সময়ের ভাবনা

মুরগি ও ডিমের দাম বেঁধে দেয়ায় সমস্যা কমবে নাকি বাড়বে?

কাজী জাহিন হাসান

ছবি : বণিক বার্তা

২০২২ সালে ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের পর থেকে বাংলাদেশের ভোক্তারা মূল্যস্ফীতির ফলে ভোগান্তিতে আছেন। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন সমস্যাটিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বেশকিছু খাদ্যপণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এতে সাধারণ মানুষ খুশি হলেও অর্থনীতিবিদরা তাদের সতর্ক হতে বলবেন। যেকোনো পণ্যের বিক্রয়মূল্য যদি বাজারমূল্যের চেয়ে কম নির্ধারণ করা হয়, বাজারে সেই পণ্যের ঘাটতি হতে পারে।

অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, বাজারে পণ্যের দাম নির্ধারণ হয় চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য দ্বারা। সাধারণত কোনো পণ্যের দাম কমে গেলে সেটির সরবরাহও কমে যায়। ব্রয়লার মুরগির উদাহরণ দেয়া যাক। হাজার হাজার ক্ষুদ্র খামারি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা কিনে প্রায় ৩৫ দিন ধরে বড় করেন, তারপর সেগুলো বাজারে বিক্রি করেন। আর সব কৃষকই সমানভাবে উৎপাদনশীল নন। দাম কম হলে কম উৎপাদনশীল খামারিরা (যাদের উৎপাদন খরচ বেশি) ব্রয়লারের বাচ্চা কেনা বন্ধ করে উৎপাদন বন্ধ করে দেন। ব্রয়লারের দাম বেশি হলে এ কম উৎপাদনশীল খামারিরা আবারো মুরগির উৎপাদন শুরু করেন। কাজেই কম দাম বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং উচ্চ মূল্য সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়।

অন্যদিকে যখন কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তখন এর চাহিদা কমে যায়। ভোক্তারা বিভিন্ন বিকল্প খোঁজেন, এতে একটি খাদ্যপণ্যের জায়গায় অন্যটি প্রতিস্থাপিত হতে পারে। ব্রয়লার মুরগির উদাহরণে ফিরে আসা যাক ব্রয়লার মুরগির দাম কম হলে অনেক ভোক্তা মাছের পরিবর্তে মুরগির মাংস কেনেন, আবার ব্রয়লার মুরগির দাম বেশি হলে অনেক ক্রেতা মুরগির পরিবর্তে সবজি কেনেন। এভাবেই দাম বাড়লে চাহিদা কমে এবং দাম কমলে চাহিদা বাড়ে।

মার্কেট ক্লিয়ারিং মূল্য (বাজারমূল্য) হলো সেই মূল্য যেখানে ক্রেতার চাহিদা ও বিক্রেতার জোগানের মধ্যে ভারসাম্য থাকে এবং সরবরাহকৃত সব পণ্য বিক্রি হয়ে যায়। সরকার যদি মার্কেট ক্লিয়ারিং মূল্যের কম সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে তাহলে বাজারে ঘাটতি তৈরি হতে পারে। ঘাটতি হলে অনেক ভোক্তা হয়তো বাজারে পণ্য পাবেন না। 

খামারিরা মুরগি ও ডিম বিক্রি করেন ব্যবসায়ীদের কাছে এবং ব্যবসায়ীরা তা শহরের পাইকারি বাজারে সরবরাহ করেন। রমজান মাসের অধিকাংশ সময়ে মুরগির খামারিরা ১৭০ টাকা প্রতি কেজিতে মুরগি বিক্রি করেছেন, যা খামার পর্যায়ের মার্কেট ক্লিয়ারিং মূল্য। বর্তমানে ব্রয়লার মুরগির চাহিদা বাড়ায় আগের চেয়ে বেশি মার্কেট ক্লিয়ারিং মূল্যে ২০০ টাকা প্রতি কেজিতে খামারিরা মুরগি বিক্রি করছেন। যদিও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর খামারিদের জন্য ১৫১.৮০ টাকা সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

সরকারের বেঁধে দেয়া দাম কার্যকরের চেষ্টা করলে কী হবে? উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কম উৎপাদনশীল ক্ষুদ্র খামারি সরকারের বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বেশি খরচে ব্রয়লার মুরগি উৎপাদন করেন। এ খামারিদের বেঁধে দেয়া দামে মুরগি বিক্রি করতে বাধ্য করা হলে তারা লোকসানের মুখে পড়বেন এবং উৎপাদন বন্ধ করে দেবেন। এতে সরবরাহ কমে যাবে, ফলে বাজারে মুরগির ঘাটতি দেখা দেবে।

বর্তমানে, খামারিরা প্রতিটি ডিম ৮.৫০ টাকা দরে (ট্রেডারদের কাছে) বিক্রি করছেন। এতে বেশির ভাগ ক্ষুদ্র খামারি লোকসান করছেন, কারণ তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। খামারিরা জানেন, রমজানে সাধারণত ডিমের চাহিদা কম থাকে। ভোক্তারা রমজানের ঐতিহ্যবাহী খাবার (খেজুর, ছোলা, বেগুন, হালিম ইত্যাদি) বেশি খান এবং ডিমের প্রতি এ সময়ে তাদের আগ্রহ কম থাকে। এর পরও তারা (খামারিরা) ডিম উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছেন, কারণ তারা আশা করছেন যে রমজান শেষে ডিমের দাম বাড়বে এবং তারা লাভের মুখ দেখবেন।

অথচ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ডিমের সর্বোচ্চ দাম ৯.০৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। এ ঘোষিত সর্বোচ্চ মূল্য বর্তমান বাজারমূল্যের (৮.৫০ টাকা) চেয়ে বেশি হলেও ক্ষুদ্র খামারিদের উৎপাদন খরচের তুলনায় কম। যদি সরকার বেঁধে দেয়া দাম কার্যকর করার চেষ্টা করেন তাহলে ক্ষুদ্র খামারিরা লাভ করার আশা হারিয়ে ডিমের উৎপাদন বন্ধ করে দেবেন। এতে বাজারে ডিমের ঘাটতি তৈরি হবে।

একজন অর্থনীতিবিদ হয়তো বলবেন, আসলে এটা সৌভাগ্যের বিষয় যে ডিম ও মুরগির বেঁধে দেয়া দাম কার্যকর করা হচ্ছে না। এই বেঁধে দেয়া দাম সংশোধন করা উচিত, না হলে খামারিরা উৎপাদনবিমুখ হবেন। 

সরকার যদি ডিম ও মুরগির মাংস সস্তা করতে চায়, তাহলে সরবরাহ কমানোর পরিবর্তে সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা নেয়া ভালো। উদাহরণস্বরূপ পোলট্রি ফিড (ভুট্টা, সয়াবিন মিল, ভিটামিন ইত্যাদি) তৈরিতে ব্যবহৃত উপকরণগুলোর ওপর থেকে আমদানি শুল্ক এবং অন্যান্য কর প্রত্যাহার করা। ফিডের খরচ কমলে মুরগি ও ডিমের উৎপাদন খরচ কমবে, এতে ছোট খামারিরা সহজে লাভের মুখ দেখবেন।


কাজী জাহিন হাসান: ব্যবসায়ী ও কাজী ফার্মসের পরিচালক 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন