স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর নির্দেশনা

টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা জরুরি

বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা একটি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে চলছে। এখানে আইন কাঠামো, সংগঠন, অর্থায়ন, কর্মবণ্টন, পরিকল্পনা, জনবল, রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা, প্রশাসনিক দক্ষতা, প্রযুক্তিগত পশ্চাত্পদতা, দৃষ্টিভঙ্গির অনুদারতাবহু সমস্যা বিদ্যমান। এগুলো থেকে উত্তরণের জন্য পুরো ব্যবস্থায় প্রয়োজন আমূল সংস্কার। প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টিতে গুরুত্ব অনুধাবনপূর্বক বলেছেন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। জেলা, উপজেলা ইউনিয়ন তিন স্তরে জনপ্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সাংবিধানিক। ভারসাম্যপূর্ণভাবে তিন স্তরে স্থানীয় সরকার শাসন ব্যবস্থা কার্যকরের কোনো বিকল্প নেই। এগুলো ভারসাম্যপূর্ণভাবে চালু হলে কেউই ক্ষমতা হারাবে না। এখানে হার-জিতের প্রশ্ন বড় নয়। দেশের নাগরিক হিসেবে সবার জিত হবে। এখানে সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা পরিষদ সবারই ক্ষমতা বাড়বে। একজন কর্মকর্তা শুধু কর্মকর্তা হিসেবে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করেন। জনপ্রতিনিধির সঙ্গে মিলে কাজ করলে তিনি তার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারবেন। সরকার কী, সরকার কীভাবে গঠিত হয়, সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে কোন বিভাগের কী ক্ষমতা দায়িত্ব, সরকারের রাজস্ব আয়ের উৎস কী কী, সাংবিধানিক, প্রশাসনিক বিচারিক বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, ক্ষমতার পৃথকীকরণ ইত্যাদি বিষয় তৃণমূলের ইউনিটে দৃশ্যমান না থাকায় মানুষের কাছে সরকার একটি অস্পষ্ট দূরবর্তী বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে। সেজন্য জাতীয় স্থানীয় উন্নয়নের স্বার্থেই কেন্দ্রীয় সরকারের মতো স্থানীয় ইউনিটগুলোয়ও স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সংসদ স্থানীয় আদালতসংবলিত সরকার ব্যবস্থা স্থাপন করা বাঞ্ছনীয়।

এক্ষেত্রে ভারতের কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যের অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ কেরালা উভয় রাজ্যেই সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই সংগঠনের প্রধান বা সভাপতি নির্বাচিত হন। তাই ভারতজুড়ে পঞ্চায়েত বা পুরসভা নির্বাচন মানেই সদস্য বা কাউন্সিলর নির্বাচন এবং সে নির্বাচনগুলো সবসময় দলভিত্তিক মনোনয়নের মাধ্যমেই হয়। কলকাতা সিটি করপোরেশনে কাউন্সিলরদের পরোক্ষ ভোটেই ১৪০ কাউন্সিলরের একজন মেয়র বা করপোরেশনের নির্বাহী কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। পশ্চিমবঙ্গের বিধায়করা, যথা বিধানসভা, লোকসভা রাজ্যসভার প্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকায় পঞ্চায়েত সমিতি জেলা পরিষদের পদাধিকারবলে সদস্য হিসেবে গণ্য হন এবং সদস্য হিসেবেই তারা পরিষদের কার্যে অংশগ্রহণ করেন। তারা নিয়ন্ত্রক বা নির্বাহী হিসেবে কোনো কাজ করতে পারেন না। জেলা পর্যায়ে কর্মরত সরকারি কর্মচারী বিভাগগুলো কর্মক্ষেত্রে তাদের স্বাতন্ত্র্য যেমন বজায় রাখেন, তেমনি আবার প্রতিটি পর্যায়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গেও পরিকল্পনা গ্রহণ বাস্তবায়নে অংশ নিয়ে থাকেন।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে আমরা অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন বর্তমানে আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। এজন্য এসডিজির স্থানীয়করণ তথা স্থানীয় নেতৃত্ব, স্থানীয় উদ্যোগ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতায়ন আবশ্যক। এজন্যও প্রয়োজন হবে একটি বিকেন্দ্রীকৃত প্রয়োজনীয় সম্পদপ্রাপ্ত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। দারিদ্র্য নির্মূল আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার এবং লক্ষ্যে এরই মধ্যে অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তবে এতে পরিপূর্ণ সফলতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন হবে একটি কার্যকর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। একমাত্র বিকেন্দ্রীকৃত রাষ্ট্র ব্যবস্থাই দারিদ্র্য দূরীকরণের কর্মসূচি দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়ন তাতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে এবং এটা করার জন্য দক্ষ প্রতিনিধিত্বশীল একটি স্থানীয় সরকার কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আমাদের সাংবিধানিক আকাঙ্ক্ষার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হলে একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে, যাতে অধিক ক্ষমতা, জনবল সম্পদ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর করা যায়। আরো নিশ্চিত করতে হবে এগুলোর সত্যিকারের স্বায়ত্ত শাসন। তাহলেই উন্নয়ন ঊর্ধ্বমুখী হবে এবং আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কোনো সরকারই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি; কেবল প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায় সারতে চেয়েছে। সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, প্রতিশ্রুতি পূরণ করে স্থানীয় সরকারকে সবল সক্ষম করে তোলা। সময়ের প্রয়োজন মেটাতে আধুনিক বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেভাবে কার্যকর স্থানীয় সরকার গড়ে তুলেছে, সেসব নমুনা দেখে দেশের স্থানীয় সরকার ঢেলে সাজিয়ে জনবান্ধব কাঠামো দাঁড় করানো সবার দাবি। এজন্য প্রথমেই ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। স্থানীয় সরকারের হাতে তৃণমূলসংশ্লিষ্ট সেবা খাতগুলো ছেড়ে দিতে হবে। এসব কাজ বাস্তবায়নে যে অর্থ প্রয়োজন, তা বরাদ্দ দিতে হবে এবং সময়মতো সরবরাহ করতে হবে। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। জটিলতামুক্ত আর্থিক ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে কাজের গতি বাড়াতে।

গ্রামীণ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জন্য একটি সমন্বিত আইন প্রয়োজন। লক্ষ্যে শওকত আলীর নেতৃত্বে ২০০৭ সালে গঠিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গতিশীল শক্তিশালীকরণ কমিটি এমন একটি সমন্ব্বিত আইনের সুপারিশ করেছিল। সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি; সেটি এখনো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। আইনের সংস্কার আরো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেক স্থানীয় সরকার আইন অত্যন্ত পশ্চাত্পদ এবং এগুলোর আধুনিকায়ন জরুরি। আমরা আশা করি, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে সরকার একটি কমিটি/কমিশন গঠন করবে। কমিটি/কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেবে এবং পুরো ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস করবে। টেকসই উন্নয়ন এবং এর সুফল শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতায়নের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সংবিধানে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠনের কথা বলা আছে। বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা খুবই সীমিত। প্রবৃদ্ধির হার দারিদ্র্য দূরীকরণের সাফল্য ধরে রাখতে হলে সরকার প্রশাসনের কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন দরকার। স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী গণতান্ত্রিক করতে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন