বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালিত

জনস্বাস্থ্যগত বিপর্যয় মোকাবেলায় প্রস্তুত-পরিকল্পনার ঘাটতি দূর হোক

করোনা মহামারীর মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস সাদামাটাভাবে পালিত হলো বিশ্বজুড়ে। দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবার পাশে বিস্ময়সূচক চিহ্ন বসালেও আশ্চর্যের কিছু নেই। স্বাধীনতার সাত দশক পার করেও দেশের অনেক স্থানে চিকিৎসা পরিষেবা নিম্নমানের। জনস্বাস্থ্যের দুরবস্থা চোখে পড়ার মতো। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি নতুন করে নির্ধারিত হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাস্থ্য পরিষেবায় স্বনির্ভরতা অর্জন এবং প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রের মাধ্যমে সবার জন্য স্বাস্থ্য বাস্তবায়ন করা। কিন্তু তা সফল হয়নি। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারি অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। মোট দেশজ উৎপাদনের শতাংশেরও কম সে বরাদ্দ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বরাদ্দ উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম বলেও জানা যায়। বস্তুত দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য পরিষেবা অবহেলিত। ফলে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবার ঘাটতি দেখা যায় এবং সেই সুযোগ নিতে এগিয়ে আসে বিভিন্ন বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ী। ক্রমে তারা দেশের স্বাস্থ্য বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আজও তাদের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ শিথিল। করোনার সময় অধিকাংশ হাসপাতাল তালাবদ্ধ করে রেখেছে। সেবা প্রদান থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে।

সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে। প্রতি বছর ডেঙ্গু সোয়াইন ফ্লু জনগণকে আতঙ্কিত করে তোলে। বর্তমানে করোনার প্রভাব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গিন অবস্থা আরো একবার প্রকাশ করল। গত বছর ডেঙ্গু আমাদের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তুলে ধরেছিল। সরকারের তখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকলেও এবার সেটিও ভেঙে পড়েছে। ছোঁয়াচে বা উচ্চ সংক্রমণ ধরনের রোগের চিকিৎসারও পর্যাপ্ত বন্দোবস্ত দেখা যায় না। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র হাসপাতালগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না। কথা বললে হয়তো ভুল হবে না যে স্বাধীনতার পর দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার যেমন প্রসার ঘটার প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। অনেক স্থানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে, কিন্তু সেখানে ঠিক উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা দেয়ার বন্দোবস্ত নেই। চিকিৎসক, ওষুধ, চিকিৎসার উপকরণ পরীক্ষাগারের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেক শহরে আজও আধুনিক স্বাস্থ্য  ব্যবস্থা দেখা যায় না।

পরিকাঠামোর অভাবই বোধ হয় দুর্বল স্বাস্থ্য পরিষেবার অন্যতম কারণ। আইসিইউ সেবা সীমিত, ভেন্টিলেটর নেই, সুরক্ষা উপকরণের সংকটও প্রকট। এর পরিবর্তন বিকাশ অত্যন্ত প্রয়োজন। আর তার জন্য চাই পর্যাপ্ত অর্থ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু সমালোচকদের একাংশ মনে করেন, সরকারি বাজেটে তা বিরল। দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার সাধারণ মানুষের অসন্তোষ প্রায়ই দেখা যায়। কখনো কখনো চাপা উত্তেজনা হিংস্রতার রূপ ধারণ করে ফিরে আসে। চিকিৎসকের অভাব, জরুরি জীবনদায়ী ওষুধে টান, রোগীর শয্যার অভাব প্রভৃতি হয়তো অনেক ক্ষেত্রে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং অসংযত আচরণের পথে ঠেলে দেয়। ফলে রোগীর লোকজনদেরও সহিষ্ণুতার বাঁধ ভেঙে যায়। জন্ম দেয় বচসা সংঘাতের। অবস্থার পরিবর্তন সবার কাম্য এবং একে বাস্তবায়ন করতে সরকারি উদ্যোগও অধিক প্রয়োজন।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাসপাতালে সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থার চিত্রেরই খবর আসছে। একদিকে করোনার চিকিৎসা না পাওয়া, অন্যদিকে করোনার আতঙ্কে হাসপাতালগুলোয় সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশি এমনকি হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে গেলেও ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিলছে না কোনো চিকিৎসা। জ্বর, সর্দি-কাশি হলেই করোনা আক্রান্ত হতে পারেনএই ভয়ে চিকিৎসকরা দিচ্ছেন না চিকিৎসা। করোনা আক্রান্ত রোগী এসেছে কিংবা করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেএমন সন্দেহে হাসপাতাল ছেড়ে ডাক্তারের পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। গত কয়েক দিনে যেসব হাসপাতালে করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগী মারা গেছে, তার প্রায় প্রতিটি ডাক্তার, নার্স এমনকি রোগীশূন্য হয়ে পড়েছে। বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। দিন দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয়েরও আশঙ্কা রয়েছে। সবকিছুর মোকাবেলায় কি আমরা প্রস্তুত? বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে আমাদের এটা নিয়ে ভাবতে হবে। নিতে হবে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সাধারণ মানুষ সাংঘাতিকভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। স্বাস্থ্য পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িত মানুষের আর্থিক অবস্থাও। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আয়-উপার্জন বাড়ছে না; বাড়ছে না তাদের ক্রয়ক্ষমতা। অথচ বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। ফলে দৈনন্দিন আহার জোটাতে হিমশিম খাচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। তারা বঞ্চিত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা থেকেও। আর্থিক দুর্বলতার কারণে চিকিৎসার পেছনে অর্থ ব্যয় করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাই তাদের পরিণতি হচ্ছে বিনা চিকিৎসায় রোগশোকে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া।

অবকাঠামো জনশক্তির মধ্যে ভারসাম্যহীনতা একটা বড় সমস্যা। স্বাস্থ্য খাতে মানুষের ব্যয়ের বোঝাটা কীভাবে কমানো যায়, তার উপায়ও আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের রেফারেল সিস্টেমটা কাজ করছে না। বাংলাদেশে যেটিকে আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছি, আসলে সেটি স্বাস্থ্যসেবা মন্ত্রণালয় প্রকৃতপক্ষে একে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করতে হলে শুধু চিকিৎসাসেবা বা স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে আটকে থাকলে হবে না। সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে এর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে সরকারি খাতে চিকিৎসাসেবার মান যেমন দিন দিন নিচের দিকে যাচ্ছে, তেমনি বেসরকারি খাতেও স্বাস্থ্যসেবার মান প্রত্যাশিত পর্যায়ে নেই। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা প্রাইভেট চেম্বারে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেও মানুষ সুচিকিৎসা পাচ্ছে না। সেই সঙ্গে আছে ভুল চিকিৎসা। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালেই ভুল চিকিৎসার শিকার হতে হচ্ছে রোগীদের। অন্যদিকে বাড়ছে ওষুধপত্রের দাম-চিকিৎসা ব্যয়। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। তারা সরকারি চিকিৎসাসেবা তো পাচ্ছেই না, বেসরকারি চিকিৎসকদের সান্নিধ্য পাওয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা মফস্বল এলাকায় চেম্বার খুলতে চান না। প্রেক্ষাপটে ডাক্তারদের বেসরকারি প্র্যাকটিস এবং সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে চিকিৎসা কার্যক্রম যাতে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে চলে আসে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন