এ সময়ে

সংকটে নাকাল শিক্ষা ব্যবস্থা

আশেক মাহমুদ

করোনা মহামারীতে এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে মারা গেছে তিন লাখ, আর আক্রান্ত ৪৬ লাখের ওপরে (জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি) বাংলাদেশে আক্রান্ত মৃৃতের সংখ্যা বেড়েই চলছে; তার চেয়ে বেশি বাড়ছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য সোস্যাল স্টিগমার বিভীষিকা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে সেই পরিসংখ্যান আমরা দেখতে পাই না। যেকোনো দুর্যোগের প্রথম প্রধান শিকার হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তাই নিয়ে উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তদের ভাবনা কমই থাকে। কিন্তু করোনা সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও বার্তা দেয় যে এটি কোনো জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ, উঁচু-নিচু কিছুই মানে না। অন্য রোগ হলে গরিবের হয়তো চিকিৎসা মেলে না, কারণ তাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকে না। কিন্তু করোনা সব ধারণা পাল্টে দিয়ে সব ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিচ্ছে। অবস্থায় লকডাউন হয়ে পড়েছে মানুষের আয়ের খাতগুলো। সংসার চালাতে পারছে না নিম্ন নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষেরা। কেউ কেউ আত্মহত্যা করছেন, অনেকেই দুমুঠো খাবারের জন্য দ্বারে দ্বারে হাত পাতছেন, আবার অনেক ভাড়াটিয়াকে মালিকরা বাসা থেকে বের করে দিচ্ছেন। আর্থিক দুরবস্থার এই কালে শিক্ষা ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে।

আমরা হয়তো মনে করি, চরম সংকটে শিক্ষা নিয়ে ভাবার কী দরকার! হয়তো আবেগে বললাম, আগে আমরা বাঁচি, তার পরে শিক্ষার প্রশ্ন। মৌলিক অধিকারের তালিকায় এটি তো শেষের সারিতে আছে। কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয়। প্রশ্ন হলো, শিক্ষা খাতের সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা। ইউনেস্কোর তথ্যমতে, সারা বিশ্বে ১৯০ দেশের ৯০ শতাংশের অধিক (. বিলিয়ন) ছাত্রছাত্রী স্কুলশিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরে বন্দি হয়ে আছে (ডেইলি সান, মে) বাংলাদেশে ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষা কার্যক্রমই বন্ধ হয়নি, শিক্ষা খাতের সংশ্লিষ্ট শিক্ষক কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আয় উপার্জন এক কঠিন বাস্তবতার মধ্যে পড়ে যায়। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চিন্তামুক্ত থাকলেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। দেশের মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ৯৭ শতাংশ সরকারি আওতার বাইরে থাকায় দুশ্চিন্তার মাত্রাই অধিক। সারা দেশের সরকারি চাকরিধারী প্রায় ১৩ লাখ এক্ষেত্রে চিন্তামুক্ত হলেও প্রায় ২০ কোটির দেশে নিরাপত্তার প্রশ্নটি বড় হয়ে গেছে। নিরাপত্তাহীনতার দুশ্চিন্তায় থাকতে হচ্ছে কোটি কোটি প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষকসমাজের এক বড় অংশ। লক্ষাধিক প্রাইভেট স্কুল-কলেজের ১০ লাখের অধিক শিক্ষক, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দুই লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী, এছাড়া বেসরকারি মাদ্রাসা আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষক আর্থিক সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বিষয়টি পুরো জাতির জন্য হতাশাজনক।

দেশের সব ব্যবস্থা সচল রাখতে সরকারি-বেসরকারি দুটোরই প্রয়োজন আছে, কিন্তু দেশ জনগণের ক্রান্তিলগ্নে সরকারের কাছে সবাই নাগরিক। এখানে সরকারি-বেসরকারি বিভাজনে প্রশ্ন ওঠে, কারা দেশের নাগরিক? রাষ্ট্রের দায়িত্ব যখন আপামর জনসাধারণকে ঘিরে, তখন সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় করে সমাধানে এগিয়ে আসার দায়িত্ব প্রথমে সরকারের। কেননা সরকার জনগণের অভিভাবক, আর সরকারি কর্মকর্তা হবেন জনগণের সুরক্ষার নিবেদিত কর্মী। এই ক্রান্তিলগ্নে জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য থেকে যে সংকটের জায়গা এসেছে, তার আশু সমাধান দেখা জরুরি হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে দুটো বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে. শিক্ষকদের জীবন-জীবিকা রক্ষা, . শিক্ষা কার্যক্রমে গতি সৃষ্টি করা। সাময়িক অসাময়িক দুটো দিকই মাথায় রাখতে হবে। সাময়িকভাবে নন-এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা জরুরি। একজন শ্রমিক বা ভিখারি হাত পেতে কিছু নিতে পারেন, কিন্তু একজন শিক্ষক নিজের অভাব লুকিয়ে রাখেন, কাউকে বুঝতে দেন না যে তার হাঁড়িতে খাবার নেই; ধার করতে গেলে লজ্জায় মুখ লুকাতে হয়; বাসাভাড়া দিতে না পারলে লজ্জায় হেঁট হয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যেতে হয়। তাদের দেখার জন্য প্রথমে দেয়া যেতে পারে আর্থিক প্রণোদনা। দ্বিতীয় পদ্ধতি হলোম শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে প্রাপ্ত টিউশন ফি দিয়ে সবার বেতন নিশ্চিত করা। শিক্ষা কার্যক্রমে পদ্ধতি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হলেও এর জটিলতা নিয়ে ভাবতে হবে।

পাবলিক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অনলাইন পাঠদান অতি বেশি দুরূহ মনে হচ্ছে। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের জন্য এটা এখন চিন্তাই করা যায় না। বড়জোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য এটি প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা; তাদের না আছে ইন্টারনেট সাপোর্ট, না আছে ল্যাপটপ; স্মার্টফোন থাকলেও নেটওয়ার্কিং টেকনিক্যাল জ্ঞানের অভাব তো আছেই। উপরন্তু, অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর পারিবারিক অবস্থা আর্থিক অনটনের মধ্যে যাচ্ছে, যার ফলে উদ্বিগ্নতা আর টানাপড়েনের মধ্যে অনলাইন লেখাপড়ায় মনস্থির এক দুরূহ ব্যাপার। আর তাই  Burgess & Sievertsen (2020) তাদের এক আর্টিকেলে লেখেন, ‘Global home schooling will surely produce some inspirational moments, some angry moments, some fun moments and some frustrated moments এর মানে পারিবারিক অবস্থা যখন দুশ্চিন্তায় যাচ্ছে, তখন লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ আনা দুষ্কর হয়ে গেছে।

Needs Assessment Working Group Bangladesh (2020) রিপোর্ট দিয়েছে, ৪২ শতাংশ এখনো শিক্ষা কার্যক্রম বিষয়ে কিছু শোনেনি; ৩৮ শতাংশ পিতা-মাতা এই লকডাউনে সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে মনোযোগ দিতে পারছেন না; ৬০ শতাংশ বলছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে না। থেকে বোঝাই যাচ্ছে লকডাউনে শিক্ষা কার্যক্রমে গতি আনা খুবই কঠিন। তবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে শিক্ষা চালিয়ে নিতে পারে। আর এটা এজন্য যে সাধারণত সচ্ছল প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রছাত্রীরা এখানে লেখাপড়া করে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ দিচ্ছে, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় দিচ্ছে আরো কম। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ কারা তা বোঝাই মুশকিল। কেননা ভিসি মহোদয়ের কার্যত ক্ষমতা কম, তাদেরকে মালিকশ্রেণীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতে হয়; যা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ২০১০-এর মূলনীতি বিরোধী। আমেরিকান শিক্ষা গবেষক Philip Altbach বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বজায় রাখতে প্রয়োজন একাডেমিক স্বাধীনতা চাকরির নিশ্চয়তা (ডেইলি সান, মে, ২০২০) এর সঙ্গে মিল রেখে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ২০১০- বলা হয়েছে, প্রত্যেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটি রিজার্ভ ফান্ড রাখতে হবে, যাতে আপত্কালীন ব্যয় মেটানো যায়। কিন্তু মালিকশ্রেণী সেই ফান্ডে হাত না দিয়ে টিউশন ফির ওপর নির্ভর করছে; যা শিক্ষকদের মর্যাদাকেই হানি করেনি, বরং শিক্ষাকে বাজারের চাহিদা-জোগান নীতির অন্তর্ভুক্ত করেছে। মালিকশ্রেণীর এই নগ্ন শোষণনীতির লাগাম টেনে ধরতে ইউজিসি সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে খতিয়ে দেখতে হবে ওইসব প্রাইভেট স্কুল, কলেজ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ম্যানেজমেন্ট বডির আপত্কালীন কর্মপন্থা কেমন হচ্ছে। লাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফান্ড থেকে শিক্ষক-কর্মচারী যেন তাদের ন্যায্য মুনাফা পান, সে বিষয় নিশ্চিত করার দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে।

আমরা চাই শিক্ষা আর শিক্ষক যেন সমাজে অবেহেলিত না হয়। শিক্ষকশ্রেণীকে অবহেলার দিকে ঠেলে দিয়ে জাতীয় চেতনা মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। আপত্কালীন সমস্যা সমাধানে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় আনা দরকার। আমাদের মনে রাখা দরকার, শ্রম আর শিক্ষা সভ্যতার দুই ডানা। একটি ছাড়া অন্যটা চলতে পারে না। শ্রমের অধিকার যেমন জরুরি, শিক্ষার মর্যাদাও অতিজরুরি বিষয়। আমরা চাই সরকারি উদ্যোগে নন-এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজকে এমপিওভুক্ত করে তাদের অধিকার সমুন্নত করা হোক; ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কাঠামোকে পুঁজির শাসন থেকে মুক্ত করে মানবীয় কাঠামোয় দাঁড় করানো হোক। সঙ্গে সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার সঙ্গে প্রাইভেট পুঁজির মধ্যকার দেনদরবার বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে পারলে শিক্ষা শিক্ষকসমাজের মর্যাদা সমুন্নত হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। আমরা এও মনে করি, শিক্ষকসমাজ বাঁচলে শিক্ষা বাঁচবে, শিক্ষা বাঁচলে সমাজ বাঁচবে।

 

আশেক মাহমুদ: সহকারী অধ্যাপক

সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

পিএইচডি গবেষণাধীন

ইউনিভার্সিটি অব মালয়া, মালয়েশিয়া

[email protected] 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন