সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮

বাস্তবায়নে উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা হোক

বাস্তবায়নের শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮। পারিপার্শ্বিক অন্যান্য বিষয় বাদ দিলেও শুধু দুর্বল যোগাযোগ অবকাঠামোর কারণেও আইনটি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। রাজধানীতে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নেই, জেব্রা ক্রসিংয়ে অনেক সময় গাড়ি থামানো হয় না, পর্যাপ্ত ফুটপাত ও ফুটওভার ব্রিজ কিংবা পার্কিংয়ের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নেই। এ অবস্থায় সড়ক পরিবহন আইনটির কার্যকারিতা নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা রয়েছে। এটা ঠিক, নতুন আইন আগের চেয়ে অনেক কঠোর। জরিমানাও বাড়ানো হয়েছে বহুগুণ। সংশ্লিষ্ট আইন নিয়ে উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণ রয়েছে। আইনটির বিধিমালা এখনো তৈরি হয়নি। এছাড়া যে যন্ত্রের মাধ্যমে পুলিশ মামলা করে, সেই সফটওয়্যার এখনো হালনাগাদ করা হয়নি। আবার অবৈধ পার্কিং এবং ফুটপাত ব্যবহার না করলে জরিমানার কথা বলা হয়েছে। রাজধানীসহ দেশের নগরীগুলোয় পার্কিং সুবিধা সীমিত। রাস্তা পারাপারে বিকল্প জেব্রা ক্রসিং বা পথচারী সেতুও পর্যাপ্ত নয়। এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আইনটি যুগোপযোগী হয়েছে। আইন বাস্তবায়ন করতে হলে মূলে হাত দিতে হবে। বিআরটিএ স্বচ্ছ হলে সড়ক-মহাসড়কে নৈরাজ্য অনেকটাই কমে আসবে। বিআরটিএর সেবার মান নিয়ে সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টি বহুদিনের। আছে নানা অভিযোগ। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস, রুট পারমিট, ট্যাক্স টোকেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মালিকানা বদলসহ বিভিন্ন কাজে বিআরটিএর শরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু হয়রানি, অনিয়ম ও নানা মাত্রার দুর্নীতির কারণে অনেকে এ প্রতিষ্ঠান নিয়ে হতাশ। এখানে ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, হয়রানি, ভোগান্তি আর দালালদের তত্পরতা চললেও তা দেখার এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কেউ যেন নেই! পরিবহন খাত এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক যোগাযোগ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অনেক বিষয় এখন পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত। তাই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং এজন্য সময়ের ধারাবাহিকতায় সড়ক পরিবহন আইনে যে বিষয়গুলো সংযোজিত হতে যাচ্ছে, তার কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা আসতে পারে। তবে অব্যাহতভাবে সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে, যাতে প্রত্যেকে দায়িত্বশীল হয়ে নিজ থেকে আইন মানার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। সঙ্গে আইনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে সংশোধনীর ব্যবস্থা রাখাও বাস্তবসম্মত। সবার একটাই চাওয়া, যেকোনো মূল্যে সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অনিয়মকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবারই সহযোগিতা প্রয়োজন। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থা দেখতে চাই। আর এজন্য আইনি কঠোরতার কোনো বিকল্প নেই। সড়ক পরিবহন আইন যথাযথ প্রয়োগের ওপরই নির্ভর করছে সড়কে ইতিবাচক পরিবর্তন। আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠার ওপর সেটি বহুলাংশে নির্ভরশীল। শাস্তির ভয় থাকলে অন্যায় কমবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেজন্য সড়কে চলাচলকারী প্রতিটি যানবাহনের চালক ও মালিককে নতুন আইন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত করানো আবশ্যক। এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় কথা, সব পক্ষের দায়িত্বশীলতা ও সচেতনতাই পারে সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে। সড়ক দুর্ঘটনা যথাসম্ভব কমিয়ে আনার জন্য চাই সব পক্ষের সহনশীলতা, সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনা উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় একটি যুগোপযোগী সড়ক পরিবহন আইনের জনদাবি ছিল দীর্ঘদিনের। অবশেষে আইনটি কার্যকর হলেও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অযৌক্তিক দাবির কারণে এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত হবে কিনা, তা নিয়ে জনমনে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারকে দৃঢ় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। বস্তুত, সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা গেলে দুর্ঘটনা এমনিতেই কমে আসবে। যথাযথ পদক্ষেপ ও তদারকির মাধ্যমে এক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যেতে পারে। যেমন সড়কে গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসিয়ে যানবাহনের বেপরোয়া চলাচল রোধ করা সম্ভব। ওভারটেকিং, পার্কিং, যাত্রী ওঠানামাএসব ক্ষেত্রে আইন মানতে চালকদের বাধ্য করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ ও লজিস্টিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণ যখন এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে, তখন আইন কার্যকরের প্রতিবন্ধকতা তারা বুঝতে পেরেছে। সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আগে রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের নজরে কিছুই পড়েনি। তাদের দূরদর্শিতা ও পেশাদারিত্বের অভাবে এখন পরিবহন খাত জিম্মি হয়ে পড়ছে। রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ তৈরি করা হয়, যাতে তারা আগে থেকেই ভবিষ্যতে সৃষ্টি হতে পারে এমন সমস্যার বিষয়ে ভাবে; সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে। কিন্তু তারা কিছুই করেনি। মেগাসিটি বানানো হয়েছে অথচ একটা ইন্টারসিটি টার্মিনাল নেই, পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। তাই প্রস্তুতি না থাকায় আইন কার্যকর করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দুর্বল অবকাঠামোর ওপর নির্ভরপূর্বক সড়ক আইন বাস্তবায়ন করায় নানা জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা বাড়ছে। এমন অবস্থায় যোগাযোগ অবকাঠামো সবল করতে পদক্ষেপ নিতে হবে সর্বাগ্রে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, দ্রুত তা দূর করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। নতুবা জোড়াতালি দিয়ে আইন বাস্তবায়নে বিশৃঙ্খলা আরো বাড়ার আশঙ্কাই থেকে যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন