্বীকৃতি লাভ করল। তিন. নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের ফলে প্রজনন হারের ওপরে তার একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

আসলে আশির দশক থেকে শুরু করে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে নারীর ক্ষমতায়নে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। তার একটি কারণ অবশ্যই পোশাক শিল্পের বিস্তার ও তাতে নারীর অংশগ্রহণ। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে মূলত নারী-অভিমুখী ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা। সে সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে মুঠোফোনের সূচনার ফলে অজস্র নারী উদ্যোক্তার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। তৃতীয়ত, মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার অভূতপূর্ব বিস্তার। সঙ্গে সঙ্গে নারীরাও অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে যেতে শুরু করেছিলেন। 

আশির দশকের শেষের দিকে গ্রামাঞ্চল রাস্তাঘাটসহ ভৌত অবকাঠামোর প্রচুর উন্নয়নের কারণে গ্রামগুলো শহরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এর ফলে একদিকে যেমন গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি নতুন গতিময়তার সৃষ্টি হয়, তেমনি অন্যদিকে মানুষের চলাচলের পথ সুগম হয়েছিল। গ্রামে নারী শিক্ষার বর্ধনেও উন্নয়ন একটি ভূমিকা রেখেছিল।

নব্বই দশকের শেষের দিকে এসে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বেশক’টি উল্লেখযোগ্য রূপান্তর ঘটে। সরকারি ইতিবাচক নীতিমালার ফলে কৃষি ও খাদ্যলভ্যতার ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন ঘটে, তাতে গ্রামীণ আয়ের ক্ষেত্রে একটি উন্নতি লক্ষ করা যায়। সে সঙ্গে সামাজিক অবকাঠামোয় সঠিক নীতিমালা ও যথাযথ বিনিয়োগের ফলে ধীরে ধীরে সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশের উন্নতি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। ফলে এ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে বাংলাদেশে গ্রামীণ অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যায়। গ্রামীণ দারিদ্র্যের আপাতন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। প্রত্যাশিত গড় আয়ু, শিশু মৃত্যুহার—এমন সব নানান সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশীদের তুলনায় অনেক এগিয়ে গেছে। 

তবে এ রূপান্তরিত পরিবর্তনটি শুধু অর্থনৈতিক খাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বলয়েও প্রবেশ করেছে। মুঠোফোন, আন্তঃযোগাযোগ ও নানান সামাজিক মাধ্যমের অভ্যুদয়ের ফলে আমাদের গ্রামীণ সমাজ আজ শুধু বৃহত্তর দেশজ নয়, বরং বৈশ্বিক সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত। ফলে কতগুলো কাঠামোগত রূপান্তর ঘটেছে আমাদের গ্রামীণ সমাজে।

এক. নগর ও গ্রামের বিভাজনের সীমারেখা অনেক হালকা হয়ে এসেছে। গ্রাম শহরকে ধরে ফেলেছে প্রায়। দুই. গ্রামাঞ্চলের যুবকদের মধ্যে নগরাঞ্চলে চলে যাওয়ার অভিপ্রায় অনেক বেড়েছে। নগর জীবনের আকর্ষণ ও বৃহত্তর অর্থনৈতিক সুযোগ এ অভিপ্রায়ের অন্যতম কারণ। তিন. নতুন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপ্তির কারণে গ্রামে শহুরে, এমনকি বৈশ্বিক সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে চিরায়ত গ্রামীণ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, যেমন যাত্রা, নৌকাবাইচ, হা-ডু-ডু ইত্যাদির প্রচলন কমে এসেছে। বি-ক্যাশের মতো প্রযুক্তির সূচনা ও ব্যবহার গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন গতিময়তা দিয়েছে।

তবে গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের রূপান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে কতগুলো সংকটের কথাও মনে রাখা প্রয়োজন। প্রথমত, নানান ইতিবাচক ব্যবস্থা সত্ত্বেও বাংলাদেশের নীতিমালা নগর-পক্ষপাতদুষ্ট। ফলে বহু ক্ষেত্রেই গ্রামীণ অগ্রাধিকার উপেক্ষিত হয়। গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজের ওপরে তথ্য-উপাত্তের অপ্রতুলতা এ বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের অংশ।

দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ সমাজের বহু মূল্যবোধ ও অনুশাসন, যা কিনা ইতিবাচক রূপান্তরের জন্য প্রয়োজন, তার দিকে দৃষ্টি দেয়া হয় না। ফলে মেয়েদের বাল্যবিবাহের মতো ব্যাপারগুলো চলতেই থাকে। তেমনিভাবে, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা অব্যাহত থাকে। নারীর অর্থনৈতির স্বয়ম্ভরতাও এ চালচিত্র বদলাতে পারেনি। বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ স্বয়ম্ভরতা সহিংসতা বাড়াতে সাহায্য করেছে। 

তৃতীয়ত, গ্রামীণ সমাজে ধর্মীয় শিক্ষা ও ধর্মীয় নেতাদের প্রাধান্যের কারণে মুক্তচিন্তা কিংবা বিজ্ঞানমনস্কতা সেখানে সুদৃঢ় হতে পারেনি। বরং ধর্মীয় গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা এবং নারীর বিরুদ্ধে আক্রমণ বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের বহু ঘটনা ঘটেছে গ্রামে। সুতরাং গ্রামীণ মাদ্রাসা যেমন ধর্মীয় গোঁড়ামিকে আরো সুদৃঢ় করছে, তেমনি সেগুলো থেকে সহিংসতা ও সন্ত্রাসও জন্মলাভ করছে। একটি ইতিবাচক রূপান্তরের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় অন্তরায়।

চতুর্থত, নানান সময়ে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে গ্রামীণ সমাজে উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই বিকেন্দ্রীকরণের নামে সমস্যা বিকেন্দ্রীকৃত করা হয়েছে, কিন্তু সমাধানের কেন্দ্রীকরণ হয়েছে। গ্রামীণ সমাজে পরিবর্তনের গতিময়তা সৃষ্টির জন্য যে ধরনের বিকেন্দ্রীকৃত আর্থিক ও মানবসম্পদের বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা কিন্তু হয়নি।

পঞ্চমত, কভিড-১৯-এর ফলে গ্রামীণ সমাজে নতুন কিছু সংকটের সৃষ্টি হতে পারে। যেমন কভিডের কারণে যদি কৃষিকাজ ব্যাহত হয় তাহলে আগামী বছর গ্রাম ও শহর উভয় অঞ্চলেই খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হতে পারে। তেমনিভাবে কভিডকালে নগরকেন্দ্রিক শিক্ষার্থীরা নব্য তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে, কিন্তু গ্রামের শিক্ষার্থী হয়তো সেটা পারবে না।

শেষের কথা বলি। সময়ের পথ ধরে গ্রামবাংলার সমাজে নানান রকম রূপান্তর ঘটেছে, তার কিছু ইতিবাচক, কিছু ইতিবাচক নয়। গত পাঁচ দশকের জন্যও কথাটি সত্য। চিরায়ত গ্রামবাংলা আমরা কখনো ফিরে পাব না, কিন্তু তার মানে এই নয় যে বর্তমানের বাস্তবতার নিরিখে এবং ভবিষ্যতের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে একটি ভবিষ্যৎ দিগদর্শন নিয়ে নব উদ্যমে আমরা গ্রামবাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলতে পারব না। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার আসন্ন সুবর্ণজয়ন্তীতে সেটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।


ড. সেলিম জাহান: নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন