কর্ণফুলী সেতু সংযোগ প্রকল্প

বছর না গড়াতেই দেবে যাচ্ছে সড়ক

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

সেতু উদ্বোধনের প্রায় নয় বছর পর কাজ শেষ হয় তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুর সংযোগ সড়কের। চলতি বছরের ১২ মার্চ আট কিলোমিটার সড়কটি উদ্বোধন হয়। আর জুনে শেষ হয়েছে ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড (ডিএলপি)। কিন্তু এরই মধ্যে দেবে যাচ্ছে ছয় লেনের (সার্ভিস লেনসহ) সড়কটির বিভিন্ন অংশ। 

চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী সেতু উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার এবং সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত থেকে কর্ণফুলী থানাধীন ত্রিমোহনী পর্যন্ত তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সংযোগ সড়কটি নির্মাণ করে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। প্রকল্পটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল উইহান মিউনিসিপ্যাল কনস্ট্রাকশন গ্রুপ অব চায়না, মীর আকতার হোসাইন লিমিটেড (বাংলাদেশ), সাদেম আল কুয়েত ফর জেনারেল ট্রেডিং ও কনস্ট্রাকটিং কোম্পানি অব কুয়েত।  

প্রকল্পের অধীনে ১৬৪ দশমিক শূন্য ৬ মিটারের ছয় লেনের চারটি সেতু, আটটি কালভার্ট, ৩৪ দশমিক ১২ মিটারের দুটি ওভারপাস, ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট আট কিলোমিটার, মিডিয়ান ও রোড ডিভাইডার আট কিলোমিটার, ফুটপাত ও ড্রেন ১১ কিলোমিটার, রক্ষাপদ কাজ আট হাজার বর্গমিটার, আট কিলোমিটার রোড মার্কিং ছাড়াও আট কিলোমিটার সাইন সিগন্যাল অ্যান্ড কিলোমিটার পোস্ট বসানোর কথা ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু পেভমেন্টসহ মাটি ভরাটের বিভিন্ন কাজে পর্যাপ্ত সময় না দেয়ায় সড়কটির বিভিন্ন অংশ দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। 

চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জুলফিকার আহমেদ সড়কটি দেবে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সড়কটির নির্মাণকাজ শেষে জানুয়ারিতে সওজকে বুঝিয়ে দেয় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এত দ্রুত সময়ে সড়কটির বিভিন্ন অংশ দেবে যাওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। এর পরও কোথাও কোনো সমস্যা হলে সওজ সেটি ঠিক করে দেবে। তাছাড়া সড়কে উচ্চতাপ পড়লে ভারী যানবাহনের চাপে অনেক সময় বিটুমিনের আস্তরণ কোথাও কোথাও সরে যায়।’ এটা বড় কোনো সমস্যা নয় বলে দাবি করেন তিনি। 

সরেজমিন কর্ণফুলী সেতু সংযোগ সড়কে গিয়ে দেখা যায়, বহদ্দারহাট থেকে সেতু পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন অংশ, সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত থেকে মইজ্জারটেকসহ কলেজ বাজার এলাকার বিভিন্ন অংশের সড়কে মধ্যবর্তী ও পাশের অংশ দেবে গেছে। সড়কের বিভিন্ন অংশ দেবে যাওয়ার কারণে সড়কটির ওপর দেয়া লেন মার্কিংও বাঁকা হয়ে গেছে। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন, কয়েক মাস আগেও সড়কটির দেবে যাওয়ার পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। সওজ কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলোর ওপর নতুন করে কংক্রিট ও বিটুমিনের আস্তরণ দিয়ে মেরামত করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সড়কটির অন্যান্য অংশও একইভাবে দেবে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা। 

এ বিষয়ে কর্ণফুলী সেতু প্রকল্পের সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বণিক বার্তাকে বলেন, নির্মাণকাজ চলাকালীন অর্থাৎ ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগকে প্রকল্পটি বুঝিয়ে দেয়া হয়। নির্মাণকাজ চলমান অবস্থায় সড়কে যান চলাচল শুরু হওয়ায় ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ডিএলপি শর্ত শেষ হয়ে গেছে। ফলে উদ্বোধনের পর সড়কটির বিভিন্ন ত্রুটি নির্ধারণ ও মেরামতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বাধ্যবাধকতার মেয়াদ ছিল মাত্র চার মাসেরও কম। ফলে সড়কটিতে এখন কোনো সমস্যা হলে সড়ক বিভাগ নিজস্ব অর্থায়নে মেরামত করবে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কোনো দায় নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। 

সওজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৬ মার্চ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান করা হলেও ভূমি অধিগ্রহণসহ একাধিক জটিলতায় কাজ শুরু করতে কয়েক মাস বিলম্ব হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২৭১ কোটি ১১ লাখ ৬৫ হাজার ১২২ টাকায় চুক্তি হলেও চলতি বছরের জুনে সংশোধিত পূর্ত কাজের সংশোধিত চুক্তিমূল্য ২৬৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকায় পুনর্নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হয়েছে ৩৯৬ কোটি ৪২ লাখ ৩১ হাজার টাকা। এর মধ্যে কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (কেএফএইডি) ২৮৬ কোটি ৮০ লাখ ৯৯ হাজার এবং বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে ১০৯ কোটি ৬১ লাখ ৩২ হাজার টাকা। ২ দশমিক ৪২৬ একর ভূমি ও অবকাঠামো বাবদ ব্যয় হয়েছে ৯৩ দশমিক ৩৫ কোটি টাকা। 

কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত সেতুটি উদ্বোধনের পর অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ নিয়ে সওজ ও দাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে মতানৈক্য শুরু হলে দীর্ঘদিন আটতে থাকে প্রকল্পের সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ। প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় আগে প্রকল্প শুরু হলেও সংযোগ সড়ক না থাকায় সেতুটির প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে স্থানীয়রা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে যাতায়াতের প্রধান এ সড়কটিতে যানজট লেগে থাকায় নির্ধারিত সময়ের প্রায় ১ ঘণ্টা বেশি সময় ব্যয় করতে হতো যানবাহনগুলোকে। প্রকল্পের অধীনে সেতু নির্মাণের পর ৪ দশমিক ৫০ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার উদ্বৃত্ত থেকে যাওয়ার পর ওই অর্থ দিয়ে নতুন প্রকল্প হিসেবে সংযোগ সড়ককে বর্ধিত করে উভয় পাশে আট কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের লক্ষ্যে ২০১২ সালের ১৬ জুন দাতা সংস্থার সঙ্গে সংশোধিত ঋণচুক্তি সম্পন্ন হয়। কিন্তু কর্ণফুলী সেতু থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত সংযোগ সড়কের জন্য নেয়া সরকারি ১৫৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান থাকায় সংযোগ সড়কের প্রকল্পটি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে সরকারি প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে বিলম্ব হলে সড়কটির রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ বন্ধ থাকে দীর্ঘদিন। এরপর দাতা সংস্থার উদ্বৃত্ত অর্থেই সংযোগ সড়কের কাজ শুরু করতে উভয় দেশ সম্মত হয়। 

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত শাহ আমানত সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬৫১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেয় ২৯১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। কিন্তু সেতু নির্মাণে সরকারি অর্থ ব্যয় হলেও কুয়েত ফান্ডের ২২০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থেকে যায়। শুরুতে উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে সেতুর দক্ষিণ অংশে চারলেনের ১২ কিলোমিটার সড়ক সম্প্রসারণের প্রস্তাব দেয়া হলেও তা গ্রহণ করেনি দাতা সংস্থা। পরবর্তী সময়ে নতুন ঋণচুক্তির মাধ্যমে সেতুর উভয় পাশে মোট আট কিলোমিটার সড়ক সম্প্রসারণের কাজ শুরু করে কর্ণফুলী তৃতীয় সেতু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। 

জানতে চাইলে সওজ চট্টগ্রাম বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেকোনো নতুন সড়ক নির্মাণ শেষে কিছু সমস্যা হতেই পারে। সড়কে যানবাহন চলাচলের এক্সেল লোডের নিয়ম পরিপালন না হওয়ায় এ ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ হলে ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডকালীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উদ্ভূত ত্রুটি সংশোধন করেছে।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন