বৈশ্বিক মহামারী করোনার ভেতরেই আমাদের জীবন চলছে। চলছে জীবিকা। তবে, সবসময়ই একটা অনাহূত আতঙ্ক আমাদের মনে চেপে আছে এটাও ঠিক। এর কারণ, নিজে বা পরিবারের চেনা মানুষ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার একটা আতঙ্ক আমরা প্রতিমুহূর্তে বয়ে বেড়াচ্ছি। বাস্তবে এটা বয়ে বেড়ানো কঠিনই বটে। এতে করে একটা মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে সবার মধ্যেই। আর এর সঙ্গে তো আছে আক্রান্ত হলে টেস্ট করাতে পারা বা না পারার ভয়।সঙ্গে আছে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে করোনা নাকি করোনা না- এই চক্রে পড়ে চিকিৎসা না পেয়ে এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসাহীন হয়ে মরে যাবার ভয়। আর সর্বশেষ ভয় হচ্ছে - লাশ নিয়ে যথাযথভাবে পারিবারিক কবরস্থানে বা শ্মশানঘাটে দাহ করতে না পারার মতো উদ্বেগজনক সংবাদ।
এ রকম একটা অবস্থায় আমরা করোনা সংক্রমণের দিনগুলো পার করছি। দিনে দিনে আক্রান্তের হার বাড়ছে। বেশ কিছুদিন আগে ‘দি ইকোনোমিস্ট’ তাদের প্রতিবেদনে তখনই শুধু ঢাকাতেই সাড়ে সাত লাখ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলো। এরও আগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের আবিষ্কৃত টেস্ট কিটের প্রধান বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল বলেছিলেন, দেশের ২০-৩০ ভাগ মানুষ তখনই নাকি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
তবে, সমস্যাটা হচ্ছে, করোনা নিয়ে আমরা এখনও মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে পারিনি। কারণ মানুষ করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করছে। করোনা আক্রান্ত হয়েছে শুনলে তার বাড়ি লকডাউন করা হচ্ছে। তাকে নির্দয়ভাবে একঘরে করে দেয়া হচ্ছে। বাসা থেকে বের করে দেয়ার ঘটনাও আছে। শুরুতে তো ওই বাড়িতে গিয়ে লালপতাকা উড়িয়ে দেয়া হতো। অথচ আমরা বন্ধ করে রাখা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, কমিউনিটি সেন্টারগুলোকে আইসোলেশান সেন্টারে পরিণত করে সেখানে এসব আক্রান্ত ব্যক্তিকে কিন্তু আলাদা করে রাখতে পারি সহজেই। সেটা করা কেন হলো না বা হচ্ছে না তা আমার বোধগম্য নয়।
যাই হোক, করোনার এমন আগ্রাসী সময়ে মানুষ কোথায় মানবিক হয়ে উঠবে তা নয়; বরং আরো যেন হিংস্র, অমানবিক হয়ে উঠছে। আমাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন-করোনা আক্রান্ত বাড়িতে কোনো মহাঅপরাধী, সন্ত্রাসী, দাগী ব্যক্তি অবস্থান করছে। আর কেউ মারা গেলে তার বাড়িতে তো কেউ যাচ্ছেই না। হাসপাতালে মারা গেলে উল্টো তার মৃতদেহ এলাকায় এনে কবর দিতেও চরম বাধা দিচ্ছে। শ্মশানঘাটেও দাহ করতে দিচ্ছে না । ফলে করোনায় আক্রান্ত হওয়া বা মৃত্যু হওয়া মানেই ভাবটা এমন যেন উনি এক মহা অভিশপ্ত ব্যক্তি!
অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, এটা একটা সংক্রামক রোগ ছাড়া আর কিছুই না।ফলে এ নিয়ে সচেতন হতে হবে সবাই কে। জনগনকে এটাও ভালো করে জানাতে হবে যে, করোনায় মারা যাওয়ার ৩ ঘন্টা পরে মৃতদেহ থেকে করোনা ছড়ানোর সম্ভাবনা মোটেই নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই কিন্তু এটা বলেছে। আমাদের দেশের আইইডিসিআরও একই কথা বলেছে অনেক আগেই। তারপর সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছিলো করোনায় মারা যাওয়ার পরে চাইলে যে কেউ তার এলাকায় নিয়ে মৃতদেহে যথাযথ স্বাস্থ্যরীতি মেনে দাফন বা সৎকার করতে পারবেন।
কিন্তু বাস্তবতা কি বলছে? আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে এনবিআর এর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মারা যাওয়ার পরে মৃতদেহ তার জন্মস্থানে পৌঁছলে সেখানের শ্মশানঘাটে দাহ করতে না দেয়ার ঘটনার কথা। পরে তার শ্বশুরবাড়ির এলাকায় মৃতদেহ নিয়ে গেলে সেখানেও দাহ করতে বাধা দেয়া হয়। শেষে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে দাহ করা সম্ভবপর হয়েছে। এর বেশ আগে উত্তরবঙ্গে একজন দরিদ্র পিতা স্থানীয় লোকজনের বাধার মুখে তার করোনাক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মেয়ের লাশ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দাফন করতে না পারার কথাও নিশ্চয় আমরা কেউ ভুলে যায় নি!দরিদ্র এই বাবা পরে একজন সুইপারকে (সম্ভবত) টাকা দিয়ে তার মেয়ের লাশ দাফনের জন্য দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই ব্যক্তিটি টাকা নিয়ে পরে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। পরে নদী থেকে সে লাশ তুলে এনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাফন করা হয়।
বিদ্যমান বাস্তবতায় সরকারের কাছে আমার তাই আকুল আবেদন থাকবে যেন এ ব্যাপারে টিভি, রেডিও, সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে সুস্পষ্ট আইন উল্ল্যেখ করে নির্দেশনা প্রদান করে বক্তব্য রাখা হয়। সেই সঙ্গে সব জায়গায় এমন নির্দেশনা দিতে হবে যেন কেউ করোনা আক্রান্তের বাড়িতে গিয়ে লালপতাকা টানিয়ে না দিতে পারে। আবার মৃতদেহ সৎকারেও যেন কেউ বাধা না দিতে পারে।
এরপরেও যদি কারো বাড়িতে লাল পতাকা টাঙানো বা মৃতদেহ সৎকারে বাধা দেয়া হয় তাহলে প্রশাসন যেন আইন মোতাবেক রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা ভঙ্গের দায়ে এসব ‘নৈরাজ্য সৃষ্টকারীদের’ বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নেয়। তাহলেই দেখা যাবে, করোনা আক্রান্ত হলেও কেউ তা নিয়ে আর লুকোচুরি করবে না। নিজে থেকেই টেস্ট করাতে উৎসাহী হবে। যদিও ১ জুলাই থেকে টেস্টের জন্য ২০০ টাকা ফি নির্ধারণ করে আর এক জটিলতা তৈরি করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়। এটা তুলে নেয়া উচিত। কারণ মহামারীর চিকিৎসা সংক্রান্ত সব কিছুই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই করা উচিত।
তাহলে মানুষ অন্তত তার জীবন ও জীবিকার মাঝে যে টানাপোড়েনের কষ্ট তার মাঝে কিছুটা হলেও মানসিক স্বস্তি বা শান্তি ফিরে পাবে। করোনার এই ভয়াবহ বাস্তবতায় তাই রাষ্ট্রের কাছে, আপামর জনসাধারনের কাছে আমার আরো বেশি মানবিক হয়ে উঠার আবেদন থাকবে।
ডা. পলাশ বসু
চিকিৎসক ও শিক্ষক
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ
এনাম মেডিকেল কলেজ।