ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণ বিতরণ ও ব্যবসায়ী সংগঠনের ভূমিকা

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

ক্ষুদ্র ও মাঝারি  ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ- একথা নিঃসেন্দহে বলা যায়। এই দেশের প্রায় নব্বই শতাংশ উদ্যোক্তা এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। বাকি দশ শতাংশ হলো কর্পোরেট বা বড় মানের উদ্যোক্তা। বিশাল এই অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর সিংহভাগই ব্যাংকিং তথা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে অনেক দূরে । এই উদ্যোক্তা শ্রেণী হয় নিজের ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করছেন নয়তো দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কোন রকম ভাবে নিজের ব্যবসাকে চালিয়ে নিচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে, দু’একজন হয়তো টিকে থাকেন, বাকিরা সবাই পুঁজির সংকটে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন, নয়তো পরিবর্তন করছেন। এই শুধু টিকে থাকার সংগ্রামকে আর যাই হোক ব্যবসা বলা যাবে না।

পুঁজি ছাড়া ব্যবসা চিন্তাও করা যায় না । আর এই পুঁজির যোগান বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। নিজের পকেটের অর্থ, ব্যাংক ঋণ এবং শেয়ার বিক্রি ও বন্ড বিক্রি তার মধ্যে অন্যতম । কিন্তু বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের জন্য নিজের পকেট থেকে দেয়া পুঁজিই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবসা পরিচালনার মূল অবলম্বন। আর ব্যাংক ঋণ হলো বাংলাদেশের এখনো পর্যন্ত একমাত্র পারিবারিক পুঁজির বাইরের উৎস।  বাংলাদেশের পুঁজি বাজারে এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পুঁজি সংগ্রহের সুযোগ একেবারেই সীমিত, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাই বললেই চলে। অতএব পর্যাপ্ত পুঁজির অভাবে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক গতি ত্বরান্বিত হচ্ছে না, অপরদিকে ব্যাংক তার বিশাল বিনিয়োগকে কর্পোরেট নামক গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানে এককেন্দ্রিক পুঞ্জীভূতকরণের মাধ্যমে বহুপাক্ষিক লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছে। আজকের যে বিশাল অংকের অলস ঋণ ব্যাংক লালন পালন করছে তার সিংহভাগই এই কর্পোরেট সেক্টরের। কিন্তু অপরদিকে নব্বই শতাংশ অর্থনীতির ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা পুঁজির অভাবে না পারছে টিকে থাকতে না পারছে ব্যবসা করতে। 

অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মূল পুঁজি প্রবাহ তথ্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে সংযোগ করা আজ সময়ের দাবি । ব্যাংক ঋণ প্রদান প্রক্রিয়া  এবং এর সহজলভ্য প্রাপ্তিতে কী করণীয় সে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। ব্যাংকের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে বড় ঋণগ্রহীতাদের বড় ঋণ দেয়া এবং বেশি আয় করা। তাই দেখা যাচ্ছে ব্যাংকের ঋণতালিকার ৭০ শতাংশ হলো কর্পোরেট ঋণ বা বড় বিনিয়োগ আর বাকি সব হচ্ছে ক্ষুদ্র ও কুটির, মাঝারি, কৃষি ইত্যাদি। এই বিশাল ব্যবধানের মূল কারণ হলো ব্যাংক ঋণ প্রদান প্রক্রিয়া। একজন ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের উদ্যোক্তার ঋণ প্রাপ্তিতে ব্যাংক মূলত নির্ভর করে উদ্যোক্তার বিক্রির উপর। দৈনিক বা মাসিক কি পরিমাণ বিক্রি হয়, এই বিক্রিত টাকার প্রমাণ স্বরূপ ব্যাংক তার সঙ্গে বা অন্য কোন ব্যাংকে পরিচালিত হিসাবকে বিবেচনা করে। সে লেনদেনের উপর নির্ভর করে ব্যাংক ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিট আয় হিসাব করে ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা নির্ধারণ করে। কিন্তু এইসব ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেনদেন করে নগদ টাকায়। পণ্য ক্রয় বা বিক্রয় উভয় ক্ষেত্রেই নগদে লেনদেনের প্রাধান্য সিংহভাগ। এখানেই বড় সমস্যা টা বেঁধে আছে-ব্যাংক যেভাবে বা যে প্রক্রিয়ায় ঋণ প্রদান করে সে প্রক্রিয়ায় ঋণ গ্রহীতাদের বাস্তব লেনদেন কার্যক্রম সংঘটিত হয় না। তাই প্রশ্ন হলো ঋণ প্রদান প্রক্রিয়া বাজারমুখী চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে নাকি বাজারে বা অর্থনৈতিক চলমান প্রক্রিয়া ব্যাংকের চাহিদার বা প্রক্রিয়ার আলোকে সাজাতে হবে। এই দুয়ের অসামঞ্জস্যতা অনেক সম্ভাবনাময় উদ্যোগ কে নষ্ট করছে, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হচ্ছে এবং ব্যাংক বিশাল অংকের আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । 

এই অসামঞ্জস্যের সমাধান কল্পে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা গুলো প্রণিধানযোগ্য। ব্যাংকের ঋণদান প্রক্রিয়াকে সহজতর করার জন্য একজন মাঠ পর্যায়ের কর্মী হিসেবে আমার প্রস্তাবনা হলো:

ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকের ক্ষেত্রে-

১. ঋণের আবেদনপত্র বা প্রস্তাবনাপত্র সহজীকরণ। 

২. ঋণের আবেদন পত্রে ঋণ গ্রহীতার তথ্য সংগ্রহের অতিরঞ্জিত পদ্ধতি সহজীকরণ। 

৩. Quantitative analysis বা পরিমাণগত বিশ্লেষণের সরলীকরণ। 

৪. Qualitative Analysis বা গুণগত বিশ্লেষণ উপর গুরুত্ব প্রদান। 

৫. বিক্রয়, প্রাপ্য ও বকেয়া রেজিস্টার বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া জোরদারকরণ। 

৬. শাখা ব্যবস্থাপকদের ঋণদান প্রক্রিয়া প্রশিক্ষণ ও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্তকরণ । 

৭. ঋণ প্রদান প্রক্রিয়ার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকরণ। 

৮. ঋণ গ্রহীতাদের নগদ লেনদেনে নিরুৎসাহিতকরণ এবং ব্যাংক হিসাব কেন্দ্রিক লেনদেনে উৎসাহিতকরণ। 

৯. উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ জোরদারকরণ । 

১০. গ্রুপ ভিত্তিক ঋণ প্রদান উৎসাহিত করা। 

১১. ঋণের প্রয়োজনীয়তা পরিপূর্ণ ও বাস্তবসম্মতভাবে বিশ্লেষণ। 

১২. ঋণ গ্রহীতার ব্যবসার ধরণ আত্মস্তকরণ। 

ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে করণীয়:

১. দৈনন্দিন লেনদেন ব্যাংক হিসাবে জমা ও উত্তোলন করা, যাতে করে দৈনিক বিক্রির একটা প্রমাণিত বাস্তবতা ব্যাংক গ্রহণ করতে পারে। 

২. বিক্রয়, ক্রয়, প্রাপ্য ও বকেয়া হিসাব বহি বা রেজিস্টার ম্যানুয়ালি বা প্রযুক্তিগতভাবে চালিয়ে যাওয়া। 

৩. ব্যবসা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত হিসাব পত্র-উদ্বৃত্তপত্র, আয়-ব্যয় হিসাব ব্যবস্থাপনা ও এই হিসাব রক্ষণে মৌলিক অর্থনৈতিক শিক্ষার (Basic Financial literacy) আত্মস্তকরণ। 

৪. প্রশিক্ষণ গ্রহণ । 

৫. ব্যাংক ও ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হওয়া । 

৬. ঋণের প্রকৃত ব্যবহার নিশ্চিত করণ এবং এর প্রমাণ স্বরূপ ঋণ আবেদনপত্রে পরিপূর্ণ পরিকল্পনা ব্যাংকারকে প্রদান। 

ব্যবসায়িক সংগঠনের করণীয়:

১. সংগঠনের সদস্যদের ব্যবসায়িক দক্ষতা ও সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে সংগঠনের ঋণ কার্যক্রমের পরিবর্তে গ্যারান্টি প্রদান। 

২. উদ্যক্তা প্রশিক্ষণ জোরদার করন। 

৩. সদস্যদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে সম্পৃক্ততা জোরদার করন। 

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণ বিতরণে ব্যাংক ও ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই-

১. ব্যাংক অনেক কাগজপত্র চায়। 

২. ব্যাংক জামানত ছাড়া ঋণ দেয় না । 

ইত্যাদি ইত্যাদি। 

এসব অভিযোগ করে স্বয়ং ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা হলো এইসব ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো কোনোভাবেই কোন ঋণ গ্রহীতার পক্ষে গ্যারান্টি দিতে ইচ্ছুক নন। এটা এক ধরনের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে কিছু বলার জন্য বলা। কোন ব্যবসায়ী সংগঠন যদি সত্যি কার ভাবে তার অঙ্গ সংগঠনের সদস্যদের ঋণ প্রাপ্তিতে আন্তরিকভাবে সহায়তা করতে চায়,তবে সে সংগঠন ঋণগ্রহীতা সদস্যদের পক্ষে গ্যারান্টর হতে অসুবিধা কোথায়?

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, সার্টিফায়েড ট্রেড স্পেশালিস্ট এবং ব্যাংকার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন