অভিমত

কভিডে পথশিশুদের অবস্থা ও করণীয়

মোহাম্মদ আফতাবুজ্জামান

দরিদ্রতা, বহুবিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, বাল্যবিবাহ, নদীভাঙন, মারাত্মক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত মা-বাবা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মাদকাসক্ত কিংবা মা-বাবা সংসার চালাতে অক্ষম, গ্রাম থেকে শহরমুখী অভিগমনসহ নানা কারণে ঢাকা শহরে দিন দিন পথশিশু তথা সুবিধাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। ইউনিসেফের তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪ জন পথশিশু রয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) হিসাব মতে, শুধু ঢাকা শহরে প্রায় লাখ ৫০ হাজার পথশিশু রয়েছে। যদিও অনেক প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন তথ্য প্রদান করে, তবে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আমরা দেখি যে পথশিশুদের সংখ্যা এখনো নেহাত কম নয়। বিপুলসংখ্যক শিশু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টিসহ নানা মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

পথশিশুরা নানা রকম সমস্যা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বড় হয়। তারা সব মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তারা মা-বাবার স্নেহদাদা-দাদির আদর, ভাই-বোনের সোহাগ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের পথের জীবন অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকরনিরাপত্তাহীন। তাদের অধিকাংশ অপুষ্টির শিকার, পথে তারা শারীরিক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারাও কখনো কখনো নির্যাতিত হয়। মোট কথা, তাদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা পদে পদে হয় বিঘ্নিত। এসব কারণে তারা নানা অসামাজিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। পরবর্তী সময়ে দেশ সমাজের জন্য এরা বোঝা হয়ে বেড়ে ওঠে।

এছাড়া যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পথশিশুদের দুর্ভোগ বহুগুণ বেড়ে যায় এবং তাদের ওই পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। বর্তমান করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর পথশিশুদের পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে গত মার্চ প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে এবং অক্টোবর পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ৬৪ হাজার ৯৮৭ জন এবং করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা হাজার ২৭২ জন (তথ্যসূত্র: বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা) করোনা বিস্তার রোধে বাংলাদেশ সরকার ২৫ মার্চ থেকে সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে এবং যাবতীয় যানবাহন, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষণা করে। লকডাউন চালু হওয়ার পর পরই পথশিশুদের মুখোমুখি হতে হয় এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা, করোনা প্রকোপ শুরু হওয়ার পর পথশিশুদের অবস্থা হয়েছে ঠিক এমনই। পথশিশুদের অবস্থা সবসসময়ই নাজুক ছিল, কিন্তু করোনা প্রকোপ শুরু হওয়ার পর তাদের অবস্থা আরো দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। আমরা যারা ঢাকা শহরে পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করি, আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে ঢাকা শহরে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে একা একা থাকে যে পথশিশুরা, তারা। এই শ্রেণীর পথশিশুরা যেসব কাজ করে সেগুলো হলো ভাঙ্গারি কুড়ানো, ভিক্ষা করা, কুলির কাজ, আশপাশের কোনো রেস্টুরেন্টে বয়ের কাজ। লকডাউন শুরু হওয়ার পর পথশিশুরা খাদ্য সংকটে পড়ে। তাদের হাতে কোনো কাজ না থাকায় তারা খাবার কিনে খেতেও পারে না। পর্যাপ্ত শেল্টারের অভাবে তাদের খোলা আকাশে, রেলস্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে নদীবন্দর এলাকায় অনিরাপদ অবস্থায় রাত্রি যাপন করতে দেখা যায়।  এছাড়া করোনা সম্পর্কে তাদের ধারণা অপ্রতুল এবং বেশ অসচেতন। তারা স্বাস্থ্যবিধি মানে না, নিয়মিত মাস্ক পরতে চায় না। তাই তারা সবসময় করোনা সংক্রমণ ঝুঁকিতে থাকে।

রেলস্টেশন বাসস্যান্ড বন্ধ থাকায় তারা কুলির কাজ করতে পারে না, রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় তারা রেস্টুরেন্টে বয়ের কাজও পায় না, যারা ভাঙ্গারি কুড়ানোর কাজ করত, তাদের কাজও বন্ধ। ঢাকা শহরের পথশিশুদের জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান খাবার বিতরণ করলেও প্রতিদিন তিনবেলা খাবার খাওয়া কোনো পথশিশুর জন্যই সম্ভব ছিল না। ঢাকা শহরের পথশিশুদের নিয়ে যারা কাজ করে, তারা যে ধরনের শেল্টার পরিচালনা করে, তা হলো ড্রপইন শেল্টার, নাইট শেল্টার ট্রানজিশনাল শেল্টার। করোনা প্রকোপ শুরুর পর যখন ২৫ মার্চ থেকে লকডাউন ঘোষণা হলো, তখন সব শেল্টার নতুন শিশুদের শেল্টারে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ফলে শেল্টারে যেসব শিশু আগে থেকেই ছিল, তারা নিরাপদ ছিল, কিন্তু যেসব শিশু শেল্টারের বাইরে ছিল, তারা ঝুঁকির মুখে পড়ে। তাদের না ছিল খাবার, না ছিল আশ্রয়।

উদ্বেগজনক বিষয় হলো, কাজ হারানোর ফলে অনেক দরিদ্র পরিবার ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে অথবা অন্য কোনো কাজ করে কোনো রকম বেঁচে আছে। এই শ্রেণীর পরিবারের শিশুরা পথশিশু হওয়ার ঝুঁকিতে আছে, কেননা আমাদের কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে শিশুদের পথে আসার একটা অন্যতম কারণ হলো দারিদ্র্য। আর করোনার প্রকোপে দরিদ্র মানুষ আরো দরিদ্র হয়েছে। সরকারি সংস্থা বিআইডিএস বলছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশে নতুন করে কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হবে। আর এর প্রত্যক্ষ পরোক্ষ প্রভাবে সুবিধাবঞ্চিত শিশু তথা পথশিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ করোনার ফলে দেশে বিশেষ করে শহর এলাকায় পথশিশুদের সংখ্যা বাড়বে, এটা সহজেই অনুমান করা যায়। তাই করোনার প্রকোপ থেকে পথশিশুদের রক্ষা করার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে, শুধু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পথশিশুদের করোনার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।

আপন ফাউন্ডেশন ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে এয়ারপোর্ট এলাকার নিকটস্থ কাওলা এলাকায় ঠিকানাহীন পথশিশুদের জন্য একটি শেল্টার পরিচালনা করছে। বাড়ি থেকে শহরে চলে আসা শিশুদের উদ্ধার করে আশ্রয় দেয়া হয় এবং তাদের পরিবার খুঁজে তাদের পরিবারে হস্তান্তর করা হয়। কোনো কারণে কোনো শিশুর পরিবার খুঁজে পাওয়া না গেলে তাকে সরকারি বা বেসরকারি  স্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়। -যাবৎ আমরা রাস্তা থেকে ৮৩৮ শিশুকে উদ্ধার করে ৩৩৮ জনকে তাদের পরিবারে হস্তান্তর করেছি। ৬৭ জনকে স্থায়ী সেবা আশ্রয়ের জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রেফার করেছি।

পথশিশুর সংখ্যার তারতম্য যা- হোক না কেন বিশাল জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোত উন্নয়নের মূলধারার বাইরে রেখে দেশের সামগ্রিক টেকসই উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়। আর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলেও তাদের পেছনে ফেলে সম্ভব নয়। এজন্য দরকার সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ। পথশিশুদের বাস্তব অবস্থাকে উপলব্ধি করে তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালে ঘোষণা করেন:

আমাদের শিশুরা কেন রাস্তায় ঘুমাবে? একটা শিশুও রাস্তায় ঘুমাবে না। একটা শিশুও এভাবে মানবেতর জীবনযাপন করবে না।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যেহেতু করোনা পরিস্থিতি এখনো শেষ হয়ে যায়নি এবং পথশিশুরা ঝুঁকিতে আছে, সেহেতু পথশিশুদের সুরক্ষায় আমাদের সম্মিলিত কিছু উদ্যোগ নেয়া সময়ের দাবিযা নিম্নে সুপারিশমালা আকারে পেশ করা হলো:

* নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত এবং অসহায় শিশুদের জন্য সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।

* পথশিশুদের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ দেয়া দরকার।

* শিশুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয় ত্বরান্বিতকরণ।

* সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তাত্ক্ষণিকভাবে পথশিশুদের সাময়িক অবস্থান খাদ্য সরবরাহের যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, তা ক্রমান্ব্বয়ে নিয়মিত প্রোগ্রামে রূপান্তরের প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে।

* ঢাকা শহরের পথশিশুদের নিরাপত্তার জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে জরুরি ভিত্তিতে পর্যাপ্ত শেল্টার হোমের ব্যবস্থা করতে হবে।

* দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিশু একক বা পরিবারের সঙ্গে জীবিকার সন্ধানে প্রতিনিয়ত ঢাকা শহরে চলে আসে। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কভিড-১৯, নদীভাঙন অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অসহায় অবস্থা শনাক্তকরণের লক্ষ্যে একটি ব্যাপক জরিপ-সমীক্ষা পরিচালনা করতে হবে।

* সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ এবং চলমান কর্মসূচির আলোকে একটি সমন্বিত প্লাটফর্ম গঠন করা জরুরি (ইন্টিগ্রেটেড অ্যাপ্রোচ)

* পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত অসহায় শিশুদের জন্য পরিচালিত বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করা।

* পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত অসহায় শিশু যাতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ, শারীরিক, যৌন, মাদকাসক্ত, হয়রানি পাচারের শিকার না হয়, সে বিষয়ে সবার সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং লক্ষ্যে সরকারি বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে দেশব্যাপী কার্যক্রম হাতে নেয়া।

* পথে অবস্থানকারী শিশুরা যাতে তাদের মা-বাবা, অভিভাবক বা পরিবারে ফিরে যেতে পারে, সে ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা।

পরিশেষে বলতে চাই, পথশিশুদের জন্য পথের চেয়ে পরিবারই একমাত্র নিরাপদ স্থান। তাদের পরিবারেই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ঘোষিত বাস্তবায়িত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে প্রান্তিক গরিব পরিরবারের সেবা সুবিধা পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। আমরা পথশিশুমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই। কাজটি অত্যন্ত দুরূহ। কিন্তু দুরূহ কাজটি সরকারি, বেসরকারি, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ব্যক্তি সবাই মিলে একযোগে করলে অত্যন্ত সহজ হবে। তাই প্রত্যাশা করি, কভিড-১৯ অতিমারী দ্রুত কেটে যাক আর আলোয় আলোয় ভরে উঠুক শিশুবান্ধব সোনার বাংলা, যেখানে প্রতিটি শিশু ফিরে পাবে তার মৌলিক অধিকার।

 

মোহাম্মদ আফতাবুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক

আপন ফাউন্ডেশন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন