ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট প্লাস জবাবদিহিতামূলক, তাদের কাজ করতে দিন

রেজাউল করিম চৌধুরী

করোনা ভাইরাস আক্রান্ত দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রায় ভেঙে পড়া কৃষকের ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎপাদন ও সরবরাহ পুনরুজ্জীবিত করা অত্যন্ত জরুরি। দেশের মোট শ্রমজীবী মানুষের ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের, যারা গ্রাম, উপশহর এবং শহরে বাস করছেন। এই সম্পূর্ণ বা আংশিক লকডাউন পরিস্থিতিতে কৃষি ও অকৃষি খাতে যুক্ত এই বিশাল জনশক্তির উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ ও জীবনযাপনের জন্য ক্ষুদ্রঋণ অপরিহার্য। তারা একটা ভয়াল সময় পার করছে। করোনা থেকে বাঁচতে সচেতনতার পাশাপাশি বিনিয়োগের সুযোগও তাদের জন্য খুব দরকার। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো তা করার জন্য এই মুহূর্তে প্রস্তুত আছে এবং সামাজিক/শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই তারা তা অনায়াসে করতে পারে। 

বলতে গেলে, বাংলাদেশে গরিব মানুষের সচেতনতা ও ব্যবহারিক আচরণ পরিবর্তনে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলো অদ্বিতীয় ভূমিকা রেখে আসছে। সম্প্রতি, করোনা সম্পর্কিত সচেতনতা কার্যক্রম শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ও এনজিওদের এ ধরনের কার্যক্রম লকডাউনের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সবচেয়ে বড় নেটওয়ার্ক সিডিএফ (ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম) এই বিষয়ে অ্যাডভোকেসি করে যাচ্ছে।

সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম এবং জবাবদিহিতা নিয়ে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। প্রায় ৩ দশমিক ৩০ কোটি গ্রাহকের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই খাত। প্রতি গ্রাহকের পরিবারে পাঁচজন সদস্য আছেন বিবেচনা করলে ক্ষুদ্রঋণের সেবাপ্রাপ্ত মোট জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৫ কোটি, যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ। প্রায় ২ দশমিক ৫ লাখ কর্মী ক্ষুদ্রঋণ খাতে কাজ করছেন এবং তাদের পরিবারসহ হিসাব করলে প্রায় ১২ দশমিক ৫ লাখ মানুষের জীবিকার সংস্থান করছে এই খাত। 

গবেষণায় দেখা গেছে, দেড় লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগকৃত এই ক্ষুদ্রঋণ খাতের জিডিপিতে অবদান প্রায় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ (ড. সেলিম রায়হান ও বাকী খলিলি)। করোনা পরিস্থিতির শুরুতেই স্বল্প প্রস্তুতিতে বন্ধ করে দেয়া এই বিশাল খাত অবিলম্বে চালু করা না গেলে এই পরিবারগুলো (গ্রাহক এবং কর্মী) ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৃতীয় প্রজন্মের অনেক ছোট ছোট ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান নিকট ভবিষ্যতে কর্মীদের বেতন-ভাতাও হয়ত আর পরিশোধ করতে পারবে না। এভাবে বন্ধ থাকার কারণে অনেক ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং এই খাতে অল্প কিছু বড় প্রতিষ্ঠানের একাধিপত্য কায়েম হবে। ফলশ্রুতিতে গোটা খাতের বৈচিত্র্য ও ভারসাম্য হারিয়ে বিপদগ্রস্ত হবে।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে এখন বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সেরা। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো একটি সরকারি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (মাইক্রোফাইন্যান্স রেগুলেটরি অথরিটি বা এমআরএ) দ্বারা পরিচালিত। ২০০৬ সালে জাতীয় সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে এমআরএর যাত্রা শুরু। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তৃতীয় প্রজন্মের ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করছে যেখানে ঋণ, সঞ্চয় ও বীমা সুবিধার পাশাপাশি সেই আয় থেকে গ্রাহকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি সহায়তাও দেয়া হচ্ছে। যা আগের দুই প্রজন্মের প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুপস্থিত ছিল। প্রথম প্রজন্মে ছিল শুধু সঞ্চয় ও ঋণ, দ্বিতীয় প্রজন্মে গ্রাহকের স্বার্থে যুক্ত হয় বীমা।

ক্ষুদ্রঋণের ইতিহাসে প্রথম থেকে কাজ শুরু করা তিনটি বড় সংস্থা (গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক ও আশা) মোট পোর্টফোলিওর ৫৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। শুরুর দিকে তাদের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ খুব বেশি ছিল না। বাকি ৪৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ঋণ রয়েছে কোস্ট ট্রাস্টের মতো ৭০০ মাঝারি ও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের এই সংস্থাগুলো এমআরএর পাশাপাশি আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান পিকেএসএফ (পল্লি কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন) দ্বারাও কিয়দংশে নিয়ন্ত্রিত। অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশবিদ ড. খলিকুজ্জমানের নেতৃত্বে বর্তমানে পিকেএসএফ পরিচালিত হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ ও সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রমে বিশেষজ্ঞ একটি দল পিকেএসএফ নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে। 

কোস্টের মতো তৃতীয় প্রজন্মের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো পিকেএসএফ থেকে তুলনামূলক কম সুদে তহবিল নিয়ে দরিদ্র মানুষকে ঋণ সহায়তার পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, শরণার্থী ত্রাণ, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং প্রবীণ সেবামূলক নানাবিধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে। স্থানীয় সরকারের সঙ্গে মিলে তারা একটি সমন্বিত উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে যেখানে মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র উদ্যোগ কর্মসূচির সম্প্রসারণ, প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তার মাধ্যমে গড়ে তোলা হচ্ছে দক্ষ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গোষ্ঠী, যার একটি বড় অংশ নারী। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই বাংলাদেশ ক্রমশ উন্নয়নশীল দেশের সারিতে উঠে আসছে।

ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের খেয়াল খুশিমতো ঋণ প্রদান ও সুদ গ্রহণ করছে- এ ধরনের যে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অনেক বেশি জবাবদিহিতা ও সরকারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। এসব সংস্থাকে মাইক্রোফাইন্যান্স রেগুলেটরি অথরিটি প্রতি তিনমাসে একবার এবং পিকেএসএফ প্রতি মাসে একবার করে মনিটর করে। এটি কেবল আর্থিক মনিটরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, একই সঙ্গে ব্যবস্থাপনা বিষয়েও তারা পর্যবেক্ষণ করে। 

এছাড়াও বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাহায্যে পরিচালিত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অধীন এনজিও বিষয়ক বুরোতেও নিয়মিত প্রতিবেদন দাখিল ও ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয় এসব সংস্থাকে। সব ক্ষেত্রেই সংস্থাগুলোকে বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। আয়কর অফিসেও সংস্থাগুলোকে নিয়মিত প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। নির্বাহী প্রধানদের ব্যক্তিগত সম্পদের বিবরণীও জমা দিতে হয়। গ্রামে ক্ষুদ্রঋণের চাহিদা বাড়ায় ছোট ছোট ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেও ইদানীং ঋণ গ্রহণ করছে। নিরাপত্তা হিসেবে প্রধান নির্বাহীকে সেখানে ব্যক্তিগত নিশ্চয়তা দিতে হচ্ছে। এই নানামুখী ও কঠোর জবাবদিহিতা কাঠামোর মধ্যে আসলে খেয়াল খুশি মতো ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা করার কোনো সুযোগ নেই।

একটি উদারবাদী সংস্থা হিসেবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী কোস্টের মতো ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলো সবসময় তার অংশগ্রহণকারী সদস্য ও যে কোনো ব্যক্তির কাছে জবাদিহিতা নিশ্চিত করতে অঙ্গিকারাবদ্ধ। যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো সময় অভিযোগ কিংবা সুপারিশ সরাসরি প্রধান নির্বাহীকে জানাতে পারেন।

রেজাউল করিম চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন