বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্তে নতুন কোনো ভাইরাসের আবির্ভাব হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনসহ সামাজিক জীবনাচারে পরিবর্তনের ফল এটি। ইবোলার আতঙ্ক চলেছিল কিছুদিন, পাশাপাশি মার্স ও সার্স ভাইরাসও যথেষ্ট শোরগোল ফেলেছিল। এবার চীনে নতুন একটি ভাইরাসে ভীতসন্ত্রস্ত গোটা বিশ্ব। ভাইরাসটি অতীতের সার্স ভাইরাসেরই একটি সংস্করণ বলে জানানো হচ্ছে। এর আক্রমণে সবচেয়ে বেশি পর্যুদস্ত চীনের উহান শহর। ভৌগোলিকভাবে নিকটপ্রতিবেশী বিধায় এ ভাইরাস থেকে আমাদের সতর্ক থাকাটা বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া চীনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগও গভীর। দেশটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী। বেশকিছু প্রকল্পে চীনা বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন। প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক মানুষ যাতায়াত করছে চীনে। ফলে এটি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাসটি মূলত শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এর প্রধান লক্ষণ জ্বর। সঙ্গে সর্দি, কাশি, গলাব্যথা থাকে। এ সমস্যা আমাদের দেশে শীতকালে খুবই সাধারণ। তবে তা ইনফ্লুয়েঞ্জা কিংবা সাধারণ সর্দিজ্বর, এটি কখনই প্রাণঘাতী নয়। কিন্তু নতুন ধরনের করোনাভাইরাসটি প্রাণঘাতী। আর যেহেতু এটি অনেক সাধারণ রোগের উপসর্গের সঙ্গে মিলে যায়, সে কারণে এ ভাইরাস বাংলাদেশে প্রবেশ করলে তা ব্যাপক আতঙ্ক ছড়াতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশের জনঘনত্ব অনেক বেশি। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে এবং তার হাঁচি-কাশি থেকে বায়ুর মাধ্যমেও এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। তবে আশার কথা হলো, এর সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশেও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, যেকোনো ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার বিকল্প নেই। সুতরাং সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাসটি জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে হাত না ধুয়ে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করাটা সব সময়ই বিপজ্জনক। এ ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষেত্রেও তা সত্য। পাশাপাশি মানুষ যেন অকারণে আতঙ্কিত না হয়, সেদিকেও প্রশাসনকে নজর দিতে হবে প্রচারণা বাড়ানোর মাধ্যমে।
বাংলাদেশে সোয়াইন ফ্লু ও বার্ড ফ্লু নিয়েও এক ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, নিপা ভাইরাসও সারা দেশকে আতঙ্কিত অবস্থায় ফেলে দেয়। বাংলাদেশেও বিমান-নৌ ও স্থলবন্দরগুলোয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া জনস্বার্থেই বিশেষ জরুরি। করোনাভাইরাস যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে না পারে, সে ব্যাপারে আগাম ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষের সচেতন দায়বদ্ধতা রয়েছে। বিদেশ থেকে আসা নাগরিকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া অনুপ্রবেশের অনুমতি দেয়া উচিত হবে না। সংক্রামক রোগবালাই ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময়ও লাগে না। এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও তীক্ষ নজরদারিতে আন্তর্জাতিক বলয়ে সংশ্লিষ্ট রোগটি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ এবং গবেষণাকেও ত্বরান্বিত করেছে। স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক দেশ এ ব্যাপারে সজাগ-সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে রোগটির ক্রমবিস্তার থেকে সারা দুনিয়া রক্ষা পাবে। আর এটাই সব দেশকে সার্বক্ষণিকভাবে করে যেতে হবে। আশার কথা হলো, বাংলাদেশে এ ভাইরাসের বিস্তার রোধে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে রোগ ছড়ানোর অন্যতম উৎস দেশগুলো থেকে আসা মানুষকে বিমানবন্দরেই থার্মাল স্ক্যানিং শুরু করেছে। বিমানকর্মীদের পাশাপাশি কাজ করছে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই তারা কোনো কোনো ব্যক্তিকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সরকারের এ উদ্যোগকে আমরা অত্যন্ত সঠিক এবং সময়োপযোগী বলে মনে করি। কেননা এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাদের শান্ত রেখে সঠিক পদক্ষেপেই সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। নিশ্চিত করেই বলা যায়, এক্ষেত্রে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। মানুষ সচেতন হলে শুধু করোনাভাইরাস কেন, যেকোনো বড় সমস্যারও সমাধান সম্ভব।
চীনা কর্তৃপক্ষ করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের জন্য পৃথক হাসপাতাল নির্মাণ শুরু করেছে, যা ছয়দিনে শেষ হবে বলে জানা যাচ্ছে। ২০০৩ সালে ‘সার্স’ মোকাবেলার জন্য ছয় একর জমির ওপর তৈরি করেছিল অস্থায়ী হাসপাতাল। সময় লেগেছিল সাতদিন। আমাদের দেশে এত দ্রুত সময়ে এ ধরনের রোগীর জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি কি সম্ভব? তবে প্রস্তুতি থাকাটা জরুরি। কিছু হাসপাতালে এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা যেতে পারে। তৈরি রাখা যেতে পারে একটা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলও। প্রাথমিক সতর্কতা হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাকেই মেনে চলা জরুরি। বিদেশ থেকে, বিশেষ করে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া দেশগুলো থেকে আগতদের স্বাস্থ্য পরীক্ষাও যেন যথাযথভাবে করা হয়। এ ভাইরাস বহনকারী কেউ যেন বিনা পরীক্ষায় বিমানবন্দর থেকে দেশে ঢুকতে না পারে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। করোনাভাইরাসের মহামারী ঠেকাতে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ এক্ষেত্রে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে গণমাধ্যমও। সবচেয়ে বড় কথা, সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ।