সক্রিয় হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগরভিত্তিক মানব পাচারকারী চক্র

মানব পাচার বন্ধে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা হোক

কভিড মহামারীর মধ্যেও মানব পাচারকারীদের অপতৎপরতা থেমে নেই। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর বঙ্গোপসাগরের উপকূল দিয়ে এক হাজারের বেশি মানুষ মানব পাচারের শিকার হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু জুনেই ৬৬৯ জনের পাচার হওয়ার হিসাব পাওয়া গেছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) তথ্যে। ২০২০ সালের বৈশ্বিক মানব পাচার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপগুলোর কারণে গত বছর মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে, তার মধ্যে সাতটি মানব পাচার ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং বিদেশে কাজের জন্য গমনেচ্ছু বাংলাদেশীদের শোষণকারী নিয়োগ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ অন্যতম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এসে মানব পাচার বন্ধে কিছুটা শিথিলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাছাড়া কভিডের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণীর দালাল আদম ব্যবসায়ী মানব পাচারে সক্রিয় হয়ে উঠছে। মানব পাচার বৃদ্ধির পেছনে বিচারহীনতা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাও বড় কারণ। এক্ষেত্রে দ্রুতই সাতটি মানব পাচার ট্রাইব্যুনালকে মানব পাচার আইন, ২০১২ অনুসারে দায়েরকৃত মামলা পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান এবং জাতিসংঘের মানব পাচার প্রটোকল ২০০০-এর নির্দেশনা অনুযায়ী পাচারকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। যতক্ষণ না অপরাধীদের বিরুদ্ধে জোরালো আইনি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে ততক্ষণ পাচার একটি কম ঝুঁকির উচ্চলাভের কাজ হিসেবেই বিদ্যমান থাকবে। অবশ্যই এর পরিবর্তন দরকার। মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের কার্যক্রমগুলোকে ভুক্তভোগী-সহায়ক করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে নারী-পুরুষ বা তরুণ-বয়স্ক সব ভুক্তভোগী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা পায়। এর অর্থ হলো, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দাতাগোষ্ঠীর ব্যাপক প্রচেষ্টার সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে ভুক্তভোগীদের সেবা জোরদার করার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে ভুক্তভোগীদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, চিকিত্সা এবং মানসিক, সামাজিক, আইনি পুনর্বাসন সেবাও নিশ্চিত করতে হবে।

নিরাপদ মাধ্যমে বিদেশে কাজের জন্য গমনেচ্ছু ব্যক্তিদের সুরক্ষায় কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। এর মধ্যে থাকবে নিয়োগের জন্য আন্তঃসরকারি সমঝোতার মাধ্যমে ধার্য করা দাপ্তরিক ফি বাড়িয়ে নেয়া নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রযোজ্য আইনের প্রয়োগ অব্যাহত রাখা এবং এসব ফি কর্মীদের থেকে আদায় বন্ধ করে সেই ব্যয়ভার নিয়োগকারীদের ওপর বর্তানোর জন্য কাজ করা। যখন কোনো ব্যক্তি নিয়োগ ফি পরিশোধের জন্য ঋণ নেন, তখন তিনি শোষণের এক ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়েন। কর্মীদের শুরু থেকেই অসুবিধার মধ্যে ফেলা এই শুভঙ্করের ফাঁকির হিসাবের সম্পূর্ণ পরিবর্তন দরকার। নিরাপদ অভিবাসনের জন্য সহজ পথ তৈরি করতে নিয়োগকারীদের অবশ্যই আরো বেশি প্রচেষ্টা নিতে হবে। লিবিয়ায় ২৬ জন বাংলাদেশীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর তদন্তসাপেক্ষে সন্দেহভাজন পাচারকারীদের গ্রেফতারে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপের জন্য আমরা উত্সাহিত বোধ করেছি। আমরা আশা করি, এসব পদক্ষেপ প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় রূপ নেবে এবং যাতে আর কখনো এমন বিয়োগান্তক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করবে। দেশীয় দালাল চক্র এবং তাদের প্রশ্রয়দানকারী সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলে কেবল মানব পাচার বন্ধ হবে। এই যে দালাল চক্র এবং তাদের প্রশ্রয়দানকারী, যারা রাজনৈতিক ক্ষমতার থেকে এসব অবৈধ কাজ চালিয়ে যেতে পারে, এদের প্রতিহত করতে হবে। এরই মধ্যে এক সংসদ সদস্য বিদেশে অর্থ মানব পাচারের জন্য গ্রেফতার হয়েছেন। উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিকরা যদি এমন কাজে লিপ্ত থাকেন, তাদের চিহ্নিত বিচার করা জরুরি। দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে মানব পাচারবিরোধী কমিটি রয়েছে। একে কার্যকর করে তোলা জরুরি।

দেশের সাধারণ দরিদ্র মানুষ তাদের দরিদ্রতার জন্যই অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমায়। একথা অনস্বীকার্য যে মানুষের প্রকৃত অর্থনৈতিক জীবনমানের উন্নয়ন না হলে এটি থামানো যাবে না। যেহেতু বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে, এজন্যই এটি বন্ধে সরকারকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি উদ্যোগে সরকারি প্রতিষ্ঠান এনজিওগুলোর সহায়তায় বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। সহস াব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) পূরণে আমরা যদি শিশু মাতৃমৃত্যুহারের মতো একসময়ের কঠিন সমস্যা দূর করতে পারি, তাহলে সদিচ্ছা থাকলে এটিও করা যাবে নিঃসন্দেহেই। বৈধ পথে সরকার অনুমোদিত দেশগুলোয় শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য সহানুভূতিশীল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মানব পাচারকারী দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে, অন্যদিকে সরকারি সহায়তায় গ্রামীণ অঞ্চলের প্রান্তিক দরিদ্র মানুষদের আত্মনির্ভরশীল করতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার স্বল্প বিনা সুদে ক্ষুদ্র দীর্ঘমেয়াদি ঋণসহায়তা দিয়ে সাধারণ মানুষকে কর্মমুখী করে তুলতে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশের মানব পাচারের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়েই সাত বছর আগে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান করা হয়েছিল। অথচ বিচারকের স্বল্পতা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকার কারণেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা সম্ভব হয়নি। বিচারহীনতা রোধে হাইকোর্টের নিবিড় তদারকি দরকার। নারী শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালকে মানব পাচার মামলা নিষ্পত্তির এখতিয়ার দেয়া হলেও ট্রাইব্যুনালগুলোকে অনেক সময় সব ধরনের মামলা নিষ্পত্তিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এর অবসান দরকার। আজকাল ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই পাচারকারী তার অবস্থান শনাক্ত করা যায়। সামান্য মুঠোফোনের কল আর বিকাশের ট্রান্সফার ট্র্যাক করেই এসব করা সম্ভব এবং সে প্রযুক্তি স্থানীয় পুলিশের কাছে রয়েছে। আর সরকার যদি মোবাইল অপারেটর মোবাইল মানি ট্রান্সফারিং কোম্পানিগুলোকে বিগ ডাটা থেকে তথ্য দিতে বাধ্য করে তাহলে তো আর সমস্যাই নেই।

সবই কঠিন কাজ এবং কভিড-১৯-এর এই বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে লড়াই আরো বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। পাচারকারীরা মহামারীসৃষ্ট বিশৃঙ্খল অবস্থাকে পুঁজি করছে। অপরাধের জন্য তাদেরকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ বৈধ অভিবাসনের মাধ্যমে অর্জিত রেমিট্যান্স দিয়েই অর্থনীতির মজবুত ভিত্তি গড়তে সক্ষম হয়েছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের ভালো ভাবমূর্তি রয়েছে। জাতীয় স্বার্থেই অভিবাসনের নামে মানব পাচার রুখতে হবে। এক্ষেত্রে কালক্ষেপণ না করে যত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যায় ততই মঙ্গল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একসঙ্গে গুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে সুফল আসবে বৈকি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন